মৃত প্রেমিকার স্মৃতিতে খাবারের নাম, মোগলাই খানার যে ইতিহাস চমকে দেবে

Nihari Recipe: আপনাদের সঙ্গে এই নিহারি-র রেসিপিই শেয়ার করব। গরু বা ভেড়ার মাংস দিয়ে না হলে মাটন দিয়ে তৈরি করুন এই জনপ্রিয় পদ। খেয়াল রাখবেন, এই পদ যত বেশি সময় নিয়ে রান্না করবেন ততই বাড়বে তার স্বাদ।

মুঘল বা মোগল আমলের খাবারদাবার বললেই চোখের সামনে নাচতে থাকে বিরিয়ানি, নেহারি, শিককাবাব, ফিরনি আরও কত কী! এসব এখন সামনে পেলে পুরো সাফ করে দেবেন নিশ্চয়ই। এসব ছাড়া যায় নাকি! ‘ভেতো বাঙালি’ ভোজনপ্রিয়। কিন্তু বাঙালির রসনায় চাইনিজ, পঞ্জাবি এইসব ছাড়াও মুঘল আমলের খাবার ভীষণ প্রিয়। একে তো মশলা, তার উপর তেল-ঝাল, আর যায় কোথা। এভাবেই যুগ যুগ ধরে পৃথিবীব্যাপী মুঘল খাবার জয় করে চলেছে ভোজনরসিকদের মন। মুঘল সাম্রাজ্য শেষ হওয়ার ২০০ বছর পর এখনও মুঘল নবাবদের 'শানদার' ইতিহাসের যে বিষয়টি আমরা সবচেয়ে বেশি স্মরণ করি, তা সম্ভবত খাবার। মোগলাই খাবার শুনে জিভে জল আনার আগে একবার ইতিহাসে ঢুঁ মেরে দেখা যাক।

মুঘলদের এদেশে আগমন ১৩৯৮ সালে তৈমুর লংয়ের আক্রমণের হাত ধরে। তবে পাকা ঘর প্রথম বাঁধেন বাবর (১৫২৬-১৫৩০)। অনেকে মোগল সাম্রাজ্যের খাবারকে ভারতের খাবার বলে মনে করলেও ইতিহাস কিন্তু অন্য কথা বলে। মোগল খাবারের উৎস পারস্য বা ইরান। মূলত মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবর দিল্লি সলতানাৎ প্রতিষ্ঠার পরও ভুলতে পারেননি তাঁর পিতৃপুরুষের ভূমিকে। মোগলাই খাবারের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, মুঘলরা বেশ ভালোই খাদ্যরসিক ছিলেন। ভারতকে তাঁরা নতুন রেসিপি আর নতুন খাবার শুধু দেননি, প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত পুরনো ভারতীয় খাবারকেও নিজেদের রেসিপিতে আরও সুস্বাদু করে তুলেছিলেন। মোগল খাবারের বিশেষত্ব হলো এর ঘ্রাণ। তাদের খাবারে ভারতীয় এবং মুঘল সংস্কৃতি মিশে খাবার তৈরির উপকরণের তালিকাও হয় দীর্ঘ।

মোগল খাবারের মধ্যে বিরিয়ানি, পোলাও, কোর্মা ছাড়াও যে খাবারটি জনপ্রিয় ছিল, তা হল নিহারি বা নেহারি এবং বাকরখানি। ‘নিহারি’ বা ‘নেহারি’ ফারসি শব্দ, এর অর্থ 'সকাল'। মোগল আমলে লখনউয়ের সুইঘরে নেহারির প্রচলন শুরু। কথিত আছে, মোগল শ্রমিকদের নির্মাণকাজে পারিশ্রমিক ছাড়াও সকালে কাজের আগে নেহারি খাওয়ানো হতো। ফলে দুপুর অবধি তাদের শরীরে খিদে ও শক্তির ঘাটতি হতো না। সম্রাট বাবরের অন্যতম প্রিয় খাবার ছিল এই নিহারি।

আরও পড়ুন: মাংস-ডিমের মিশেলে সাহেবদের জন্য তৈরি এই পদের স্বাদ আজও অটুট

অষ্টাদশ শতাব্দীতে ভারতে যাত্রা শুরু করে আজ এই পদটি পাকিস্তানের জাতীয় খাবারের মর্যাদা পেয়েছে। পদটির উৎপত্তি আওয়াধি (লখনউ) না মুঘল (দিল্লি) ঘরানায়, তা নিয়ে প্রায় ‘ঘটি-বাঙালের ঠোকাঠুকি’ চলে। তবে এটি লখনউ, হায়দরাবাদ, দিল্লি এবং অবশ্যই কলকাতায় জনপ্রিয়। মূলত গরু বা ভেড়ার পায়ের রাং বা অস্থি-মজ্জার মাংস দিয়ে রান্না করা হতো এই মশলাদার খাবার। এটির বিশেষত্ব হলো, এর মশলা— যাকে গুঁড়ো বা কোটি মসালা বলে। এই মশলা সাধারণত গোপন রাখা হয়। কারণ মশলার দ্বারাই নিহারির গুণ বিচার হয়। সারারাত মাংস, হাড়, মশলা ও ঝোল বিশাল ডেকচির মুখ বন্ধ করে ঢিমে আঁচে রান্না করা হয়। কিন্তু যখন ডিশটির স্বাদ নেবেন, তখন দেখবেন সব ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে। তাই অনেকদিন ধরে যদি কবজি ডুবিয়ে খাওয়া না হয়ে থাকে, তাহলে পেটকে প্রস্তুত করুন। কারণ এমন ঝাল ঝাল পাঁঠার মাংসকে গলাধঃকরণ করার জন্য পেটের জোর থাকা জরুরি। হাড়ের রস ঝোলে মেশে বলে এটি খেলে শরীর গরম থাকে। প্রত্যেক জায়গার মশলা আলাদা। কলকাতায় ব্রিটিশ আমলে ইংরেজরা এটি ডালপুরি দিয়ে খাওয়ার চল করেছিলেন। তবে কলকাতার মুসলিম সম্প্রদায় এটি একটি স্পেশাল তন্দুরি রুটি বা কুলচা দিয়ে খেতে পছন্দ করেন।

আজ আপনাদের সঙ্গে এই নিহারি-র রেসিপিই শেয়ার করব। গরু বা ভেড়ার মাংস দিয়ে না হলে মাটন দিয়ে তৈরি করুন এই জনপ্রিয় পদ। খেয়াল রাখবেন, এই পদ যত বেশি সময় নিয়ে রান্না করবেন ততই বাড়বে তার স্বাদ। তাই যাদের মোগলাই খাবার খুব প্রিয়, তাদের জন্য রইল নিহারি-র রেসিপি।

উপকরণ
১. পাঁঠার মাংস- ১ কেজি
২. সরষের তেল- বড় চামচের ২ চামচ
৩. জল- হাফ কাপ
৪. আদার পেস্ট- ১ চামচ
৫. রসুনের পেস্ট- ১ চামচ
৬. পেঁয়াজের পেস্ট- ১ চামচ
৭. দই- ৩ চামচ
৮. গোলাপ জল- ২ চামচ
৯. জাফরান- অল্প পরিমাণ দুধে ১০ মিনিট ভিজিয়ে রাখতে হবে
১০. ধনে পাতা- পরিমাণমতো
১১. দই- পরিমাণমতো ।

মশলা
১. এলাচ- ৪ টে
২. দারচিনি- ১ ইঞ্চি
৩. বড় এলাচ- ২ টো

ফোড়ন দিতে প্রয়োজন পরবে: ১. হলুদ গুঁড়ো- ১ চামচ, ২. ধনে গুঁড়ো- ১ চামচ, ৩. লঙ্কাগুঁড়ো- ১ চামচ, ৪. এলাচগুঁড়ো- হাফ চামচ ৫. নুন- পরিমাণমতো।

পদ্ধতি

১. কড়াইয়ে পরিমাণমতো সরষের তেল নিয়ে গরম করুন। তেলটা গরম হয়ে গেলে তাতে মশলাগুলি দিয়ে দিন।

২. কিছুক্ষণ নাড়ানোর পর তাতে মাংসটা দিয়ে কম করে ৬-৭ মিনিট নাড়তে থাকুন।

৩. এরপর পরিমাণমতো নুন এবং হলুদ মিশিয়ে ভাল করে নাড়ুন। এই সময় অল্প করে জল দিয়ে কড়াইটা চাপা দিয়ে দিন।

৪. যখন দেখবেন মাংসটা সেদ্ধ হতে শুরু করেছে, তখন আদা-রসুনের পেস্টটা মেশান। সঙ্গে ধনে পাউডার, লঙ্কাগুঁড়ো এবং পেঁয়াজের পেস্টটাও মেশান।

৫. এবার অল্প করে দই, গোলাপ জল, গরম মশলা, দারচিনি এবং জাফরান মেশানো দুধটা দিয়ে দিন।

৬. কড়াইটা এবার চাপা দিয়ে দিন, যাতে মাংসটা ভালোভাবে রান্না হতে পারে।

৭. ২-৩ মিনিট পরে মাংসটা বড় একটা কড়াইয়ে ঢেলে নিন।

৮. এবার কড়াইটা ঢাকা দিয়ে দিয়ে মুখটা আটা দিয়ে ভালো করে বন্ধ করে দিন। এই সময় আঁচটা ঢিমে করে দিতে ভুলবেন না।

৯. ২-৩ ঘণ্টা পর একবার দেখে নিন, মাংসটা ভালোরকম রান্না হয়েছে কি না। যদি দেখেন হয়ে গেছে, তাহলে তার ওপর অল্প করে ধনেপাতা ছড়িয়ে দিন।

১০. আপনার আওয়াধি খাস নিহারি তৈরি। এবার এই পদটি রুমালি রুটি অথবা বাটার নানের সঙ্গে পরিবেশন করুন। ইচ্ছে হলে ভাতের সঙ্গেও পরিবেশন করতে পারেন।

বাকরখানি

অন্যদিকে নিহারির মতো প্রাতরাশের সঙ্গে চাই বাকরখানি। নাম শুনেই ভিরমি খাবেন না। খেতে অতি সুস্বাদু এই খাবার। এটি একটি তন্দুরি রুটি, যা মিষ্টি বা নোনতা দু'-রকম ভাবেই বানানো যায়। এর জন্ম আমাদের বাংলায় হলেও, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অষ্টাদশ শতাব্দীর এক অমর প্রেমকাহিনি, যার অনেকটাই কিংবদন্তির মতো। মোগল আমলের প্রত্যেকটি খাবারের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে কোনও না কোনও কাহিনি।

উড়িষ্যার নায়েব ছিলেন দ্বিতীয় মুর্শিদকুলি খাঁ। তিনি পারস্য থেকে একটি ক্রীতদাস ছেলেকে নিয়ে আসেন, যার নাম ছিল আগা বাকর খান। খুব তাড়াতাড়ি বাকর খান তার বুদ্ধিমত্তার জন্য মুর্শিদ কুলির নেক-নজরে পড়ে, এবং মুর্শিদ তার পড়াশোনার ব্যবস্থা করেন। এরপর আগা খান রাজ্যশাসনের উপযুক্ত হয়ে উঠলে তিনি তাকে চট্টগ্রামের ফৌজদার হিসেবে নিযুক্ত করেন। এছাড়াও বহুদিন বাকলা চন্দ্রদ্বীপের শাসনকর্তা ছিল সে।

এই সময়েই তার পরিচয় হয় নর্তকী খানি বেগমের সাথে, এবং শুরু হয় তাদের প্রেমকাহিনি। কিন্তু এই সম্পর্কের প্রবল বিরোধী ছিলেন জয়নুল খাঁ, তৎকালীন এক প্রভাবশালী রাজসদস্যের পুত্র। বুঝতেই পারছেন, সেই চিরকালের ত্রিকোণ প্রেমের সমস্যা! এর পর নানা চক্রান্ত করে, বাবার মাধ্যমে জয়নুল রটিয়ে দেন যে, আগা খান হত্যা করেছেন জয়নুলকে। মুর্শিদকুলি তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন, ও বাঘের সঙ্গে এক খাঁচায় তাকে বন্দি করে দেওয়া হয়।

কিন্তু আগা খান ছিলেন প্রবল শক্তিশালী পুরুষ। শুধুমাত্র বাহুবলেই বাঘকে হত্যা করে, খাঁচা ভেঙে তিনি পালিয়ে যান। জয়নুল কিন্তু এর মধ্যে আবার ফিরে এসে, খানি বেগমকে জোর করে অপহরণ করে, চন্দ্রদ্বীপের জঙ্গলে পালিয়ে যান। আগা খান সেই খবর পেয়ে, হামলা করেন নিজের প্রেমিকাকে বাঁচানোর জন্য। সেই সময় খানি বেগমের মৃত্যু হয় জয়নুলের হাতে, আবার কারও কারও মতে, জঙ্গলে বিষধর সাপের কামড়ে। বাকর খানের কোলে মাথা রেখেই খানি বেগম মারা যান।

পরবর্তীকালে শোনা যায়, বাকর খান মুর্শিদকুলির এক মেয়েকে বিবাহ করেন। কিন্তু খানি বেগমকে তিনি কোনওদিন ভুলতে পারেননি। একদিন রান্না নিয়ে চর্চা করতে করতে, তিনি এই রুটি আবিষ্কার করে ফেলেন এবং খানি বেগমের ভালবাসার স্মৃতিতে এর নাম দেন ‘বাকরখানি’।

নবাবদের এই খাবার বাকরখানি; অতীতে ময়দার সঙ্গে দুধের মালাই ও মাখন মিশিয়ে তৈরি করা হতো। মালাই-মাখনের বাকরখানি এখন আর পাওয়া যায় না, বর্তমানে ময়দা দিয়ে গোলাকার কাঁচা রুটি তৈরি করা হয়। কাঁচা রুটির মাঝখানে ছুরি দিয়ে লম্বা করে তিনটি দাগ কেটে দেওয়া হয় এবং একপাশে জলের সামান্য প্রলেপ দিয়ে তন্দুরের দেওয়ালে লাগিয়ে দেওয়া হয়। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই তৈরি হয়ে যায় বাকরখানি। বাকরখানি সাধারণ রুটির তুলনায় যথেষ্ট মোটা এবং শক্ত।

অনেকে মনে করেন, বাকরখানি পুরনো ঢাকার খাবার, কিন্তু আজ তা ভারত, কুয়েত, সৌদি আরবেও পাওয়া যায়। তবে অনেকের ধারণা, বাকরখানি প্রথম শুরু হয় আফগানিস্তানে। তবে কলকাতাতে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে আজকের ফাস্ট ফুডের যুগেও এই বাকরখানির চাহিদা একটুও কমেনি। কলকাতায় একমাত্র জাকারিয়া স্ট্রিটেই এই বাকরখানি পাওয়া যায়। তাই আর দেরি না করে নিহারি দিয়ে বাকরখানি চেখেই দেখুন। আর ফিল করুন নবাবি আর রাজকীয় মেজাজ।

 

More Articles