তাঁর হাতেই তৈরি জাতীয় পতাকার নকশা, তবু শেষ জীবন কেটেছিল চরম দারিদ্রে

এই বিরাট কাজ নীরবে করে গিয়েছিলেন গান্ধীবাদী মানুষটি। জাতীয় পতাকার কোনও কৃতিত্বই নিতে চাননি‌। ফলে শেষ জীবন তাঁর খুব একটা সুখের হয়নি।

প্রতিটি জাতির একটি জাতীয় পতাকা প্রয়োজন। লক্ষ লক্ষ মানুষ এই পতাকার জন্য রক্ত দিয়েছেন। এই পূজার মূল্য না দেওয়া পাপ। ইউনিয়ন জ্যাক ইংরেজদের বুকে যে আবেগ, শক্তি জাগিয়ে তোলে তা অমূল্য, অতুলনীয়। আমেরিকানদের কাছে তাদের পতাকার মূল্য অসীম। আবার ইসলামের সাহস তাদের নিশানের সামনে শতগুণ বেড়ে যায়।

—মহাত্মা গান্ধী

 

জাতীয় পতাকা জাতির চিহ্ন। জাতির পরিচয়। স্বাধীন জাতি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠার তাগিদ যখন অনুভব করল ভারত, সেই জাতীয়তাবাদকে মূর্তরূপ দেওয়ার জন্য প্রয়োজন হল জাতীয় পতাকার। বিশ্বের মোটামুটি সব দেশেরই নিজস্ব জাতীয় পতাকা রয়েছে। তবে ভারতের তিরঙ্গার যিনি জন্ম দিয়েছিলেন, তাঁকে একেবারেই মনে রাখেনি ভারত। পিঙ্গলি ভেঙ্কাইয়া। প্রথম তিরঙ্গা তিনি তৈরি করেছিলেন তিরিশটি দেশের জাতীয় পতাকা খুঁটিয়ে দেখে। তৈরি করেছিলেন অনেকগুলি নকশা। অথচ সেই প্রচণ্ড পরিশ্রম যথাযথ মূল্য পায়নি কালের নিরিখে। কেবল ফসল নিয়েই মাতামাতি বর্তমানের, সেই মাতামাতির গহিনে একলা অর্থকষ্টে তিলে তিলে শেষ হয়ে গিয়েছে চাষি। তাঁকে নিয়ে তেমন মাথাব্যথাও নেই কারও।

এদেশে পতাকার ইতিহাস কম দিনের না। নানা জনজাতি থেকে কৌম, ধর্মীয় হোক, রাজনৈতিক হোক- বিভিন্ন ধরনের নিশান ব্যবহার করেছেন প্রায় প্রত্যেকেই। আঞ্চলিক অধিকর্তা থেকে রাজা-উজির, সবার নিজস্ব নিশান ছিল। কিন্তু একক জাতিসত্তা না থাকায় ছিল না কোনো জাতীয় পতাকা। ১৯০৯ সালে টাইমস পত্রিকায় লিখেছিলেন লর্ড অ্যাম্পটহিল, ভারতের কোনও ভারতীয় পতাকা নেই। জাতীয় পতাকা গড়েই ওঠেনি এদেশে। দেখে তিনি খানিক আশ্চর্যই হয়েছিলেন। অবশ্য এই বিস্ময়বোধ যে অনেকখানি নেতিবাচক, তা বোঝাই যায়। মূলত ভারতকে হেয় করার চেষ্টা থেকেই লেখা প্রতিবেদনটি। কিন্তু এই অভাববোধ জাতীয়তাবাদীরাও অনুভব করছিলেন। সেটা স্বাভাবিক। জাতীয়তাবাদ ব্যাপারটাই মূলগতভাবে অভাববোধ থেকে দানা বাঁধে। এ-গলি ও-গলি আলোচনা চলছিল। চলছিল চেষ্টাচরিত্রও।

আরও পড়ুন: হাওড়ার টালিছাওয়া ঘর থেকে সোনা জেতা: অচিন্ত্য শিউলি মনে করাচ্ছেন গোবর গুহ, ভীম ভবানীদের

 

১৯১৬ নাগাদ এই ভাবনাচিন্তা, আলোড়নকে নিজের কাজে মূর্ত করে তুললেন পিঙ্গলি। কথার থেকে বেশি হাতে-কলমে কাজে বিশ্বাস ছিল তাঁর। তিরিশটি নকশা এঁকে একটি বই ছাপলেন। মুহূর্তে বইয়ের নকশাগুলি আলোচনার লক্ষ‍্যবস্তু হয়ে দাঁড়াল। বারংবার ঘুরিয়েফিরিয়ে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলল দীর্ঘদিন। ১৯২১ নাগাদ সেই আলোচনা মোটামুটি একটা রূপ পেল। গান্ধীজির নির্দেশে পিঙ্গলি আঁকলেন ভারতের প্রথম জাতীয় পতাকার নকশা। নাম হলো স্বরাজ পতাকা। গেরুয়া এবং সবুজ হয়ে উঠল ভারতের সবথেকে বড় দুই ধর্মীয় কৌম হিন্দু এবং মুসলিমদের প্রতীক। মাঝে সাদা। তার ঠিক মাঝখানটিতে বসানো হলো চরকা। স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম প্রতীক। এই প্রথম ভারতের স্বরাজ আন্দোলন একটি নিজস্ব পতাকা পেল। অনুপ্রেরিত হয়ে উঠল মধ্যবিত্তর জাতীয়তাবাদ, মূর্ত রূপে উপাসনার পথ আরও প্রশস্ত হলো তাদের।

আজ থেকে প্রায় দেড় শতক আগে অন্ধ্রপ্রদেশের মাছিলিপতনমের কাছে ভাটলাপেনুমারুতে জন্ম পিঙ্গলির। চাষবাস করতেন। করতেন শিক্ষকতাও। জাপানি এবং উর্দু বলতে পারতেন জলের মতো। কম বয়সে ব্রিটিশ আর্মির হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় লড়াই করেছেন। সেসময় তাঁর জীবনে দু'টি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। প্রথমত, ইউনিয়ন জ্যাক এবং ব্রিটিশ সেনাদের সম্পর্কটি খুঁটিয়ে দেখার সুযোগ পান ভদ্রলোক। ফলে জাতীয় পতাকার ব্যাপারটা তাঁর মাথায় আসে। দ্বিতীয়ত, আফ্রিকাতেই গান্ধীজির সঙ্গে আলাপ হয় তরুণ পিঙ্গলির। সেই আলাপের সূত্রেই গান্ধীজি নিজের হাতে পতাকার নকশা বেছে দেন তাঁকে। শুরু হয় এক নতুন যুগ।

জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডর পর, শহিদ স্মরণে প্রথম স্বরাজ পতাকা উত্তোলন করা হলো। সালটা ১৯২৩। ধীরে ধীরে এই নিশানের সঙ্গে পরিচিত হলো ভারত। প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ। সাধারণের কাছে সেসময় একটিমাত্র পতাকাকে জাতীয় পতাকা হিসেবে তুলে ধরা খুব একটা সহজ ছিল না। ছিল না উন্নত প্রযুক্তি। হাতে-কলমে পতাকা বিতরণ, নানা মিছিল-মিটিং-এ পতাকা ব্যবহার করে পরিচিতি তৈরি করতে হতো। তাও বহুলাংশে আপামর নিম্নবর্গ এই পতাকা চিনতেন না, একাত্মও হতে পারেননি সব ক্ষেত্রে। যাই হোক, প্রবল টালমাটাল অবস্থায় ১৯৪৭-এ ভারত স্বাধীন হলো। স্বরাজ পতাকায় কিছু পরিবর্তন আনা হলো। সাধারণত মানুষের ধারণা গান্ধী এবং নেহরু-ই এই পরিবর্তন করেছিলেন। আদতে নকশায় অদলবদলের বুদ্ধি পিঙ্গলির একান্ত নিজস্ব। চরকা সরিয়ে সেই জায়গায় অশোকচক্রের প্রবর্তন করেন তিনিই। ১৫ আগস্ট উত্তোলিত হলো সেই নিশান। লক্ষ লক্ষ ভারতবাসী গর্বের সঙ্গে দেখল নিজেদের জাতীয় পতাকা।

এই বিরাট কাজ নীরবে করে গিয়েছিলেন গান্ধীবাদী মানুষটি। জাতীয় পতাকার কোনও কৃতিত্বই নিতে চাননি‌। ফলে শেষ জীবন তাঁর খুব একটা সুখের হয়নি। অপরিসীম দারিদ্রের মধ্যে দিন কাটিয়েছেন। কেউ তাঁকে চিনত না। জাতি গঠনের অন্যতম বুনিয়াদ যিনি গড়ে দিলেন, অচিরেই তাঁকে বিস্মৃত হলো সেই জাতিই। বিজয়বড়ায় একটি কুঁড়েঘরে থাকতেন পিঙ্গলি। ধুঁকতে ধুঁকতে সম্পূর্ণ বিস্মৃত অবস্থায় সেখানেই মারা যান ১৯৬৩ নাগাদ। কেউ খেয়াল করল না। ২০০৯ সালে এই স্বাধীনতা সংগ্রামীর নামে একটি ডাকটিকিট চালু করে সরকার। মানুষ আজও তাঁকে চেনে না। অন্ধ্র আর্ট অ্যাকাডেমির সভাপতি জি নারায়ণ রাও দুঃখ করেছিলেন, কোনও সরকারই মানুষটাকে প্রাপ্য সম্মান দিল না। কেবল বিজয়বড়া স্টেশনে ভারতীয় রেল তাঁর একটি মূর্তি গড়ে দিয়েছে‌, এইমাত্র। অগাস্ট স্বাধীনতার মাস। সেই মাসেই জন্মেছিলেন পিঙ্গলি ভেঙ্কাইয়া। ২ আগস্ট তাঁর জন্মদিনে তাঁর অবদানকে কুর্নিশ জানানো যাক।

 

 

 

More Articles