কালী সাধক ও শ্যামাসঙ্গীত রচয়িতা রামপ্রসাদ সেন

সাধক ও কবি রামপ্রসাদ সেন চব্বিশ পরগনা জেলার কুমারহট্ট গ্রামে (বর্তমান হালিশহরে) ইং ১৮২২ খ্রীষ্টাব্দে (বাংলা সন ১২২৯ সালে) বৈদ্যবংশে জন্মগ্রহণ করেন | তাঁর পিতার নাম ছিল রামরাম সেন এবং পিতামহের নাম ছিল রামেশ্বর সেন | রামপ্রসাদ ছিলেন তাঁর পিতার দ্বিতীয় পুত্র |

রামপ্রসাদের পিতামহ ও পিতা সুপন্ডিত ছিলেন | রামপ্রসাদ মেধাবী ছাত্র ছিলেন | পাঠশালার পড়া শেষ করার পর তিনি সংস্কৃত, হিন্দী ও পারসী ভাষা শিক্ষা করেন | মাত্র ২২ বছর বয়সেই তাঁর বিবাহ হয় | তারপর তাঁর তিনটি সন্তান জন্মগ্রহণ করেন | রামদুলাল নাম এক পুত্র এবং পরমেশ্বরী ও জগদীশ্বরী নাম দুই কন্যা |

পাঠ শেষ হতে-না-হতেই তাঁর পিতৃবিয়োগ হয় অর্থভাবের কারণে তিনি কলকাতার গরানহাটায় দুর্গাচরণ মিত্রের জমিদারীতে মুহুরীর চাকরী করতে শুরু করেন | কিন্তু তাঁর মনপ্রাণ সাংসারিক হিসেবে-নিকাশের অনেক উর্দ্ধের জগতে বিচরণ করত |

জগজ্জননী মা কালীর পাদপদ্মে মনপ্রাণ সমর্পন করে তাঁর চিন্তাতেই কবি সর্বদা নিমগ্ন থাকতেন | এর অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ কবির সমস্তপ্রকার সাংসারিক কাজকর্ম ও নিসাব-নিকাশ এলোমেলো হয়ে যেত | কিন্তু এর পাশাপাশি তাঁর কবিপ্রতিভা স্ফুরিত হতে শুরু করে | সহজ সরল প্রাণের ভাষায় অপূর্ব ছন্দে রচিত সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে তিনি শ্যামা মায়ের পায়ে তাঁর ভক্তির অর্ঘ্য সাজিয়ে দিতে শুরু করেন |

তাঁর ভক্তিভাবের তন্ময়তা এতটাই গভীর হতো যে তিনি স্থান-কাল-পাত্রের বোধ পর্য্যন্ত হারিয়ে ফেলতেন | একদিন তিনি তাঁর চাকরীস্থলে, জমিদারীর আয়-ব্যয়ের হিসাবের পাকা খাতার মধ্যে সম্পূর্ণ ভাবের ঘরে লিখে বসেন -------- "আমায় দে মা তবিলদারী,

আমি নিমকহারাম নই শঙ্করী |

পদরত্ন-ভান্ডার সবাই লুটে, ইহা আমি সইতে নারি ||

ভাঁড়ার জিম্মা যার কাছে মা, সে যে ভোলা ত্রিপুরারি |

শিব আশুতোষ স্বভাব - দাতা, তবু জিম্মা রাখ তাঁরি ||

জমিদারীর হিসেবের খাতায় এইরকম গান লেখা দেখে প্রধান হিসাব-রক্ষক গানের কোনও অর্থ উদ্ধার করতে পারলেন না | উল্টে রেগে মেগে হিসাবের খাতা নিয়ে জমিদার মশাইয়ের কাছে রামপ্রসাদের বিরুদ্ধে নালিশ জানাতে গেলেন | কিন্তু ফল হলো উল্টো | জমিদার মশাই ছিলেন সুরসিক | তিনি খাতা খুলে গানটি মনোযোগ সহকারে পড়লেন | গানটির ভাববস্তু এবং সাহিত্যমূল্য উপলব্ধি করে অতিশয় মুগ্ধ হলেন |

 

জমিদার মশাই রামপ্রসাদকে প্রশংসিত করলেন এবং এইরকমের শ্যামা সঙ্গীত রচনায় উৎসাহিত করে বললেন যে তার আর জমিদারীর চাকরী করার প্রয়োজন নেই | জমিদারী থেকে তাকে নিয়মিত ভাবে প্রতিমাসে ৩০টাকা বৃত্তি বরাদ্দ করা হলো | অতয়েব তিনি যেন বাড়ী গিয়ে নিশ্চিন্ত মনে মায়ের আরাধনা ও নামগান করে জীবন কাটান |

 

এরপর রামপ্রসাদ হালিশহরে ফায়ার আসেন এবং জগজ্জননীর আরাধনায় নিজেকে সমর্পন করে দেন | এর পাশাপাশি চলতে থাকে অবিরত ভক্তি মূলক শ্যামাসঙ্গীত রচনা | তিনি সুগায়ক ছিলেন | স্বরচিত গানে সুরারোপ করে তিনি যখন মনের আনন্দে গাইতেন, তখন সে গান যিনিই শুনতেন তিনিই ভক্তিরসে আপ্লুত হতেন | ক্রমে তাঁর খ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে |

 

কথিত আছে রামপ্রসাদ সেন একদিন তাঁর বাড়ীর বাগানে বেড়া বাঁধছিলেন | একা একা বেড়া বাঁধতে অসুবিধা হওয়ার কারণে রিনি তাঁর একটি মেয়েকে সাহায্য করার জন্য ডেকেছিলেন | সেই মেয়েটি কিন্তু বাড়ীর ভিতরে সংসারের কাজে বাস্থ ছিল, তাই বাবার ডাকে সঙ্গে সঙ্গে আসতে পারেনি | এদিকে, রামপ্রসাদ সেন দেখলেন যে বেড়ার অপর পারে যেন তাঁর মেয়ে এসেছে এবং বেড়ার ফাঁক দিয়ে দড়ি গলিয়ে দিয়ে তাঁকে বেড়া বাঁধতে সাহায্য করছে | রামপ্রসাদ তাই মনের আনন্দে শ্যামাসঙ্গীত গাইতে থাকলেন ও বেড়া বাঁধতে থাকলেন | আসলে রামপ্রসাদের স্বতঃস্পুর্ত্ত ভক্তিগীতি শোনার আগ্রহে তাঁর আরাধ্য দেবী কালী তাঁর কন্যার রূপ ধরে এসেছিলেন | এদিকে অনেক সময় পার হয়ে গেছে, বেড়া বাঁধাও প্রায় সম্পূর্ণ | এমন সময় যে কন্যাটিকে রামপ্রসাদ ডেকেছিলেন, সে এসে হাজির | কন্যাটি যখন দেখল যে বেড়া বাঁধা প্রায় সম্পূর্ণ, তখন সে তাঁর পিতাকে জিজ্ঞাসা করল যে কে এসে তাঁকে বেড়া বাধার কাজে সাহায্য করেছে | কারণ সে এতক্ষন বাড়ীর ভিতর সংসারের কাজে ব্যস্ত ছিল | তখন রামপ্রসাদ উপলব্ধি করলেন যে তাঁর সন্তানের কায়া ধারণ করে স্বয়ং জগজ্জননী এসেছিলেন সাহায্য করতে |

 

নবদ্বীপের তদানীনন্ত রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রামপ্রসাদকে 'কবিরঞ্জন' উপাধিতে ভূষিত করেন এবং কয়েক বিঘা নিস্কর জমি দেন করেন |

 

৭২ বছর বয়সে এক কৃষ্ণা-চতুর্দশী তিথিতে পুজো সম্পূর্ণ করে কালীমূর্তি মস্তকে ধারণ করে রামপ্রসাদ গঙ্গাবক্ষে দন্ডায়মান অবস্থায় বিলীন হয়ে গেলেন | সেই সময় গঙ্গাতীরে উপস্থিত অনুগামীরা দেখলেন যে তাঁর দেহ থেকে এক জ্যোতির্ময় পদার্য নির্গত হে শুন্যে অদৃশ্য হয়ে গেল | জনশ্রুতি আজও সেইরকম কথা বলে |

 

তাঁর রচিত ভক্তিরসসঞ্চিত কবিতাগুলিই রামপ্রসাদী সঙ্গীত নামে আজও বিখ্যাত ও জনপ্রিয় |

 

বাংলার ভক্তিসাধনার ইতিহাসে তিনি এক উজ্জ্বল জ্যোতিস্ক হিসাবে আজও সম্মানিত, পূজ্য এবং জনপ্রিয় হয়ে আছেন | ভক্তিপথে যে ঈশ্বরকে নিশ্চিতভাবে পাওয়া যায় এ প্রত্যয় তিনি আপামর বাঙালীর বুকে গেথে দিয়ে গেছেন | সে কারণে, যখন দক্ষিণেশ্বরে মা ভবতারিনীর মন্দিরের পুরোহিত শ্রী গদাধর চট্টোপাধ্যায়ের সাধনা-পর্ব চলছে অথচ মা কালীর প্রকট দর্শন পাচ্ছেন না, তখন তিনি দেবীর উদ্দেশ্যে আক্ষেপ করে বলতেন ------ "মা, তুই রামপ্রসাদকে দেখা দিয়েছিস, তবু আমাকে দেখা দিছিস না ! কী করলে তোর দেখা পাব বল?"

 

আগামী বছর (২০২২) সালে তাঁর জন্মের দ্বিশত বর্ষ পড়বে | বাঙালি তাঁকে কী ভাবে স্বরণ করে ও উদযাপন করে তাঁর পথ চাওয়া শুরু হলো |

More Articles