সুচিত্রা সেনকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন উত্তমকুমার, উত্তরে কী বলেছিলেন মহানায়িকা?

উত্তম মৃদু হেসে বলেন, রমার সঙ্গে আমার কেমিস্ট্রির মিল, বুঝলে হে! এই জিনিস অভিনয় করে তৈরি করা যায় না। কেমিস্ট্রির বাংলাটা কী হবে বলো তো?

-আপনি সুচিত্রা সেনের প্রেমে পড়েননি?

এই প্রশ্ন আমি উত্তমকুমারকে করেছিলাম।

তিনি উত্তর দিয়েছিলেন আমার প্রশ্নের।

তবে ভেবে ছিলেন অনেকক্ষণ।

আমি উত্তমকুমারকে বললাম, এত ভাববার কী আছে? সারা বাংলার পুরুষ সুচিত্রার প্রেমে ভেসে গেছে। আর আপনি তাঁর সঙ্গে ক্রমাগত প্রেমের অভিনয় করেও ভাবছেন, প্রেমে পড়েছেন কি না! এটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না?

-বাড়াবাড়ি তো হচ্ছেই। তবে ভাবছি সত্যি কথাটা বলা আরও বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে কি না? ঠিক এইরকম সরাসরি কেউ তো এই প্রশ্ন করেনি।

-আপনি কি বলতে চান সুচিত্রা সেনের প্রেমে আপনি পড়েননি? প্রেমের অভিনয় করেছেন মাত্র? আর বললেই আমি মেনে নেব?

আরও পড়ুন: এক তরুণী লাল ব্লাউজ ছুড়েছিলেন উত্তমকুমারের দিকে

-না না, সত্যি কথাটা আমি আজও কাউকে জানাইনি। তাই ভাবছি, তোমাকে বলাটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে কি না।

এই কথা বলেই উত্তমের সেই হাসি। সাতটা খুন করে যে হাসি হেসে দিব্য পার পাওয়া যায়।

-কিসসু বাড়াবাড়ি হবে না। বরং না বলাটাই বেয়াড়া বাড়াবাড়ি হবে। বলে ফেলুন খোলসা করে, বললাম আমি।

উত্তম বললেন, তাহলে শোনো। কিন্তু কথা দাও, সামলে লিখবে। রং চড়াবে না।

-কথা দিলাম।

উত্তমকুমার বিলিতি সিগারেট ধরালেন ভারি সুদর্শন বিদেশি লাইটার দিয়ে। অনামিকায় ঝিলিক মারল বিপুল হিরে। কবজিতে সোনার নবগ্রহ বন্ধনীতে একটিবার পাক দিলেন। সিগারেটের ধোঁয়া লাংস পর্যন্ত টেনে নিলেন। তারপর ঠোঁটদু'টি অব্যর্থ নৈপুণ্যে চুমু-খাওয়া ভঙ্গিতে এনে পরপর তিনটি রিং ছাড়লেন। উত্তমের মুখনিঃসৃত পারফেক্ট ইউক্লিড! ধোঁয়া-বৃত্ত ক্রমেই বড় হচ্ছে। আমি সেই দিকে তাকিয়ে অবাক। উত্তমকুমার তাঁর এই পর্যন্ত না বলা সত্যটি সেই ক্রমবর্ধমান বৃত্তের মধ্য দিয়ে গলিয়ে দিলেন। বললেন, আমি রমার প্রেমে পড়েছি ঠিক যতটা সত্যি, ততটাই সত্যি, আমি রমাকে বিয়ে করতে চেয়েছি।

'জীবন তৃষ্ণা' ছবির দৃশ্য

বাতাসে ভাসমান ইউক্লিড এফোঁড়ওফোঁড় হয়ে গেল। আমার হৃৎপিণ্ড গলায়। বললাম, রিয়েলি!

-ট্রু স্টোরি, বললেন উত্তম।

-তারপর? এই বোকা বোকা প্রশ্ন না করে পারিনি। আমার স্যাঁতস্যাঁতে মধ্যবিত্ত কৌতূহল আর কী।

উত্তম হেসে বললেন, রমার উত্তরটা আমৃত্যু মনে থাকবে।

-কী ছিল সুচিত্রা সেনের উত্তর?

ফস করে প্রশ্নটা বেরিয়ে গেল। এই আমার আর একটা দোষ।

মুহূর্তে উত্তমের উত্তর, রমা বলল, উত্তম তুমি-আমি বিয়ে করলে কেউ আমাদের ছবি আর দেখতে আসবে না। স্বামী-স্ত্রীর আদিখ্যেতা লোকে টিকিট কেটে দেখতে আসবে? ব্যস, রমার ওই একটি কথায় আমার বিয়ের প্রস্তাব ভেসে গেল।

-আর আপনার প্রেম?

-ওটা থেকেই গেছে। রমা আমার সবথেকে সুন্দরী নায়িকা। আমার খুব বন্ধু, আমাকে ভালবাসে। আমিও বাসি।

-উনি যে সিনেমা ছেড়ে চলে গেলেন, মন কেমন করে না?

-মন কেমন করে, মিস করি রমাকে, টালিগঞ্জের প্রাণ ছিল রমা, অন্তত আমার কাছে।

-দেখা হয়?

-না। হয় না।

-আপনিও দেখা করতে পারেন না?

-রমা একটা কথা বলেছিল সিনেমা ছেড়ে যাওয়ার আগে?

-কী কথা?

-তুমি আমাকে কোনওদিন ডেকো না। আর দেখা করতে চেও না আমার সঙ্গে। তুমি চাইলে আমি না বলতে পারব না। দুর্বল হয়ে পড়ব।

-সুচিত্রা সেন এত গ্ল্যামার, এত খ্যাতি ছেড়ে চলে গেলেন কেন?
উত্তমকুমারকে এই প্রশ্ন না করে পারিনি। এইসব কথা হচ্ছিল বিশাল অ্যাপার্টমেন্টের অ্যান্টি-রুমে বসে। আবেগে তাঁর চোখ ছলছল করছে। তিনি খুব শান্ত কণ্ঠে বললেন, রমা এমন কোনও আলো পেয়েছে, যার কাছে এই গ্ল্যামার, এই আলো কিছুই নয়!

-আরও একটা প্রশ্ন করতে পারি?

-যত খুশি। অনেক কথা ভেতরে বন্দি হয়ে আছে। আমি চাই, কিছু কথা মুক্তি পাক।

-সুচিত্রা সেনকে, কিংবা আরও সঠিকভাবে আপনার রমাকে আপনি ভুলতে পারছেন না কেন?

-অনেক কারণ। রমার চোখ। রমার হাসি। রমার দাপট। রমার ব্যক্তিত্ব। রমার হিউমার। রমার অহংকার। রমার অভিনয়। রমার সঙ্গে ঝগড়া। রমার সঙ্গে ভাব। রমার ভালবাসা। রমার মতো আর কাউকে কোনওদিন পাব না। ওকে মিস করব আজীবন।

-আপনার আর সুচিত্রা সেনের মতো জুটি বাংলা সিনেমায় আর আসবে না, বললেই ফেললাম শেষ পর্যন্ত।

-কেন জানো তুমি?

-হয়তো জানি। তবু আপনি বলুন। আপনার মুখেই কথাটা থেকে যাক।

উত্তম মৃদু হেসে বলেন, রমার সঙ্গে আমার কেমিস্ট্রির মিল, বুঝলে হে! এই জিনিস অভিনয় করে তৈরি করা যায় না। কেমিস্ট্রির বাংলাটা কী হবে বলো তো?

-রসায়নের মিল বাঙালি ঠিক বুঝবে না। সুচিত্রা সেনের সঙ্গে আপনার রসের মিল। কেমিস্ট্রি এখানে রসের মিলই বোঝাচ্ছে।
আমার কথা শুনে উত্তমের সেই সাত খুন মাফ করা যায় হাসি আমার আজও মনে আছে।

-আপনি কিন্তু আপনার রমাকে বেশ ভয় পেতেন, আমি দেখেছি, প্রায় অর্বাচীনের মতো বলে ফেললাম।

-তুমি দেখে ফেললে মানে? কোথায় দেখলে আমাদের?

-'গৃহদাহ' ছবির শুটিংয়ে। অচলার বাড়িতে আপনি আর প্রদীপকুমার। দু'জনেই অচলার প্রেমে পড়েছেন। অচলা সুচিত্রা সেন। তিনি চায়ের ট্রে হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে কিছু একটা বললেন। ডিরেক্টর বললেন, কাট। তারপর মিনমিন করে সুচিত্রা সেনকে বললেন, ম্যাডাম, আপনি বোধহয় সামান্য ফাম্বল করেছেন। যদি আর একটা টেক কাইন্ডলি... অচলার বাবা পাহাড়ী সান্যাল, যিনি এতক্ষণ ধ্যান করছিলেন, তিনি পরিচালকের আস্পর্ধা দেখে চোখ পিটপিট করতে লাগলেন। সুচিত্রা সেন আপনার দিকে তাকিয়ে বললেন, কী গো, আমি ফাম্বল করেছি? আর আপনি ডিরেক্টরকে বললেন, রমা পারফেক্ট, কোনও ফাম্বলিং নেই। স্টুডিওর মধ্যে অচলার দোতলা বাড়ি তৈরি হয়ে ছিল। আমি দোতলা বাড়ির সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে শুটিং দেখছিলাম। প্রদীপকুমার সেই সিঁড়ি দিয়ে নিচে চলে গেলেন 'ডিসগাস্টিং' শব্দটি বলে। সুচিত্রা সেন পাহাড়ী সান্যালের দিকে পা বিছিয়ে আপনার কোলে মাথা রেখে চিত হয়ে শুয়ে পড়লেন। আর আপনি তাঁকে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতে লাগলেন।

আমার বেফাঁস কথায় ভেবেছিলাম উত্তম রেগে যাবেন।

মহানায়ক অবিচল। ততক্ষণে চা এসে গেছে।

চায়ে চুমুক দিয়ে এতটুকু না হেসে উত্তম বললেন , দৃশ্যটা সিনেমায় নেই। কিন্তু দৃশ্যটা কি খারাপ লেগেছিল? এটাকে কী বলবে, রস না রসায়ন?

বলেই সেই অতুল হাসি।

উত্তমকুমারের এই প্রশ্নের উত্তর আমি আজও জানি না।

More Articles