বাঙালির ইয়েতি অভিযান, সিনেমা নয়, এই গল্পটা সত্যিই...

ইয়েতির সন্ধান নিয়ে গোটা একটা সিনেমা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ষাট বছর আগেকার সেই রোমহর্ষক ঘটনায় কোনও আলো পড়েনি আজও!

পাথুরে পাহাড়ি পথের উপর দিয়ে উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে ছুটে চলেছে এক যুবক। সঙ্গে শেরপা আং তেম্বা। এবড়ো খেবড়ো পথটি বেদিং গ্রাম ছাড়িয়ে চলে গিয়েছে এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসিনীর ডেরার দিকে। আজ সকালেই বেদিং গ্রামের প্রধান লামা মারফৎ যুবকটি খবর পেয়েছে এই সন্ন্যাসিনীর সংগ্রহে নাকি রয়েছে একটা সাংঘাতিক জিনিস। কয়েক শতকের খোঁজ এবার কি তবে সফল হতে চলেছে! কী সেই জিনিস? ইয়েতির একটা চামড়া। এক দৌড়ে সেই ডেরায় পৌঁছেই যুবক প্রথম হোঁচটটা খেলেন। বলে কী! পাক্কা একটি হাজার টাকা না ফেললে বুড়ি চামড়া দেখাবেই না; কেনা তো অনেক দূর কি বাত। ষাটের দশকে হাজার টাকা নেহাৎ কম অঙ্ক না। দরদামের বৃথা চেষ্টা। অনেক বুঝিয়ে, চামড়া খাঁটি হলে কেনার প্রতিশ্রুতি দিয়েও লাভ হল না। বুড়ি সিদ্ধান্তে অটল। যুবকের কাছে এদিকে পয়সা নেই। খবরটা পেয়েই চাক্ষুস দেখার লোভে ছুটে এসেছেন। ভেবেছিলেন দলের মধ্যে প্রথম তিনিই চামড়াটা দেখবেন। ব্যর্থ মনোরথ অগত্যা ফিরতে হল দলনেতার কাছে। দলনেতা মন দিয়ে সব শুনলেন। এক্ষত্রে দ্বিধার গোলকধাঁধায় পড়ে সময় নষ্ট করার পাত্র ছিলেন না তিনি। সঙ্গে আরো একজন লোক এবং পয়সাকড়ি দিয়ে তাদের পাঠালেন চামড়াটা একেবারেই কিনে ফেলার জন্য। তিনজনে বহুক্ষণ দরদাম করে শেষ পর্যন্ত চামড়া কিনলেন তিন-তিনশোটি টাকা দিয়ে। চামড়ার গাঢ় ধূসরে মাঝে মাঝে ছুঁয়ে যাচ্ছিল সোনালি। অসম্ভব সুন্দর, তবে ইয়েতির না। সম্ভবত ব্লু বিয়ার টিয়ার হবে। বৃদ্ধার কাছেই জানা গেল তিব্বতের এক মনেস্ট্রি থেকে চামড়াটা আনা হয়েছিল।

গল্পের শুরুতে যে যুবকের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হল, মজার ব্যাপার তিনি আদ্যোপান্ত বাঙালি, নাম ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে বিখ্যাত অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় না, ইনি পেশায় নেশায় সাংবাদিক। আর যে লোকটিকে দলনেতা পরে পাঠালেন তাঁদের সঙ্গে, তিনি ডয়েগ, ডেসমণ্ড ডয়েগ, সেই সময়কার আরেক নাম করা সাংবাদিক। জাতে অ্যাংলো আইরিশ, চাকরি করতেন দৈনিক স্টেটসম্যান পত্রিকায়। ভানুও তখন একই পত্রিকায় ফ্রিল্যান্সার। ডয়েগের আণ্ডারস্টাডি ও সহকারী। উল্লেখযোগ্য বিষয় দু'জনেই কলকাতার লোক। ফলে বলা চলে একটুর জন্য ইয়েতি বাঙালির মুঠোয় এসেও ফসকে গেল সেইবার। আর সেই দলনেতা? এভারেস্টজয়ী বিশ্বখ্যাত পর্বতারোহী স্যার এডমন্ড হিলারি। ইয়েতির সন্ধান নিয়ে গোটা একটা সিনেমা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ষাট বছর আগেকার সেই রোমহর্ষক ঘটনায় কোনও আলো পড়েনি আজও!

 

 

গল্পটার শুরু অন্যত্র। উপরের ঘটনার মাস দুয়েক আগেও ডয়েগ ও ভানু চষে বেড়াচ্ছিলেন ভুটান। কখনও পায়ে হেঁটে, কখনো ঘোড়া, খচ্চর বা ইয়াকের পিঠে চেপে ঘুরছিলেন এঁরা ছোট্ট দেশটার ব্যাপক এলাকা জুড়ে, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনের একটা আর্টিকেলের জন্য। হঠাৎ খবর এল ওয়ার্ল্ড বুক এনসাইক্লোপিডিয়া স্পনসর্ড হিমালয়ান সায়েণ্টিফিক অ্যাণ্ড মাউণ্টেনিয়ারিং অভিযান এবং ইয়েতি হান্টিং অভিযানে যে ‘অফিশিয়াল রিপোর্টার’ পদের জন্য আবেদন করেছিলেন ডয়েগ, তার জবাব এসেছে। ডয়েগ মনোনীত। আর রইল বাকি ভানুর কথা, তিনি যে নেহাৎ কপাল জোরে অমন একটা অভিযানে জড়িয়ে গিয়েছিলেন, তা তিনি পরবর্তীতে নিজের টক শো-এ বারবার বলেছেন।

 

এই অভিযান চলেছিল মোট ১৪ মাস। ২১ জনের এই দলটি ১৯৬০ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর ৮০০ জন পোর্টার সহ কাঠমাণ্ডু থেকে রওনা দেয় এবং ১৯৬১ সালের নভেম্বর মাসে ফিরে আসে কাঠমাণ্ডুতেই। ভানুর ওপরে দায়িত্ব ছিল মূলত যোগাযোগ ব্যবস্থা দেখাশোনা করা। কলকাতা থেকে ১২ ট্রাক মালপত্র নিয়ে পিটার মালগ্রু এবং ভানু আসেন পাটনায়। সেখান থেকে চাটার্ড ডিসি-৩ (ডাকোটা) বিমানে করে মালসমেত তাঁরা পৌছান কাঠমাণ্ডুতে। সেখানে তখন সাজো সাজো রব। মালপত্র সব গুছিয়ে ফেলতে হবে, কিন্তু খেয়াল রাখা দরকার প্রতি প্যাকের ওজন যাতে ৬০ পাউণ্ডের বেশি না হয়। তাহলে পোর্টারদের অসুবিধে হবে। রওনা হওয়ার সময় গোটা দলটি দু'টি ভাগে ভাগ হয়ে গেল। ভানুর দলে ডয়েগ সহ হিলারি, এদের কাজ হল বোলওয়ালিং ভ্যালি অঞ্চলে ইয়েতির খোঁজ। অপর দলের দলনেতা প্রথম কাঞ্চনজঙ্ঘা জয়ী নর্ম্যান হার্ডি, এদের কাজ হাই-অল্টিচ্যুডের পরিবেশ মানুষের শরীরে কী কী প্রভাব ফেলে তা পর্যবেক্ষণ। ভানুর মতে, এর আগে অভিযাত্রীরা কেবল অভিযানে আসত, বৈজ্ঞানিক গবেষণার আগ্রহ কেউ দেখায়নি। তাঁরাই প্রথম একটা গোটা শীতকাল ১৯২০০ থেকে ২৪০০০ ফুটের মধ্যে নানান উচ্চতায় থেকে বহু তথ্য সংগ্রহ করেন। অভিযানের শেষে বিধান রায়ের অনুরোধে গবেষণার জন্য ব্যবহৃত ‘সিলভার হাট’-টি দার্জিলিং হিমালয়ান ইনস্টিটিউটকে খুশি মনে দিয়ে দেন হিলারি।

 

হিলারির সঙ্গে শেরপাদের পরিচয় থাকার দরুন লামাদের আস্থাভাজন হতে ইয়েতির খোঁজে যাওয়া দলটির খুব বেশি সময় লাগেনি। ভানুর কাজ ছিল মূলত গ্রামবাসীদের সঙ্গে মিশে গল্পগুজব করা, এবং মন দিয়ে নানা কিংবদন্তি শোনা, তাতে যতটা সম্ভব তথ্য জোগাড় করা যায় আর কি! সেই আড্ডাতেই ইয়েতির চামড়ার খবর পেয়েছিলেন ভানু।

 

বেদিং গ্রাম ছাড়িয়ে নামচে বাজারের একটু উপরে খুমজুং গ্রামে তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছিল আরো একটি চমক। জানা গেল ওখানকার মনেস্ট্রিতে মাথার চুলসহ চামড়া স্মারকচিহ্ন হিসাবে রাখা আছে। খুমজুঙ্গের মানুষ তা পাহারা দেয় পালা করে। পৌঁছবার পরদিনই ভানুরা ছুটলেন সেই চামড়া দেখতে। কিন্তু প্রাচীন নিয়মে বাধ সাধলে। গ্রামের তিনজন বৃদ্ধ ব্যক্তি উপস্থিত না থাকলে সেই বাক্স খোলা যাবে না। তাঁদের জোটাতেই লেগে গেল কয়েক ঘণ্টা। অবশেষে সে জিনিসের দেখা মিলল। খুমজুং থেকে মাইল আটেক দূরে প্যাঙ্গবোচে মনাস্ট্রিতেও একই ধরনের চামড়া এবং একটি হাত রক্ষিত ছিল। কিন্তু সেই মনেস্ট্রির কাছে স্মারকগুলো অত্যন্ত পবিত্র। কাজেই পরীক্ষার সুযোগ মিলবে না আঁচ করে অভিযাত্রী দলটি খুমজুঙ্গের দিকেই নজর দিয়েছিল বেশি। খুমজুঙ্গের মানুষেরা তাঁদের স্মারকটি পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য ব্রিটেনে নিয়ে যাবার প্রস্তাবে রাজি হল বটে, কিন্তু ৬ দফা দাবির একটি চুক্তির ভিত্তিতে। এইসব বিদেশীকে বিশ্বাস নেই। চামড়া বেমালুম গাপ করে দিলে? তাই এই চুক্তি। তাতে যাবতীয় পরীক্ষার জন্য বরাদ্দ হল ছয় সপ্তাহ। ২৫শে নভেম্বর হিলারি, ডয়েগ, পারকিন্স রওনা হলেন কাঠমান্ডুর উদ্দেশ্যে। সঙ্গে চুক্তির শর্ত অনুসারেই গ্রামের প্রতিনিধি কুঞ্জো চুম্বি।

 

 

শিকাগো, লণ্ডন এবং প্যারিসে সেই চামড়া খুঁটিয়ে দেখা হল। শিকাগোর ন্যাচেরাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম রায় দিল, এ চামড়া এক ধরনের পাহাড়ি ছাগলের। তাতে নাকি কারুকাজ করা হয়েছে। প্যারিসের মুজে ভিলা হোমও রায় দিল, এ খুলি ও চামড়া পাহাড়ি ছাগল সেরোর। একমত হলেন লণ্ডনের রয়াল জুলজিক্যাল সোসাইটিও। তবে গ্রামবাসীদের একটি দাবিকে তারা সমর্থন করল, যে এই চামড়া কয়েকশো বছর ধরে সংরক্ষিত রয়েছে। কুঞ্জো ইংলণ্ড ও আমেরিকার ‘গ্রামপ্রধান’ রানি এলিজাবেথ ও আইজেনহাওয়ারের জন্য কিছু উপহার নিয়ে গিয়েছিলেন। গুঁড়ো করা সাম্‌পা বা ছাতু, বৌদ্ধ গুরু পদ্মসম্ভবের ছবি আঁকা স্ক্রোল, তিব্বতি চা, ইয়াকের লেজের চামর এবং পকেটভরা প্রাচীন তিব্বতি মুদ্রা। সম্মানিত গ্রামপ্রধানকে এই ধরনের উপহার দেওয়াটাই ছিল খুমজুঙ্গের রীতি। বাকিংহাম প্যালেসের আমন্ত্রণ পেয়ে রানির জন্য কুঞ্জো এইসব উপহার নিয়ে হাজির হয়েছিলেন বটে, কিন্তু সে সময় রানি প্যালেসে না থাকায় দেখা হয়নি তাঁদের। রানির প্রতিনিধির হাতে উপহার সামগ্রী দিয়ে কুনজো বলে এসেছিলেন এ জন্য বিন্দুমাত্র খেদ নেই তাঁর। তাঁরা হাজারবার জন্ম নেবেন। কোনও একবার ঠিক দেখা হয়ে যাবে! যদিও হাজারবার জন্ম তাঁকে নিতে হয়নি। এর কিছুদিন পরেই কুনজোর সঙ্গে দেখা করতে আসেন রানি খোদ। সে কাহিনি পাঠককে উপহার দেওয়া যাবে কখনও।

 

কুনজোকে যখন জানানো হয় গবেষণার ফলাফল, কুনজো পশ্চিমী দুনিয়ার সেই কোটি কোটি ডলারের পরীক্ষালব্ধ ফল তাদের ফিরিয়ে দেন অবহেলায়। বরং করেন এক অবিস্মরণীয় উক্তি— “নেপালে আমরা কখনও জিরাফ বা ক্যাঙ্গারু দেখিনি, তাই এদের সম্পর্কে আমাদের কোন ধারণাই নেই, ঠিক সেরম তোমাদের দেশেও ইয়েতি নেই! তোমরাও ইয়েতি সম্পর্কে কিছু জান না। বরং এই না জানা নিয়ে তোমাদের উপর আমার একটু সহানুভূতিই রইল।” কুনজো যে সেদিন পশ্চিমী দুনিয়াকে, তার বৈজ্ঞানিক আগ্রাসনকে হারিয়ে দিয়েছিলেন, ভবিষ্যৎই তার সাক্ষী হয়ে রয়েছে। 

 

আলেকজাণ্ডারই প্রথম, যাঁর ইয়েতি দেখার ইচ্ছে সম্বন্ধে জানা যায়। কিন্তু দেখা হয়ে ওঠেনি তাঁর। তারপর বহু বরফ গলে গিয়েছে, ইয়েতির খোঁজ আজও বন্ধ হয়নি। বছর দুয়েক আগে ভারতীয় সেনাদের ইয়েতির পায়ের ছাপ আবিষ্কারের খবর নেট দুনিয়ায় যেরকম হইচই ফেলে দিয়েছিল, তাতে স্পষ্ট মানুষ এনসাইক্লোপিডিয়ার পাতায় কবেকার কী রায় লেগে রইল, তাতে থোড়াই কেয়ার করে! গবেষণা রায় দিয়েছে মিথটি মিথ্যে। কিন্তু মিথ কি তাতে মরে? প্রযুক্তিবান মানুষ যতই গ্রামকে গ্রাম দখল করুক, কেড়ে নিক আদিবাসীদের নিজস্ব সত্ত্বা, পাতায় লেখা ইতিহাস আদিবাসীদের মুখে মুখে চলে আসা দীর্ঘ ইতিহাসের আঙ্গিনায় ঢুকে চিরকাল দমবন্ধ হয়ে মারা গিয়েছে, কেবলমাত্র বিশ্বাসের অভাবে। ভানুও পরবর্তীতে নিজের জীবনের কাহিনী বলার জন্য পাঠক না বেছে, বেছে নেবেন শ্রোতাদেরই। শেষজীবনে ভ্রমণপ্রিয় মানুষদের নানা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে তিনি ‘টক শো’ করবেন নিজের বর্ণময় জীবনের নানা অভিজ্ঞতা নিয়ে। হয়তো ‘লেখা ইতিহাসে’ হারিয়ে যাওয়াকে অস্বীকার করতে কুনজোর পথই বেছে নিয়েছিলেন মানুষটি! কে বলতে পারে! কজনই বা তাঁকে চিনেছে? সাহেবদের অভিযানে কাকতালীয় ভাবে ঢুকে পড়া এবং পরবর্তীতে হিলারির ঘনিষ্ঠ বন্ধু সেই তেইশ বছরের বাঙালি যুবকটি মান্য ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই না পেলেও, তাঁর শ্রোতা ও পরিচিত মানুষদের মুখে মুখে গল্প হয়ে রয়ে যাবেন। মিথ! খানিকটা ইয়েতির মতোই।

 

চিত্রঋণ- ভ্রমণকথা ২০১৫, চিত্রগ্রাহক ভানু ব্যানার্জী স্বয়ং

তথ্যঋণ-

ভানু ব্যানার্জী, ইয়েতির সন্ধানে, ভ্রমণকথা ২০১৫

Jaideep Majumder, Yeti Hunter, Times of India, Nov 21, 2014

 

More Articles