'দুগ্গাপুজোয় শুধু নতুন জুতো হলেই হবে! নতুন সেক্স চাই না?' পুজোর সোনাগাছির গোপন কথা

Redlight Area: অষ্টমীর অপরাহ্ন গড়িয়ে যায় অষ্টমীর সন্ধ‍্যায়। বাবুদের ভিড় বাড়তেই থাকে। লক্ষ্য করি, নাগরীরা সবাই পড়েছে নতুন কাপড়। নিজেরা কিনেছে? না বাবুরা দিয়েছে?

আজ থেকে চল্লিশ বছর আগের ঘটনা। আমি তখন তপ্ত তরুণ। খুব বড় একটি বাংলা কাগজে কাজ করি। আমার ওপর ভার পড়েছে, উপপতিদের সঙ্গে এবং বদান্যতায় সোনাগাছির মেয়েদের কেমন কাটে দুর্গাপুজো- সেই ছবিটি তুলে ধরার।

গত চল্লিশ বছরে কলকাতা অনেক বদলেছে। কলকাতার পুজো গত দশ বছরে প্রায় আমূল পরিবর্তিত। এখন রমরমায়, উজ্জ্বলতায়, আস্ফালনে, সরকারি মদতে এবং অর্থসাহায্যে কলকাতার এবং সারা পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপুজোই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সংস্থায় রূপান্তরিত। চল্লিশ বছর আগে কলকাতার পুজোতেও এই কর্পোরেট রূপটি ফুটে ওঠেনি। তখন বাদ্যি, রোশনাই, আনন্দ- সবই ছিল। যা ছিল না, তা হলো এমন রাজনীতির অন্তঃস্রোতবাহী অভিব্যাপ্তি ও অভিবন্দনা। কলকাতার বিখ্যাত ‘রেডলাইট এরিয়া’ বা বণিতাপাড়ার রূপও নিশ্চয়ই গত চল্লিশ বছরে অনেক পাল্টেছে। পুজোর সোনাগাছি হয়তো এখন এতই আলাদা, যে আমি সেখানে গেলে আর সেই সোনাগাছির হদিশ পাব না।

একটা কথা প্রথমেই বলে রাখি। বাঙালির দুর্গাপুজোর সঙ্গে কিছু রূপোপজীবিনীদের সম্পর্ক আদ্যিকালের। দুর্গাপুজোর একটি অনিবার্য উপাদান গণিকাপল্লির মাটি! এই অনিবার্য উপাদানটি একটি সামাজিক বার্তা বহন করে চলেছে যুগযুগান্তর ধরে। সেই বার্তাটি হলো, বাঙালির এই বিপুল মাতৃপূজার আয়োজন ও আনন্দ থেকে স্বৈরিণীদের আমরা সরিয়ে রাখিনি। তাদের বাড়ির মাটি ছাড়া দুর্গাপুজোই সম্ভব নয়! পৃথিবীর আর কোনও দেশে, কোনও ধর্মে, কোনও পূজায় কামলেখার এমন স্বীকৃতি দেখিনি। দুর্গাপুজোর সামাজিক বার্তায় সেই আদিকাল থেকেই আছে নগরনটীদের আহ্বান।

book cover

কালীপ্রসন্ন সিংহ তাঁর বিখ্যাত ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’-য় কলকাতার দুর্গাপুজোর যে অবিস্মরণীয় ছবিটি তুলে ধরেছেন, তাতে বারাঙ্গনাদের ভূমিকা অস্বীকার করবার যো নেই। বাবুদের বাড়ির পুজোয় এবং বারোয়ারি পুজোতেও বাবুদের আনন্দের একটি বড় উৎস তো ছিল নটিনীদের নাচ, গান, রঙ্গ। এখনকার বাবুরা সোনাগাছির নামে লজ্জা পায়। অথচ মুখ মুছে পণ্যাঙ্গনাচর্চা করে। এখন অবশ্য তাদের নাম ‘এসকর্ট গার্ল’। সোনাগাছিতে যেতে হয় না। নগরনটিনীদের পাওয়া যায় মহার্ঘ গেস্টহাউসে, তারকাখচিত হোটেল রুমের বিলাসে। দুর্গাপুজোর কলকাতায় পার্ক স্ট্রিটের বার-এ বার-এ বারবিলাসিনীদের ভিড় এ-বছর গত দু'বছরের চেয়ে একটু বেশিই হবে। গত দুই বছরের পুজোয় অতিমারীর ছায়া পড়েছিল। ফলে দুর্গাপুজোয় বাঙালির যোষিৎচর্চা মাস্কে ঢাকা পড়েছিল।

কালীপ্রসন্নর কালে বাঙালি বাবুর গণিকাবিলাসে কোনও ঢাকনা থাকত না। বরং গঙ্গার ওপর নৌকো বা বজরা ভাসিয়ে দুর্গাপুজোর কদিন রক্ষিতাদের নিয়ে বাঙালি উপপতিরা তাদের রক্ষিতাদের নিয়ে আমোদ করত। কার নৌকোয় বা বজরায় ক'জন রক্ষিতা বাবুদের গলা জড়িয়ে সোহাগ করছে, তাঁর কম্পিটিশনও হতো। যে বাবুর যত বারনারীর ঝলক, সে বাবুর তত সামাজিক সম্মান ও দাপট! দুর্গাপুজোয় গঙ্গাবক্ষে নৌকোয় নৌকোয় ভাসত জনপদবধূদের মেলা। সেই রাজনটীদের কলকাতা কবে মরেছে!

রাজনটীদের দিন ফুরিয়েছে?

আমার আজও মনে আছে আর্শিকে। চল্লিশ বছর আগের কোনও এক দুর্গাপুজোর অষ্টমী-অপরাহ্নে আর্শির দেখা পেলাম সোনাগাছিতে। আর্শির আঁখিপাতের টান চল্লিশ বছরের পুরনো হয়েও আজও দিব্য জেগে আছে মনের মধ্যে। আর্শির ছিপছিপেমি আমাকে আঁকড়ে ধরল। আর্শির পরনে চড়া গোলাপি রঙের শাড়ি। আর কালো কাঁচুলি। যেন ব্রায়ের রেখাচিত্র। আর্শির কোমর মসৃণ, মেদবিহীন, চর্চিত নাগরালিতে উপচে পড়া কোমর! গভীর নাভিকূপটি মন্ত্রমুগ্ধ করে আমাকে মুহূর্তে।

- কী নাম তোমার? জানতে চাই।
- আর্শি, বলে সেই বারাঙ্গনা মুচকি হেসে। ডান গালে আহ্বানের টোল পড়ে।
- কেমন কাটছে তোমার পুজো? আলাপ জমাতে চাই।
- ভেতরে এসো, আরও ভালো কাটবে আমার পুজো, আর্শি আমাকে তড়িৎগতিতে টেনে নিয়ে যায় ঘরের স্যাঁতস্যাঁতে শরীরী অন্ধকারে।
- আগে বলো, পুজোয় কি তোমাদের ব্যবসা কমে যায়? কারণ পুজোয় তো বাবুরা সব বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে ব্যস্ত।
- তোমার বউ-ছেলেমেয়ে নেই? তাহলে তুমি এসেছ কেন? পুজোর আনন্দে বউ কি দেবে গো? আমরা যা পারি, বউরা তা পারবে? দুগ্গাপুজো বলে কথা। দুগ্গাপুজোয় শুধু নতুন জুতো হলেই হবে! নতুন সেক্স চাই না?

আর্শির এই একটি প্রশ্ন আমাকে খুন করে! আর্শি ততক্ষণে সরিয়ে ফেলেছে শাড়ি। উপড়ে ফেলেছে কাঁচুলি। টুকটুকে ব্রা পড়ে আমার সামনে।

-এত দেরি করলে হবে? পুজোর ক'দিনই তো আমাদের বিজনেসে খুব তাড়াহুড়ো। আজ সন্ধেবেলা ভিড় যা হবে, কাউকে বেশি টাইম দিতে পারব না। আজ অষ্টমী না? যা করার, তাড়াতাড়ি সারো।

আমি আর্শির হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিই। আর্শি অবাক হয়ে তাকায় আমার দিকে।
- কী গো, পছন্দ হলো না বুঝি?
- খুব পছন্দ হয়েছে আর্শি। অন্য একদিন আসব।
বেরিয়ে আসি আর্শির ঘর থেকে।
এইটুকু সময়ের মধ্যে নিষিদ্ধপল্লি বারনারীদের ভিড়ে ভরে গেছে। কতভাবে যে তাদের খদ্দের ডাকার ইশারা, ইঙ্গিত, সংকেত। ক্রমশ অষ্টমীর অপরাহ্ন গড়িয়ে যায় অষ্টমীর সন্ধ‍্যায়। বাবুদের ভিড় বাড়তেই থাকে। লক্ষ্য করি, নাগরীরা সবাই পড়েছে নতুন কাপড়। নিজেরা কিনেছে? না বাবুরা দিয়েছে?

যে সমবয়সি মেয়েটি চোখ মেরে এগিয়ে এসে দাঁড়ায় আমার সামনে, আমাকে তাঁর ঘরে ডাকে, আরাম করতে বলে, জিজ্ঞেস করে আমি ‘ব্র্যান্ডি’ খাই কি না, তাঁর নাম আলতা। আলতা নামের আর কোনও মেয়ে আমার জীবনে আসেনি।
-আলতা, আজ অষ্টমী, আজ তো তোমরা বেশি ব্যস্ত, তাই না?
-ওই সব সস্তা ব্যস্ততা ছুকরিদের। এই ধরছে। এই ছাড়ছে। আমি আস্তে চলি। বাবুরা তাতে আরাম পায়।
আমি কাঁধের শান্তিনিকেতনি ব্যাগ থেকে হুইস্কির বোতল বের করে বলি, আলতা, তুমি বুঝি ব্র্যান্ডি ভালবাসো?
- তুমি ব্র্যান্ডি এনেছ?
- এটা হুইস্কি, ব্র্যান্ডি নয়।
- ওই হলো। সবই এক, বলে আলতা। তারপর হঠাৎ বলে, তোমার নামও কি ‘অমুক’?
- কী করে জানলে! আমি অবাক ভাব ফুটিয়ে তুলি।
- অনেকেই নিজের নাম বলতে গিয়ে বলে ওই নামটা। আর বলে আমিই সেই বিখ্যাত কবি, বুঝলে আলতা?
- আরে দুর! সবাই মিথ্যে বলে। এতদিনে তোমার সামনে সেই আসল কবি। বুঝলে আলতা?
- তোমাকে দেখে কিন্তু কবিই মনে হচ্ছে। আমাকে ঠকাচ্ছ না তো?
- পাগল! বলি আমি।
আলতা ভারি খুশি। সে দুটো গ্লাস নিয়ে আসে। এক বোতল জল আনে। আমাকে বলে, আমাকে একটুখানি দেবে। নেশা করব না। এখন সবে সন্ধেরাত।

আলতা আবার উঠে যায় খাট থেকে। বলে, অষ্টমী হয়ে গেল, তবু গরমি কমল না।

আলতা পাখাটা জোর করে দিল। তারপর বুকের আঁচল নামিয়ে, ব্লাউজের হুক খুলে, আমার সামনে বসে হুইস্কিতে চুমুক দিল।

বললাম, আলতার সিঁথিতে সিঁদুরের দিকে তাকিয়ে, তোমার শাড়িটা ভারি সুন্দর। তোমাকে দেখাচ্ছেও খুব ভালো। শাড়িটা কি তোমার বর দিয়েছে পুজোতে?

-বর একটা ছিল বটে। একটা মেয়েও হয়েছে। ‘বর’ এখানে নিষিদ্ধ শব্দ। এখানে সব বাবু। বাবুরা দেয়-থোয়। অনেক বড় মানুষ আসে গো আমার কাছে। আমার শাড়ি, বেলাউস, বডিস– সব বাবুদের দেওয়া। ছত্তিরিশ মাপ জেনে ঠিক বডিস কিনে আনে। আমি তাকাই আলতার ভরাট ছত্তিরিশের দিকে। আলতা বুঝতে পারে। রাত্রেও শরতের রোদ্দুরের মতো হালকা খুশি ফুটে ওঠে আলতার চোখে। আমার হঠাৎ মনে হয়, বডিস পরা আর কোনও নারীকে আমি দেখেছি কি? আলতা অন্য যুগের! বেশ লাগে আমার।

- পুজোর সময় তোমার মেয়ের জন্য মনকেমন করে না? জানতে চাই আলতার কাছে।
- পুজোর সময় মনকেমন? বাবুদের এই হিড়িকের মধ্যে সময় কোথায় মনকেমনের? আমাদের বিজনেসে মনকেমনের বালাই নেই।
- কিন্তু বিজয়ার দিন? সেদিন বাবুরা সব বউ-বাচ্চা, পরিবার নিয়ে ব্যস্ত। সেদিন তোমার একা লাগে না?
- কী বলছ গো? বিজয়ার দিন সোনাগাছি গিজগিজ করে বাবুদের ভিড়ে! মা-কে বিসর্জন দিয়ে কি বাড়ি ফিরে বউকে মনের কষ্ট জানাবে বাবুরা? আলতার এই বুকে মাথা রেখে কাঁদতে আসে গো। আমিও বাবুদের দুঃখ-কষ্ট বুঝি। আমি বলি, কাঁদো কাঁদো। যত খুশি কেঁদে মন শান্ত করে বাড়ি যাও। যাবার সময় আমাকে ভরিয়ে দিয়ে যায়।

আমি মধুর বিস্ময়ে তাকিয়ে আলতার দিকে। আলতা সামনের দিকে ঝুঁকে এগিয়ে আসে আমার কাছে। বলে, তুমিও এসো না বিজয়ার রাতে। তবে, অনেক রাত করে, ধরো ভোররাত্তিরে, আসতে পারবে? জেগে থাকব!

More Articles