মৃত্যুর অধিকারঃ শান্তিতে ঘুমোন র‍্যামোন

'কেন জানি না মনে হয়, ওপারে কিছুই নেই। মৃত্যুর পরে কিছু থাকে না। আমাদের জন্মের আগের জীবনটা যেমন। কিছুই নেই। শূন্য। ব্ল্যাঙ্ক।'

'কী করে নিশ্চিত হচ্ছ তুমি এতটা?'

'নিশ্চিত তো নই। মনে হচ্ছে। এই যেমন বাবা রাতে খাবার টেবিলে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে বলেন, কাল বৃষ্টি হবে, আর বৃষ্টি হয়। তেমনই। একটি ফিলিং...'

দ্য সি ইনসাইড। অ্যালেজান্দ্রো অ্যামেনাবার পরিচালিত ২০১৪ সালের বিখ্যাত একটি স্পেনিয় ছবি। এক পক্ষাঘাতগ্রস্ত অসম্ভব ম্যাজিকাল এক মানুষের চরিত্রে ‘নো কান্ট্রি ফর ওল্ড ম্যান’ খ্যাত কুখ্যাত খুনে সাইকোপ্যাথের চরিত্রের অভিনেতা জেভিয়ার বার্ডেম। আর, ‘দ্য সি ইনসাইড’ চরিত্রের নাম? হ্যাঁ, যাঁরা দেখেছেন ছবিটি তাঁদের ঠোঁটে এসে গেছে এতক্ষণে। র‍্যামোন সামপেদ্রো। নামটি ভোলা সম্ভব না। কারণ, র‍্যামোন স্রেফ একটি চরিত্র না। সত্যি, ক্রুড রিয়েল বাস্তব থেকে উঠে স্পেনের জলজ্যান্ত গ্যালিসিয়া প্রদেশের এক কিংবদন্তী। কীভাবে শুরু করব র‍্যামোনের গল্প? জীবন-মৃত্যু এবং তার মাঝের দোলাচল?  লড়াই?

টাইম ম্যাগাজিনের সাংবাদিক রড উসারের লেখায় ‘Ramon Sampedro was a live head on a dead body’। তরতাজা যুবক র‍্যামোন পেশায় সেইলার হওয়ায় তীব্রভাবে ভালোবেসেছিলেন সমুদ্রকে। ১৯৬৮। ২৩ আগস্ট। গ্যালিসিয়ার আটলান্টিক সাগর। উঁচু একটি ক্লিফ থেকে নিচে ডাইভিং দিতে গিয়ে টাইমিং-এ ভুল করে ফেলেন ২৫ বছরের র‍্যামোন। মাথা গিয়ে লাগে অগভীর সমুদ্রতলে। ঘাড়ে চোট। তৎক্ষণাৎ পক্ষাঘাত। র‍্যামোন চেতনায় আছেন, অথচ নিজেকে বাঁচাতে পারছেন না। তলিয়ে যাচ্ছেন। জীবন মৃত্যুর হাইফেনে গিয়ে কোনও এক বন্ধু তাঁকে টেনে ওপরে তোলেন। আঘাত ঘাড় থেকে মুহূর্তেই চলে আসে স্পাইনাল কর্ডে। পরিণামে ঘাড়ের নিচ থেকে শরীরের বাকিটা অংশ নড়াচড়ায় আজন্ম অক্ষমতা। চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় টেট্রাপ্লেজিয়া বা কোয়াড্রিপ্লেজিয়া। র‍্যামোনের নিজের কথায় – ‘I am a head attached to a corpse’। ডাক্তারের ভার্ডিক্ট। ‘This is the way you’ll stay’। কতদিন? ১৯৯৮। ৮৭ বছরের বৃদ্ধ পিতা জোয়াকিন। একটি ওয়াকিং স্টিক নিয়ে হাঁটা বৃদ্ধের তাঁর কনিষ্ঠ পুত্রের দিকে তাকিয়ে গ্যালিসিয়ান ডায়ালেক্টে সলিলোকি – ‘There are two sides of it. I respect his wishes. But …’ বৃদ্ধ শেষ করতে পারেন না। খসে পড়া তারার মতো জল তাঁর ভাঁজ পড়ে আসা চোখ ঝাপসা করে। ‘দ্য সি ইনসাইড’-এ বৃদ্ধ চরিত্রটি যেমন বলেন –‘There’s only one thing worse than the death of a son, and that is he wanting to die’। আর কে? দাদা ৫৭ বছরের লুইস। খিটখিটে অথচ ভেতরে ভেতরে কাঁদা এক মাঝবয়সী। ছবিতে যাঁর সঙ্গে র‍্যামোনের বিখ্যাত সেই কথোপকথন। ‘Freedom without life is not a freedom’ – লুইসের স্টেটমেন্টের উত্তরে র‍্যামোন বলছেন – ‘and life without freedom is not a life too’। অথবা ভাইপো তরুণ জেভিয়ার। এবং ম্যানুয়েলা। ২৫ বছর ধরে নার্স হিসেবে কাজ করে আসা লুইসের স্ত্রী র‍্যামোনের সিস্টার ইন-ল ম্যানুয়েলা। নাকি মা? ম্যানুয়েলা তাই মনে করতেন। শিশুর মতো দেখতেন র‍্যামোনকে। যত্ন করতেন। নিঃস্বার্থ এক সেবা।

কিন্তু সমুদ্রকে তীব্র ভালোবাসা এক নাবিক কীভাবে সমুদ্রের স্রোত আসার সময়জ্ঞানে ভুল করেন? ‘দ্য সি ইনসাইড’-এর র‍্যামোন বলছেন ‘I was distracted’। কেন? কীসের কথা ভাবছিলেন? কার কথা? অরিতা? র‍্যামোনের প্রেম। দুজন সে দিনেও বিয়ের কথা ভেবেছিলেন। এমনকি পরেও। টেট্রাপ্লেজিক প্রেমিকের আজীবন দেখভালের স্বপ্ন দেখেছিলেন তরুণী। বাদ সাধেন খোদ র‍্যামোন। ‘I told her that living with me would turn her into a kind of tetraplegic too …’। র‍্যামোনের অনুরোধ এবং জোরেই অরিতা বিয়ে করেন অন্য একজনকে। বারংবার আবদার সত্ত্বেও দেখা করতে বারণ করেন র‍্যামোন। কষ্ট, জ্বালা, অক্ষমতা বুকে নিয়ে। ঘরের জানলার বাইরের আকাশে র‍্যামোন দেখেন অরিতাকে। আটলান্টিকের বিচে। গ্যালিসিয়ার খোলা আকাশে।

এই তো গেল প্রেক্ষিত। আর বাকিটা? র‍্যামোন এখানেই কিংবদন্তী। তিরিশ বছর ধরে আপিলের পর আপিল করে গেছেন করুণা-মৃত্যু বা ইউথ্যানাসিয়ার জন্য। রাইট টু ডাই উইথ ডিগনিটি অ্যাসোসিয়েশন বা ডিএমডি সংস্থা পাশে দাঁড়িয়েছিল র‍্যামোনের। বার্সিলোনার উচ্চ-আদালতে দাবি নাকচ হয়ে যাওয়ার পর স্পেনের সাংবিধানিক আদালতের দ্বারস্থ হন র‍্যামোন। সেখানেও প্রত্যাখ্যান। কেন? সংবিধানে সবার সমান অধিকারের কথা বলা আছে। বেঁচে থাকার অধিকারের কথা। কিন্তু বেঁচে থাকা তো অধিকার মাত্র, বাধ্যতা না। আর তাছাড়া, র‍্যামোন নিজেই বারবার বলে এসেছেন - ‘Look at me, I am not equal to anybody’। ভাইপো জেভিয়ারের সাহায্যে মুখ দিয়ে পেন ধরে সামনের সাদা কাগজে ছবি আঁকা, লেখা। মুখ দিয়ে টেলিফোন রিসিভ করার জন্য কৃত্রিম ব্যবস্থা। দশকের পর দশক ধরে শরীর ঘোরানোর জন্য ম্যানুয়েলাকে ডাকা। শিস দেওয়া। এটা তো ইকুয়ালিটি না। সমানাধিকার না। কেন বুঝবে না আইন?

আর তাই একসময়ে বাধ্যতা থেকেই সিদ্ধান্ত। বিরুদ্ধতা। রাষ্ট্র এবং আইনের বিরুদ্ধতা। র‍্যামোন তাঁর বন্ধুবৃত্তের এমন কয়েকজনকে বাছলেন যাঁদের উপর নিঃসঙ্কোচে ভরসা করা যায়। ভিগো গ্রামে তাঁর বাড়ি থেকে তাঁরই অনুরোধে র‍্যামোনকে একটা সময়ে নিয়ে যাওয়া হল বোইরো অঞ্চলে। প্রত্যেককে নিখুঁত চিত্রনাট্যে দিয়ে দিলেন ছোট ছোট করে এক একটি কাজ, যার প্রত্যেকটি আলাদাভাবে কোনওভাবেই অপরাধের পর্যায়ভুক্ত নয়। সব মিলিয়ে একটি মৃত্যুকে সংগঠিত করতে সাহায্য করা। শেষমেশ একটি সায়ানাইডের পেয়ালা। স্ট্র। একটি ভিডিও ক্যামেরা। র‍্যামোনের শেষ কিছু মুহূর্ত। বক্তব্য। কথা। ১৯৯৮। ১২ জানুয়ারি। টানা তিরিশ বছর লড়াই করে এভাবেই শান্তি পেয়েছিলেন র‍্যামোন। জিতে গেছিলেন।

এবং শেষমেশ র‍্যামোনা ম্যানেইরো-র কথা। র‍্যামোনের বান্ধবী। ম্যানেইরোর কাছেই শেষ কিছু দিন ছিলেন র‍্যামোন। র‍্যামোনের মৃত্যুর পর ম্যানেইরোকে গ্রেপ্তার করে রাষ্ট্র। শেষমেশ প্রমাণের অভাবে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। প্রায় সাত বছর পর একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে মুখ খুলেছিলেন র‍্যামোনা ম্যানেইরো। হ্যাঁ, তিনিই সায়ানাইডের গ্লাস এগিয়ে দিয়েছিলেন। ভিডিও ক্যামেরা অন করে দেওয়ালে ঠেসে দাঁড়িয়েছিলেন, যতক্ষণ না সব শেষ হয়। কেন করেছিলেন? ছোট্ট করে র‍্যামোনা বলেছিলেন - ‘I did it for love’।

র‍্যামোন সামপেদ্রোর গল্পটা এমনই। এবছরই ২৫ জুন স্পেনের পার্লামেন্টের একটি আইন অনুযায়ী ইউথ্যানাসিয়া  বা করুণা-মৃত্যুকে আইনত স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। আরও অনেকের জন্যেই ঠিক এই লড়াইটাই জিততে চেয়েছিলেন র‍্যামোন। নিজের কবিতার বই ‘Letters to Hell’ (‘Cartas Desde el Infierno’)-এ লিখে গেছিলেন অনেক কথা। কেন যে ইংরিজি অনুবাদ বেরোল না বইটির? অদ্ভুতভাবে আজও স্থানীয় হয়ে থেকে গেল কিংবদন্তির নিজের কথাগুলো।

রয়ে গেল কিছু ছবি। সাক্ষাৎকার। পরিচিত মানুষের কথায় র‍্যামোনের জীবন। তীব্রভাবে বাঁচতে চাওয়া এক মানুষের বাঁচতে না পারার কষ্ট থেকেই মৃত্যুর জন্য লড়াই। প্যারাডক্স। অস্কার ওয়াইল্ড, জোনাথন সুইফট, এডগার অ্যালেন পো বা গুস্তাভ ফ্লবেয়ার পড়া এক প্রাণবন্ত চরিত্র। টাইম ম্যাগাজিনের সেই সাংবাদিক রড উসার-এর কথা দিয়েই শুরু করেছিলাম লেখা। শেষটুকুতেও রডের লেখা একটি কলামের শেষ লাইনটুকুকেই স্মরণ করি -

     ‘Right now I like to think RIP has a small new meaning. Ramon in Peace.’ 

তথ্যসুত্রঃ

More Articles