উত্তমের সঙ্গে দারুণ ভাব, অথচ সুচিত্রাকে চলতেন এড়িয়ে, অনুপ কুমারকে কি ভুলেছে বাঙালি?

Anup Kumar : মাসিক কুড়ি টাকা বেতনে অনুপকুমার যুক্ত হলেন পেশাদার রঙ্গমঞ্চে

১৯৯৮-র ৩ সেপ্টেম্বর চলে গেলেন স্বনামধন্য অভিনেতা অনুপ কুমার অথচ তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হলো না স্টুডিও পাড়ায়। সেই ৮ বছর বয়স থেকে যে পাড়ায় তাঁর ধ্যানজ্ঞান, মৃত্যুতে কেন মুখ ফেরালেন সেখান থেকে, তার উত্তর অবশ্য আজও অধরা। তবে মৃত্যুর পর স্টুডিও পাড়ায় না নিয়ে যাওয়ার এই সিদ্ধান্ত স্বয়ং অনুপ কুমারই নির্ধারণ করে গিয়েছিলেন। বাকিরা কেবল তাঁর আজ্ঞাবহ। অভিনয় জগৎ তাঁকে বেঁধে রাখতে চেয়েছে কৌতুক অভিনেতার গন্ডিতে, অনুপ কুমারও তাতে তাতে থেকেছেন সাবলীল। কিন্তু মাঝে মাঝেই দানার ঝাপটে বুঝিয়ে দিয়েছেন শিল্পী অনুপের কোনও গন্ডি হয়না। তাঁর অভিনয়ের দৌড় গগনচুম্বী। নায়ক, প্রতিনায়ক, কৌতুক অভিনেতা অথবা নিছক পার্শ্ব চরিত্র সবেতেই সমান দক্ষ তিনি।

পর্দায় দাপুটে বিচরণের এই মানুষটি সিনেমা পাড়ার প্রকৃত বন্ধু। যার যখন যে কোনো বিপদে পাশে থেকেছেন অনুদা। অভিনেত্রী গীতা দে’র মেয়ের অ্যাপেনডিক্স অপারেশন থেকে শুরু করে অভিনেতা শমিত ভঞ্জের মেয়ের অন্নপ্রাশন, যখন যেখানে বিপদ আসন্ন, তখনই হাজির অনুপ কুমার। এমনকী অজিত গাঙ্গুলি যেদিন মান্না দে কে দিয়ে গান রেকর্ড করিয়ে পেমেন্ট করতে পারছিলেন না, সে দিনও এগিয়ে এসেছিলেন ইন্ডাস্ট্রির এই বেঁটেখাটো লোকটিই। অথচ এই এত কিছু করেও আজীবন থেকেছেন নেপথ্যে, যেন প্রচারবিমুখ থাকাটাই দস্তুর।

বাংলা চলচ্চিত্রে অনুপকুমারের অবাধ বিচরণ ১৯৩৮ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত। মাত্র আট বছর বয়সে শিশু অভিনেতা হিসাবে প্রথম কাজ দাদাসাহেব ফালকে এবং পদ্মভূষণ পুরস্কারপ্রাপ্ত পরিচালক ধীরেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলির ‘হালখাতা’ ছবিতে। যাত্রা সেই শুরু, তারপর আর থেমে থাকেননি অনুপ। বেশিরভাগ ছবিতেই তাঁকে পার্শ্বচরিত্রাভিনেতা হিসাবেই দেখা গেছে। এরই মাঝে মাঝে আবার কখনও ছিটকে বেরিয়ে এসেছেন পরিচিত মোড়ক থেকে। হঠাৎই ধরা দিয়েছেন দাপুটে ভূমিকায়। জাত চিনিয়ে দিয়েছেন অচিরেই।

আরও পড়ুন - স্টিয়ারিং বুকে লেগে স্পট ডেথ— সিনেমায় আর ফেরা হয়নি ছবি বিশ্বাসের

পার্শ্ব অভিনেতা বলেই তিনি জানতেন ক্যামেরার একপাশে নিজেকে কিভাবে সযত্নে সরিয়ে রেখেও শিল্প বুনতে হয়। আর এই কাজটিই করে গিয়েছেন প্রতিটি চরিত্রে। সাংসারিক অর্থাভাবে একদিন অভিনয়কে অস্ত্র করেছিলেন অনুপ কুমার। তাই কোনও চরিত্রই ফিরিয়ে দেননি তিনি। নায়ক হওয়ার বাসনা যে ছিল না এমনটা তো নয়, কিন্তু ভাগ্য সায় দেয়নি। তাই কমেডিয়ান হিসেবেই একের পর এক চরিত্র বেছে নিয়েছেন। সেখানে অবশ্য নিজেকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন সর্বাগ্রে। অনুপকুমার নিজে মনে করতেন, তরুণ মজুমদারের ‘বরযাত্রী’ ছবিটিই তাঁকে প্রথম কমেডিয়ানের তকমা দিয়েছিল। অবশ্য পরের পর কৌতুক চরিত্র করতে করতে হাঁপিয়ে ওঠা অনুপকে তরুণ মজুমদার বুঝতে পেরেছিলেন নিশ্চয়ই। তাই তিনিই আবার দর্শকের সামনে ফিরিয়ে আনলেন অন্য অনুপকে। তরুণ মজুমদারের ‘পলাতক’, ‘ঠগিনী’, ‘নিমন্ত্রণ’– তিনটি ছবিতেই অনবদ্য নায়ক অনুপ কুমার। রাজেন তরফদার, মৃণাল সেন, অজয় কর, তপন সিনহা, চিত্ত বসু, দীনেন গুপ্ত প্রমুখের সঙ্গে একের পর এক কাজ করে গেছেন অভিনেতা। তবে চলচ্চিত্রে খ্যাতি অর্জন করলেও অনুপকুমার মনেপ্রাণে একজন থিয়েটারকর্মী।

সংসার থেকে সিনেমাপাড়া দায়িত্বে অনড় অভিনেতা। ছোট বোনদের নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিয়েছেন। সব শেষে নিজে বিয়ে করেছেন অভিনেত্রী অলোকা গাঙ্গুলিকে। বাবা-মায়ের দেওয়া নাম সত্যেন দাস। চলচ্চিত্র জগতে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর নাম পাল্টে করা হল অনুপকুমার। বাবা রঙ্গমঞ্চের বিখ্যাত গায়ক ও সুরকার ছিলেন। অনুপকুমারকে মাত্র বারো বছর বয়সে স্টার থিয়েটারে মহেন্দ্র গুপ্তের কাছে নিয়ে যান বাবা। সেখানেই মাসিক কুড়ি টাকা বেতনে পেশাদার রঙ্গমঞ্চের সঙ্গে যুক্ত হন অনুপকুমার। এরপর শ্রীরঙ্গম, বিশ্বরূপা, কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চে চুটিয়ে অভিনয় করতে লাগলেন বেশ কিছুদিন। অবশেষে জায়গা থিয়েটার জগতে আরও খানিকটা পাকা করতে ১৯৭৬ সালে কলেজ স্কোয়ারের ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হল ভাড়া নিয়ে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘নূরজাহান’ নাটকটি মঞ্চস্থ করলেন অনুপকুমার। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মঞ্চে আগুন লেগে তাঁর সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হল সেবার।

ধাক্কা খেলেন তখনকার নাট্যমঞ্চের রাজা অনুপকুমার। কিন্তু থেমে থাকলেন না। মূলত পেশাদারী মঞ্চে তিনি অভিনয় করতেন। ‘শ্যামলী’, ‘হঠাৎ নবাব’, ‘ছদ্মবেশী মল্লিকা’, ‘অঘটন’, ‘জয় মা কালী বোর্ডিং’, ‘রাম শ্যাম যদু’, ‘শ্রীমতী ভয়ংকরী’, শেষ পর্বে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘চন্দনপুরের চোর’ নাটকে কাজ করেন একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে। প্রায় পঞ্চাশের উপর প্রযোজনায় তিনি কাজ করেছেন। ১৯৮৮ সালে পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি নাট্যক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য তাঁকে পুরস্কৃত করা হয়। দীনবন্ধু পুরস্কারে সম্মানিত হন ১৯৯৬ সালে ও প্রবীণ নাট্যব্যক্তিত্ব হিসেবে সংবর্ধিত হন ১৯৯৭ সালে।

অনুপকুমারের চলচ্চিত্রে ইতিহাস তৈরি করার কথা জানা আছে সকলেরই। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ ছবিতে চুটিয়ে কাজ করে গেছেন। যাত্রিকের ‘পলাতক’ ছবিতে তিনি বোহেমিয়ান। এমন এক বাঙালি চরিত্র, যার ঘরে মন টেকে না। চারদিক অস্থির। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে আর অনুপকুমারের লিপে ‘জীবনপুরের পথিক রে ভাই’ আজও অমর হয়ে আছে। এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে ঘুরে বেড়ানো এবং অভিজ্ঞতা সংগ্রহের দুর্দান্ত কাজটি তুলে ধরেছিলেন জীবন্তভাবে।

এরপর তরুণ মজুমদারের ছবি ‘দাদার কীর্তি’-তে অনুপকুমার হলেন ভোম্বলদা। সে ছবিটিকে আদ্যোপান্ত বেঁধে রাখলেন তিনিই। ছবির শুরুতে যে কৌতুক অভিনেতা চরিত্র হিসেবে তিনি আত্মপ্রকাশ করলেন তা ছবির সঙ্গে পরতে পরতে উত্তীর্ণ করে নিয়ে গেলেন বলিষ্ঠ এক মেন্টর রূপে। তাই তাপস পালকে শিক্ষার ক্ষমতা বিকাশের জন্য দিনের গরমে মাঠে দৌড়াতে আর রাত্রে ঠান্ডা জলে সাঁতার কাটতে বলার দৃশ্য যেন অচিরেই চাপিয়ে যায় ছবি শেষে মহুয়াকে লেখা চিঠিতে।

‘পথে হল দেরি’ থেকে ‘সাগরিকা’, ‘অগ্নি পরিচয়’ থেকে ‘রাজদ্রোহী’ — উত্তমকুমারের সঙ্গে প্রায় পঞ্চাশটির উপর ছবিতে অভিনয় করেছিলেন অনুপ। তারপর থেকে কৌতুক চরিত্রাভিনেতা হিসেবে খ্যাতি পৌঁছে গিয়েছিল তুঙ্গে। অবশ্য সুচিত্রা সেনের প্রসঙ্গে নিজেকে কেবলই গুটিয়ে নিতেন তিনি। মেপে মেলে দূরত্ব রাখতেন। তার কারণটা অবশ্য খুবই অন্যরকম। অনুপ কুমার ছিলেন একেবারেই ছাপোষা লাজুক মধ্যবিত্ত বাঙালি। মিসেস সেনের আদি রসাত্মক কৌতুকের সঙ্গে ঠিক এঁটে উঠতে না পেরে পালিয়ে বাঁচতেন আরকি! অথচ এহেন অনুপ কুমারই আবার ভানু, জহরদের সামনে অন্য ভূমিকায়। মদ্যপানের বিরোধিতা করে প্রায়শই শিক্ষা দিতেন তাঁদের। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তাই অনুপ কুমারের এই অভিবাবকের ভূমিকার জন্য তাঁকে ‘জেঠু’ নাম দেন। পরে অবশ্য গোটা ইন্ডাস্ট্রিই জেঠু নামে ডাকতেন অনুদাকে।

আরও পড়ুন - গায়ে আঁটত না ‘বড়দের’ জামা! রবি ঘোষ যেভাবে রয়ে গেলেন বাঙালির মনে

পলাতক’, ‘ঠগিনী’, ‘নিমন্ত্রণ’ ছবি তিনটির হাত ধরে বাংলা ছবির দর্শক যে অনুপ কুমারকে পেয়েছিলেন, তাঁরও একজন মানানসই নায়িকা ছিল। অনুপ কুমার, সন্ধ্যা রায়ের জুটিও ক্রমেই জনপ্রিয়তা পায়। তাই নায়ক চরিত্রকে ধরে রাখতে চাইলে হয়তো তিনিও পারতেন, কেবল সাংসারিক দায়ভার সেটা রাখতে দিল না। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে অনুপের কাছে নায়ক হিসেবে ধরে রাখার থেকেও বড়ো হয়ে দাঁড়াল রোজগারটুকুই। অতএব, ভেঙে গেল জুটি।

‘বসন্ত বিলাপ’ থেকে ‘দাদার কীর্তি’ কিংবা ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’, ‘ফুলেশ্বরী’, ‘নিমন্ত্রণ’, ‘আলোর পিপাসা’, ‘বালিকা বধূ’ – অনুপকুমারের মুকুটে যেন এক একটি স্বর্ণখচিত পালক। তবে বাংলা সিনেমাতেই থেমে থাকেননি তিনি, নিজেকে নিয়ে গিয়েছেন বলিউডের দরজাতেও। ‘সব্যসাচী’, ‘চন্দ্রশেখর’, ‘কিতনে পাশ কিতনে দূর’, ‘মহাশয়’ সহ মোট ছয়টি হিন্দি ছবিতে অনবদ্য অভিনয়ের দৃষ্টান্ত রেখেছেন অনুপ কুমার।

নাটকের পাশাপাশি সিনেমা জগৎও ফেরাননি যোগ্য অভিনেতাকে। ১৯৬৪ সালে ‘পলাতক’ ছবির জন্য পান বি এফ জে এ পুরস্কার। এরপর ১৯৭১ সালে ‘নিমন্ত্রণ’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত হন অনুপ কুমার। এ ছাড়া ১৯৯৬ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে ‘দীনবন্ধু পুরস্কার’ -এ সম্মানিত করা হয় স্বনামধন্য অভিনেতাকে।

আজ কি তাঁকে বাঙালি ভুলতে বসেছে? যোগ্য কদর কি করছে আজকের সিনেমা জগৎ? নাকি আধুনিকতার বেড়াজালে আটকে পড়ে অতীতচারিতা ফিকে মনে হয়! যদিও তাতে কিচ্ছুটি এসে যায় না অনুপ কুমারের মতো একজন জাত অভিনেতার। তিনি আজীবন থেকে যাবেন অন্তরে। একজন ‘পলাতক’-এর ভূমিকায় নয় বরং ‘ভোম্বলদা’র মতো কোনও মেন্টর হয়েই।

More Articles