সমাজের সমস্ত বেড়াজালকে ভেঙে দিয়ে প্রথম আত্মজীবনী লিখেছিলেন এই মহিলা, তাও আবার বাংলা ভাষায়!

১৮-১৯ শতকের কথা, যখন মেয়েদের কাছে পড়াশোনা করা ছিল পাপ! বলা হত, মেয়েরা পড়াশোনা করলে নাকি বিধবা হয়ে যায়। সেরকমই এক পুরুষতান্ত্রিক সমাজের থেকে উঠে এসেছিলেন অত্যন্ত সাধারণ ঘরের একজন মহিলা যিনি লিখে ফেলেছিলেন প্রথম আত্মজীবনী, তাও আবার নিজের মাতৃভাষা বাংলায়। কে সেই মহিলা জানেন? জেনে নিন এই প্রতিবেদনটি পড়ে।

বর্তমান যুগে আমরা বহু বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি লেখকের আত্মজীবনী দেখেছি। বাংলা এবং অন্যান্য সাহিত্য জগতের প্রায় প্রত্যেক লেখক, এমনকি যেকোনো জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব একবার না একবার নিজের জীবনের আত্মকথা লিখে গিয়েছেন। ফলাও করে সেগুলি প্রকাশিত করা হয়েছে এবং বহু বইপোকা এবং সেই ব্যক্তিত্বের ভক্তরা সেই লেখাগুলি পড়ে আত্মতৃপ্তিও করেছেন। কিন্তু, আপনারা কি জানেন, প্রথম আত্মজীবনী কিন্তু লিখেছিলেন একজন অত্যন্ত সাধারণ মহিলা, যার না ছিল কোন লেখক স্বত্বা, আর না ছিল কোন বিশেষ ব্যক্তিত্ব পরিচয়। বরং তিনি ছিলেন অত্যন্ত সাদামাটা একজন বাঙালি গৃহবধূ। এমন একটা সময় যখন, মেয়েদের পড়াশোনা করা মানেই পাপ করার সমান, সেই সময় এই মহীয়সী মহিলা নিজের আত্মজীবনী লিখে ফেলেছিলেন। তাও আবার বাংলা ভাষায়। আজকে তার ব্যাপারেই আলোচনা।

এই মহিলার নাম হল রাসসুন্দরী দেবী। বাংলা সাহিত্যের একদম গোড়ার দিকের কয়েকজন লেখিকার মধ্যে একজন হলেন রাসসুন্দরী দেবী। বাংলা ভাষায় প্রথম প্রকাশিত আত্মজীবনী, আমার জীবন - র লেখিকা ছিলেন এই রাসসুন্দরী দেবী। তিনি নিজের জীবনটাকে পুঁথিবদ্ধ করলেও, সেই সময় কালটা মেয়েদের জন্য একেবারেই সুবিধের ছিলনা। সে ১৮-১৯ দশকের কথা। ভারতের একেবারে উচ্চ বংশ এবং উচ্চ জাতে ধীরে ধীরে প্রবেশ করতে শুরু করেছিল সমাজ সংস্কারের ধারণা। কিন্তু নিম্নবর্গের মহিলাদের ক্ষেত্রে জারি করা ছিল বিধি-নিষেধের বেড়াজাল। সেই সময় একটা ধারণা ছিল, মেয়েদের লেখাপড়া করতে নেই। যদি মেয়েরা লেখাপড়া করেন, তাহলে তাদের বিধবা হতে হয়। কিন্তু, এই সমস্ত সমাজের বিধি-নিষেধের বেড়াজালের ধার ধারতেন না রাসসুন্দরী দেবী। প্রথম থেকেই তিনি চেয়েছিলেন পড়াশোনা করতে। 

কিন্তু, বাড়ির চাপে মাত্র ১২ বছর বয়সে বিবাহ করতে বাধ্য হন রাসসুন্দরী দেবী। তবে বিবাহ হয়ে গেলেও, পড়াশোনা করার একটা চেষ্টা তার মধ্যে রয়ে গিয়েছিল। কিন্তু, নতুন বাড়ি, নতুন পরিবেশে এভাবে কি করে পড়াশোনা করা যাবে? সেই সময় পর পুরুষকে মুখ দেখানো অবধি মেয়েদের ক্ষেত্রে পাপ মনে করা হতো। তাই মধ্য এবং নিম্নবর্গের সমস্ত মহিলাই ঘোমটা টেনে বাড়ির অন্দরমহলে বিরাজ করতেন। কিন্তু রাসসুন্দরী দেবী প্রথম থেকেই একটু অন্য মানসিকতার। তিনি একটা জেদ ধরে নিয়েছিলেন, তাকে পড়াশোনা শিখতেই হবে। তিনি পড়াশোনা শিখেওছিলেন, তবে একদম অসম্ভব উপায়ে। যখন রাসসুন্দরী দেবীর বয়স মোটামুটি ২৬ বছর সেই সময় তিনি নিজে নিজেই লেখাপড়া করতে শুরু করেন।

রাসসুন্দরীর বিবাহ হয়েছিল ফরিদপুর বাংলাদেশের নীলমণি রায় নামের একজন সম্ভ্রান্ত জমিদারের সঙ্গে। নীলমনি রায়ের বাড়ি ছিল অত্যন্ত ধার্মিক প্রকৃতির। রাসসুন্দরী প্রথম থেকে নিজের বিধবা মায়ের কাছে মানুষ হয়েছিলেন তাই ঠাকুর দেবতার প্রতি তার একটা আলাদা রকমের আকর্ষণ ছিল। তার শ্বশুরবাড়িতেও পরিবেশ খানিকটা এরকম থাকায় তার মানিয়ে নিতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি। কিন্তু ভগবানের প্রতি বিশ্বাস তাকে সমস্ত কিছুকে দূরে সরিয়ে দিতে সাহায্য করেছিল। আর এই বিশ্বাস থেকেই তিনি নিজের পড়াশোনা শেখার উদ্যম পেয়েছিলেন। মাত্র ১৪ বছর বয়সেই রাসসুন্দরীকে পুরো সংসারের দায়িত্ব নিতে হয়েছিল কারণ তার শাশুড়ি নিজের দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন এবং তার কাজ করার ক্ষমতা চলে গিয়েছিল। রান্না করা থেকে শুরু করে অতিথিদের আপ্যায়ন সবই নিজের হাতে করতেন রাসসুন্দরী দেবী। চাকর-বাকর থাকলেও, তাদেরকে বাড়ির অন্দরমহলে প্রবেশ করতে দেওয়া হতো না। তার বয়স যখন ১৮ বছর, তিনি প্রথমবার তখন মা হন। জানা যায় তার ১২ সন্তান ছিল যার মধ্যে ৭ জন কম বয়সে মারা গিয়েছিল। 

এভাবেই তার জীবন চলছিল। কিন্তু তার মনে একটাই ইচ্ছা ছিল, তিনি জীবনে একবার না একবার শ্রীমদ্ভগবদগীতা নিজে পড়বেন। এমন সময় একদিন তার স্বামী রান্নাঘরে চৈতন্য ভগবদ্গীতার বইটি রেখে চলে যান। অত্যন্ত সাহস করে রাসসুন্দরী দেবী ওই বইয়ের থেকে একটি পাতা ছিঁড়ে নিয়ে রান্নাঘরে খড়খড়ির নিচে লুকিয়ে রাখেন। কিন্তু, অক্ষর চিনবেন কি করে? এটা ছিল তার কাছে একটা বিশাল বড় চ্যালেঞ্জ। সেই সময়, তিনি তার ছেলের কাছ থেকে একটি তালপাতা সংগ্রহ করেন, যেখানে তার ছেলে হাতের লেখা অভ্যাস করত। এখান থেকেই শুরু হলো তার অক্ষর চেনা এবং পড়াশোনা। দুটি পাতার অক্ষর মিলিয়ে মিলিয়ে তিনি অক্ষর চেনা শুরু করলেন। তার বয়স যখন ২৬ বছর তখন তিনি পড়তে পারলেন সবকিছু। 

তবে তার লিখতে পারার পিছনে তার ছেলেদের অবদান ছিল সবথেকে বেশি। কলকাতা থেকে কাগজ এবং কালি-কলম নিয়ে এসে তার ছেলেরা তাকে চিঠি লেখার জন্য বায়না করত। সেই থেকেই রাসসুন্দরী দেবীর লেখায় হাতেখড়ি। ৫৯ বছর বয়সে বিধবা হওয়ার পরে আস্তে আস্তে তিনি তার জীবন কাহিনী নথিবদ্ধ করতে শুরু করলেন। তার স্বামীর মৃত্যুর মাস কয়েক পরে তিনি নিজের জীবন বৃত্তান্ত এর প্রথম খন্ডটি শেষ করলেন এবং প্রকাশিত হল আমার জীবন বইটির প্রথম খন্ডটি। এই বইটি দ্বিতীয় খন্ডটি প্রকাশিত হলো তার বছর কয়েক পরে ১৮৯৭ সালে, এবং সেখানে তিনি বিধবা হবার পরে তার জীবনের যা কাহিনী রয়েছে সেটাই লিখেছিলেন। 

রাসসুন্দরী দেবী লেখা ঐ বই দুটো নিয়ে একটু বলতে গেলে, ওই বইয়ের প্রথম খন্ডটিতে মূলত ১৬টি রচনা আছে। এবং দ্বিতীয় খন্ডে আছে ১৫টি রচনা। এই বইয়ের ছত্রে ছত্রে তৎকালীন সমাজের মহিলাদের অবস্থান এবং রাসসুন্দরী দেবীর আত্ম প্রচেষ্টার কাহিনী লেখা রয়েছে। এছাড়াও, এই বইয়ের প্রথম দিকে রয়েছে একটি কবিতা, যা তিনি লিখেছেন তার দয়া মাধবকে নিয়ে অর্থাৎ নীলমণি রায়ের বাড়ির বৈষ্ণব ঠাকুর দয়া মাধব। চাস্তে বাংলা ভাষায় এই দুটি বই রচনা করা হয়েছিল। ঊনবিংশ শতক নাগাদ বাঙালি মহিলাদের কিভাবে পড়াশোনা করার জন্য লড়াই করতে হয়েছিল, কিভাবে রাসসুন্দরী দেবী নিজে পড়াশোনা শিখেছিলেন, এবং গ্রামীণ সমাজে মেয়েদের পড়াশোনা করাকে কি ভাবে দেখা হতো সেই সব নিয়ে রয়েছে বিস্তারিত আলোচনা।

এই বইয়ের দুটি দিক রয়েছে। একটি দিকে আমরা দেখতে পাই, রাসসুন্দরী দেবী কিভাবে নিজের ইষ্টদেবতার প্রতি আনুগত্য এবং তার প্রতি বিশ্বাস রেখেছিলেন সেই ব্যাপারে। অন্যদিকে আমরা দেখতে পাই তৎকালীন সমাজের মহিলাদের চিত্ররূপ এর কিছু অংশ। তবে, এই বইয়ের কোথাও তেমন কিছু সাহিত্যিক ভনিতা কিংবা অপ্রয়োজনীয়' নারীবাদী সত্বা নিয়ে কোন কিছু লেখা নেই। সোজাসাপ্টা, আন্ত:মিলন যুক্ত অধ্যায়গুলি কোন রাখঢাক না রেখে সে যুগের সমাজে মেয়েদের বিশেষ করে মধ্য এবং নিম্নবর্গের মেয়েদের অবস্থার কথা বর্ণনা করে। ভারতের প্রথমদিকের কিছু নারীবাদী মহিলার মধ্যে একজন হলেও রাসসুন্দরী দেবী কখনোই সমাজের বিরোধিতা করে কিছু লেখেনি তার বইতে।

বরং তিনি তাঁর বইতে উনবিংশ শতকের সেই ধারার বিরোধিতা করেছেন, যেখানে বলা হত, বাড়ির মেয়েরা পড়াশোনা করলে নাকি বাড়িতে বিপদ ডেকে আনে। এমনকি এও বলা হত, যে মহিলারা পড়াশোনা করেন, তাদেরকে নাকি ভগবান বিধবা করে দেয়। তিনি শুধুমাত্র যে নিজে পড়াশোনা শিখেছেন তা কিন্তু নয়, বরং তিনি নিজের জীবনের প্রত্যেকটি কথা এবং নিজের এবং নিজের আশেপাশের সমস্ত মহিলাদের সংগ্রামের কথা সোজাসাপ্টা বাংলা ভাষায় লিখে গিয়েছেন তার বইতে। নিজের জীবনের প্রত্যেকটি অধ্যায়কে সকলের সামনে তুলে ধরার একটা ক্ষমতা ছিল তার মধ্যে। এর মাধ্যমে তিনি এমন বৃত্তে প্রবেশ করেছিলেন যেখানে শুধুমাত্র থাকতেন বাঙালি সম্ভ্রান্ত মহিলারা, আরো ভালোভাবে বলতে গেলে, বাঙালি সম্ভ্রান্ত হিন্দু ঘরের মহিলারা। 

উনবিংশ শতকে এমনটাই বিশ্বাস করা হতো, বাঙালি মধ্য বর্গীয় এবং নিম্নবর্গীয় মহিলারা শুধুমাত্র বাড়ির কাজ করবেন, পুজো করবেন এবং ঠাকুরের জন্য ভোগ রান্না করবেন। এই সমস্ত নীতির বিরোধিতা করে রাসসুন্দরী দেবী নিজের একটা আলাদা জগৎ তৈরি করেছিলেন। সেখানে তিনি ভগবানের সাথে একটা বৌদ্ধিক সম্পর্ক তৈরি করেছিলেন, যেখানে তিনি তার ভগবানকে প্রশ্ন করতেন, যার উত্তর ভগবান তার ভগবদ্গীতার মাধ্যমে তাকে দিতেন। তিনি প্রত্যক্ষভাবে ভগবানের পূজা করতেন, শুধুমাত্র ভোগ রান্না করার একজন গৃহকর্ত্রী হিসেবে তিনি থেমে থাকেননি। তার এই সমস্ত কাজের জন্যই, আমরা এখনো অল্পবিস্তর তাকে মনে রেখেছি। তার বইয়ের মাধ্যমে, তার সমাজের বেড়াজালকে পেরিয়ে যাওয়ার ক্ষমতার মাধ্যমে তিনি এখনো অনেকের অনুপ্রেরণা, যা সত্যিই অনস্বীকার্য!

More Articles