চৌরঙ্গিতে শোনা যেত গর্জন! কলকাতাতেও মানুষ কাঁপত বাঘের ভয়ে

কলকাতা সম্পর্কে একটা প্রবাদ ছিল যে কলকাতায় বাঘের দুধ পাওয়া যায়। বাঘের দুধ পাওয়া না গেলেও বাঘ যে বিক্রি হতো, তার প্রমাণ আঠারো শতকের শেষদিকে একটা বিজ্ঞাপনে পাওয়া যায়।
 

 


দক্ষিণরায়, রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার অথবা সাধারণ মানুষের কথায় বাঘ। নামের মতোই হরেকরকম কারণেই কলকাতার সঙ্গে বাঘের বিভিন্ন গল্প জড়িত। গর্জন থেকে দর্শন, অপ্রত্যাশিতভাবে সাক্ষাৎ থেকে আক্রমণ, বাঘ বেচা, বাঘ পোষা, বাঘের খেলা থেকে বাঘ শিকারের মতো সবকিছুই এই শহর গত তিনশো বছরে দেখে ফেলেছে। কলকাতার একটি এলাকার নামের সঙ্গেও বাঘের নাম জড়িয়ে রয়েছে। বর্তমানে কলকাতা শহরে চিড়িয়াখানায় গেলেই মনের সাধ মিটিয়ে বাঘ দেখা যায়। খাঁচার বাইরে মানুষের বিচিত্র কার্যকলাপ থেকে বন্দিদশার বিরক্তি সহ্য করেও বাঘ মামা গর্জন থেকে দর্শন- সবকিছুই দিয়ে থাকেন। প্রাচীন কলকাতায় বাঘ দেখার জন্য ইচ্ছে অথবা টাকার দরকার হতো না। মানুষের না, বরং নিজের মর্জিমতোই বাঘ দেখা দিত আর মানুষের মধ্যে তার উপস্থিতির ফলে আতঙ্ক তৈরি হতো।

প্রাচীন কলকাতায় বাঘের উপস্থিতি বিভিন্ন নথি এবং জনশ্রুতি থেকেই জানা যায়। কথিত আছে যে, চৌরঙ্গির জঙ্গলে প্রায়শই বাঘের গর্জন শুনতে পাওয়া যেত। বর্তমানে চৌরঙ্গি এলাকার পরিস্থিতি দেখলে সেখানে বাঘের গর্জন পাগলের প্রলাপ বলে মনে হয় কিন্তু এই ঘটনার সময় চৌরঙ্গির পরিস্থিতি অনেকটাই আলাদা ছিল। সতেরো-আঠারো শতকে কলকাতা জঙ্গলাকীর্ণ এলাকা ছিল। এই এলাকায় সুন্দরবনের মতো ম্যানগ্রোভ জাতীয় উদ্ভিদ ছিল। বর্তমানে সুন্দরবনে দেখতে পাওয়া বিভিন্ন জন্তুজানোয়ার সেই সময় কলকাতার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়াত।

কলকাতায় মানুষের বসবাস শুরু হতেই বাধল গোলযোগ। বাঘের এলাকা কমে যেতেই বাঘ হানা দিতে শুরু করল লোকালয়ে। কথিত আছে যে, বর্তমান মল্লিকবাজার এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় বহু মানুষ বাঘের হাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে বহু মানুষের আধখাওয়া দেহ উদ্ধার হয়েছিল। সেই দেহগুলির মধ্যে অনেকগুলি শনাক্তকরণের অভাবে জঙ্গলের মধ্যে পুঁতে ফেলা হয়েছিল। ১৮১৯ সালের সমাচার দর্পণ-এর একটি খবর থেকে বাঘের আক্রমণের প্রমাণ পাওয়া যায়। সেই সময়ের খবর থেকে জানা যায় যে, একটা বাঘ শুঁড়িটোলা, বাগমারী, বেলগাছি গ্রামে আনাগোনা শুরু করেছিল। পরে এই তিনটে গ্রাম ছেড়ে সে হাজির হয়েছিল গৌরীপুর নামে এক গ্রামে। এই গৌরীপুর গ্রামে পৌঁছে সে এক মহিলার ওপর আক্রমণ করেছিল। বাঘের আক্রমণে মহিলার মৃত্যু হয়েছিল। তারপর বাঘ অন্য এক বাড়িতে ঢুকে পড়লে বাড়ির মালিক কৌশলে বাঘটিকে ঘরে বন্দি করে দ্রুত দমদমের ছাউনিতে খবর দিয়েছিলেন। ছাউনি থেকে লোক এসে সেই বাঘটিকে গুলি করে মেরেছিল। সম্ভবত বাঘ শিকার থেকেই কলকাতার বাগমারী এলাকা তার নাম পেয়েছে। কথিত আছে যে, ইংরেজরা বাগমারী এলাকার জঙ্গলে বাঘ শিকার করতেন। এই এলাকায় একটা বাঘ হয় আহত হয়ে ধরা পড়েছিল অথবা ইংরেজদের গুলিতে মারা যায়। সেই থেকেই এলাকার নাম হয়ে যায় বাগমারী। যদিও এই জনশ্রুতির সপক্ষে কোনও অকাট্য সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যায় না।

আরও পড়ুন: আজও বাঘের চোখে চোখ রেখে জঙ্গলে পা ফেলেন সুন্দরবনের ‘বাঘ বিধবা’-রা

কলকাতা সম্পর্কে একটা প্রবাদ ছিল যে কলকাতায় বাঘের দুধ পাওয়া যায়। বাঘের দুধ পাওয়া না গেলেও বাঘ যে বিক্রি হতো, তার প্রমাণ আঠারো শতকের শেষদিকে একটা বিজ্ঞাপনে পাওয়া যায়। এক গোরা সাহেব বাঘ এবং চিতাবাঘ বিক্রি করার জন্য সেই বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। সেই বিজ্ঞাপন অনুযায়ী সাধারণ মানুষ বাঘ না কিনলেও কিছু পয়সা খরচ করে তাদের বাঘ দেখার সুযোগ ছিল।

সাধারণ মানুষের বুদ্ধিতে মনে হয় যে, বাঘের মুখোমুখি হলে পালিয়ে প্রাণ বাঁচানো বুদ্ধিমানের কাজ। সেই বাঘের খোলা মুখে মাথা ঢুকিয়ে দিলে তো মৃত্যু অনিবার্য কিন্তু মৃত্যু উপেক্ষা করে কলকাতায় এই অসীম সাহসের খেলা দেখাতেন এক মহিলা। গ্রেট বেঙ্গল সার্কাসের সুশীলাসুন্দরী বাঘের খাঁচায় ঢুকে বাঘের মুখ খুলিয়ে সেই খোলা মুখের ভেতর নিজের মাথা রাখতেন। এই খেলা দেখার সময় দর্শকরা ভয়ে, বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেও খেলার শেষে করতালি সহজে থামত না। খাস কলকাতায় নিজের বাড়িতে বাঘ পুষেছিলেন সৌরীশচন্দ্র রায়। নদিয়ার মানুষের কাছে তিনি রাজাসাহেব নামে পরিচিত ছিলেন। ১৯৫৮ সালে মধ্যপ্রদেশে এক নরখাদক বাঘ শিকার করতে গিয়ে ভুলবশত তিনি এক বাঘিনীকে মেরে ফেলেছিলেন। নিজের ভুল সংশোধন করার জন্য তিনি সেই বাঘিনীর দুটো বাচ্চা দত্তক নিয়েছিলেন। অনেকটাই জিম করবেটের মতো। সেই বাচ্চাদু'টিকে তিনি নিজের বাড়িতে রেখেছিলেন। বাঘের ভয়ে মানুষ তার বাড়ির কাছে ঘেঁষত না। তার বাড়ির নাম ছিল নদিয়া হাউজ, কিন্তু ক্রমে সাধারণ মানুষের মুখে সেই বাড়ির নাম হয়ে যায় বাঘবাড়ি। ১৯৭২ সালে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন পাস হলে সেই বাচ্চাদু'টিকে চিড়িয়াখানায় পাঠানো হয়।

বিংশ শতকের শুরু থেকে বাঘের আক্রমণে কলকাতায় কোনও মানুষ মারা যায়নি। হয়তো তার ফলেই মানুষের কার্যকলাপ বিচিত্র থেকে বিচিত্রতর হয়ে উঠেছিল। ১৯৯৬ সালে ১ জানুয়ারি প্রকাশ তিওয়ারি এবং সুরেশ রাই মদ্যপ অবস্থায় আলিপুর চিড়িয়াখানায় বাঘের খাঁচায় ঢুকে পড়েছিল। তাদের হাতে ছিল একটা ফুলের মালা। খাঁচার মধ্যে সেই সময় ছিল শিবা নামে একটি বাঘ। শিবা প্রথমে দু'জনকেই অগ্রাহ্য করলেও তারা শিবার দিকে এগোতে শুরু করলে শিবা তাদের আক্রমণ করে বসে। সুরেশ গুরুতর আহত হয়, প্রকাশ ঘটনাস্থলেই মারা গিয়েছিলেন।

কলকাতা গত তিনশো বছরের ইতিহাসে নানা পরিবর্তন দেখেছে। গাছপালার জঙ্গলের বদলে তার সর্বাঙ্গে এখন কংক্রিটের জঙ্গল। জঙ্গলের ধরনের সঙ্গে বদল হয়েছে তার বসবাসকারীদের। সময় যত এগিয়েছে, বাঘের এলাকা ততই কমেছে এবং বেড়ে চলেছে মানুষের এলাকা। কলকাতার অনেক এলাকায় ঘুরে বেড়ানো বাঘের উত্তরসূরিরা আজ সরে গেছে নিজস্ব জঙ্গলে। কলকাতায় শুধু রয়ে গিয়েছে চিড়িয়াখানায় বাঘ, আর ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা প্রাচীন কলকাতার বাঘের গল্প।

More Articles