২ টো পা নেই, নেই কোমর, বিশ্বকে যুদ্ধজয়ের নয়া আখ্যান শিখিয়েছেন এই খেলোয়াড়!

Athlete Zion Clark: ফুলে উঠছে তাঁর চওড়া ছাতি, হাতের মাংসপেশি, পেটের ওপর থাক থাক করে সাজানো সিক্স প্যাক, আর খোলা পিঠের মধ্যে জ্বলজ্বল করছে একটা কালচে রঙের ট্যাটু, যাতে জিওন ক্লার্ক লিখে রেখেছেন 'NO EXCUSE'...

মাতৃগর্ভে থাকাকালীন শিশুর যে যত্নের প্রয়োজন হয় তা কতটা গুরুত্বপূর্ণ বোঝা যায় আমেরিকার জিওন ক্লার্কের গল্প শুনলে। তার গর্ভধারিণী মা, জিওন পেটে থাকাকালীন সন্তানের কোনওরকম যত্ন তো নেননি, উল্টে দিনের পর দিন নিতে থাকেন বিভিন্ন ধরনের ড্রাগস। যার ফলাফল ভোগ করতে হয় জিওনকে। 'কডাল রিগ্রেসন সিনড্রোম' নামের এক দুর্লভ রোগের শিকার হন জিওন ক্লার্ক। কী এই রোগ? এই রোগে মানুষের কোমর থেকে নিচের দিকে বৃদ্ধি হয় না। অর্থাৎ, যার এই রোগ হয় তার জন্ম থেকেই কোমর এবং দুটো পা তৈরিই হয় না। জিওনেরও জন্ম থেকেই দুটো পা নেই, কোমর নেই, মানুষের শরীরের নিচের অংশে যা যা থাকা দরকার তার কিছুই নেই। জিওনের মা জিওনকে এই রূপে জন্মাতে দেখে জিওনকে আপনও করেননি। তিনি জিওনকে পাঠিয়ে দেন শিশুবিকাশ কেন্দ্রে। জীবনের ১৬ টা বছর জিওন সেখানেই কাটান। তাঁর অক্ষমতার জন্য তাঁকে কেউই নিজের করে নেয়নি। সারাটা ছোটবেলা জিওনের কেটেছে অত্যাচারে, অবহেলায়, অনাদরে, ঘৃণার শিকার হয়ে। অবশেষে জিওনকে দত্তক নেন কিম্বারলি হকিন্স নামের এক মহিলা, যিনি সারা জীবন এক সন্তানের খোঁজ করছিলেন। জিওনকে পেয়ে তার সেই খোঁজপূরণ হয় এবং ভালোবাসার চাতক হয়ে ঘুরতে ঘুরতে জিওনও অবশেষে এমন এক আশ্রয় পায় যেখান থেকে ম্যাজিক দেখাতে শুরু করেন তিনি।

কোন ম্যাজিক? উত্তরে হয়তো 'পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ম্যাজিক' বললে ভুল হবে না খুব একটা। জিওন যখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়তেন তখন থেকেই তাঁর অদম্য জেদ। শরীরের অর্ধেক না থাকার পরেও জিওন বিশ্বাস করতেন তিনি আর পাঁচটা মানুষের থেকে কম কিছু নন।  তাই ক্লাস টু'তে পড়াকালীনই স্কুলে তিনি ভর্তি হলেন কুস্তিতে। বছরের পর বছর ধরে কুস্তির প্রতিটা ম্যাচে জিওন হারতে থাকেন। স্কুলে বন্ধুদের অত্যাচারের শিকার হতে থাকেন, লকারে বন্ধ করে দেওয়া হতো তাঁকে, মারধোর করা হতো নির্মমভাবে। কিন্তু, জিওনের ছোট্ট থেকেই দুটো পা না থাকলেও ছিল অদম্য জেদ। পায়ের বদলে পেয়েছিলেন দৃঢ়তা, প্রতিজ্ঞাবদ্ধতা এবং লক্ষ্যে পৌঁছানোর খিদে। সব অত্যাচার সহ্য করে জিওন তাকে নিজের জেদে পরিণত করতে থাকলেন এবং একদিন কুস্তির ম্যাচ জিততে শুরু করলেন। যেদিন থেকে জিততে শুরু করলেন তারপর থেকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি জিওনকে। রাজ্যস্তরে  নিজের শ্রেণির সেরা খেলোয়াড় হিসাবে গণ্য হন জিওন এখন। 

কথায় বলে, যে মানুষ অবহেলা, জেদ, আর চেষ্টার খড় মাটি দিয়ে গড়া তাঁকে ভাঙা সহজ কাজ নয়। জিওন ক্লার্ক নিজের ইঞ্চি ইঞ্চি গড়ে তুলেছেন অবিশ্বাস্য জেদ আর উত্তর দেওয়ার স্পর্ধা দিয়ে। তাঁর বক্তব্যে, "আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই তাঁদের যারা এককালে আমাকে অত্যাচার করতো, 'বুলি' করতো, অত্যাচার করতো, অপমান করতো। তাঁদের ছাড়া আমার ভিতরে এই জেদ, এই কিছু করে দেখানোর ইচ্ছা তৈরি হতো না"।

জিওন এখন একজন জনপ্রিয় মোটিভেশনাল স্পিকার, ব্যবসায়ী, অভিনেতা, লেখক, কুস্তিবিদ এবং গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের অধিকারী। শেষেরটা শুনে একটু চমকে উঠলেন? গিনেস বুকে জিওনের নাম কী করে এল? সাম্প্রতিককালে জিওন গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস দ্বারা আয়োজিত 'হাতে ভর দিয়ে দ্রুততম ২০ মিটার হাঁটা' বিভাগে বিশ্বরেকর্ড করার চেষ্টা করেন। তাঁর কোচ বাচ রেনল্ডস, যিনি নিজে একজন অলিম্পিক স্বর্ণ পদকজয়ী এবং গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের অধিকারী, তিনি জিওনকে প্রশিক্ষণ দেন। মাসের পর মাস ধরে জিওন নিজেকে তৈরি করেন এই বিশ্ব রেকর্ড গড়ে তোলার জন্য। অবশেষে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। কিছুক্ষণের ওয়ার্ম আপের পর জিওন উপস্থিত হন স্টার্টিং লাইনের সামনে। বাঁশি বেজে ওঠার পর ধনুক থেকে বেরনো তিরের মতো দু'হাতে ভর দিতে দিতে এগিয়ে যান জিওন নিজ লক্ষ্যে। ২০ মিটারের দূরত্ব হাতে ভর দিয়ে পার করতে জিওন ক্লার্ক সময় নেন মাত্র ৪.৭৮ সেকেন্ড। যা দুটো পা থাকা মানুষের জন্যও সহজ নয় খুব একটা। তৈরি হয় বিশ্বরেকর্ড। গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের পাতায় নাম ছেপে যায় ছোটবেলা থেকে অবহেলিত, লাঞ্ছিত, পা না থাকা একজন 'প্রতিবন্ধী' মানুষের, যিনি নিজেকে কারও থেকে পিছিয়ে পড়া মনেই করেন না।

রাস্তায় আকছার কত মানুষের দেখা মেলে, যাদের হাতের আঙুল নেই, হয়তো একটা হাত নেই কিংবা একটা পা দুর্বল অথবা শরীরের সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ঠিক থাকা সত্ত্বেও মানুষকে ভিক্ষা করতে। "ভিক্ষা কেন করছো?", জিজ্ঞেস করলে প্রত্যুত্তরে শোনা যায়, "ভগবান আমাকে পঙ্গু করে জন্ম দিয়েছে, কী করে খাব?" জিওন ক্লার্ক প্রতিবন্ধকতাকে আক্ষরিক অর্থেই 'বিশেষভাবে সক্ষম' করে তুলেছেন। একজন 'আইডল' হয়ে থাকতে চেয়েছেন। তিনি চেয়েছেন যেন তাঁর দিকে তাকিয়ে শক্তি পান তাঁরই মতো মানুষেরা। যেন তাঁরা নিজেকে দুর্বল না ভাবেন। যেন তাঁরা কারও কাছে হাত পেতে বেঁচে না থাকেন। জিওন ক্লার্ককে ভবিষ্যতের লক্ষ্যের কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন,

"আমি অলিম্পিকে যেতে চাই, আমি প্যারাঅলিম্পিকে যেতে চাই। আমি মাইকেল ফেলপসের থেকে বেশি স্বর্ণপদক জিততে চাই অলিম্পিকসে, গোটা পৃথিবীকে নিজেকে চেনাতে চাই আমি"।

গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে তাঁর সাক্ষাৎকার দেখতে দেখতে, গায়ে কাঁটা দেয় তার জীবনের কাহিনি তাঁর নিজের মুখে শুনতে শুনতে, তাঁর যন্ত্রণার কথা জানতে জানতে। গায়ে কাঁটা দেয় যখন দেখি কোমর-বিহীন, দুটো পা-বিহীন এইটুকু ছোট্ট উচ্চতার মানুষ জিমের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি নিয়ে শরীরের কসরত করছেন রোজ দু'বেলা। ফুলে উঠছে তাঁর চওড়া ছাতি, হাতের মাংসপেশি, পেটের ওপর থাক থাক করে সাজানো সিক্স প্যাক, আর খোলা পিঠের মধ্যে জ্বলজ্বল করছে একটা কালচে রঙের ট্যাটু, যাতে জিওন ক্লার্ক লিখে রেখেছেন 'NO EXCUSE'...

জিওন ক্লার্ক একজন অনুপ্রেরণার নাম, লড়াইয়ের নাম, হার না মানা এক সৈনিকের নাম, শরশয্যায় শুয়েও বিপক্ষ শিবিরের ত্রাসের নাম জিওন ক্লার্ক। এই পৃথিবীতে জিওন ক্লার্কদের সংখ্যা বাড়তে থাকুক!

 

More Articles