কোটি টাকার ফ্ল্যাট, রাস্তায় ভর্তি বেকার! কলোনির জীবন যেমন

কলোনির উপকণ্ঠে, এক কোটি টাকার ফ্ল্যাটের একেবারে বিপরীতে, এনএন দত্ত রোডের এই প্রান্তে, রাস্তায় এক চর্মসার বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর পিঠে চড়া রোদ্দুর পড়েছে গাছের পাতার ফাঁকা দিয়ে।

২ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ তারিখের 'গণশক্তি' পত্রিকা বের করেছি। আঞ্চলিক শহিদ দিবসের খবর আছে। সাতের পাতায়। খবরটা পড়িনি, কিন্তু হেডিংটা দেখেছিলাম। আমার ঠিক মনে আছে:

          সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াকু
     মহিলাদের সংবর্ধনা বাঁশদ্রোণীতে

খবরে যা লিখেছে, তার শুরুটা এইরকম, "সাতের দশকে দক্ষিণ যাদবপুর ২ এরিয়া কমিটি'র অন্তর্গত বাঁশদ্রোণী অঞ্চলে আধা ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসে শহীদদের স্মরণে মঙ্গলবার একটি অনুষ্ঠান হয়েছে বাঁশদ্রোণী অঞ্চলে। জরুরি অবস্থা এবং তৎকালীন সময়ে রাজনৈতিক হিংসার শিকার হন অসংখ্য বামপন্থী কর্মী। সেই সন্ত্রাস মোকাবিলায় সাহসী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন নিরঞ্জন পল্লি সহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মহিলারা। সেই মহিলা ব্রিগেডের ৬ জন সদস্য এখনও জীবিত, প্রয়াত হয়েছেন ১৭ জন।" অনুষ্ঠানে সেই ৬ জনকে "সংবর্ধনা দেন বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু।" খবরে আরও জানা গেছে, এই অঞ্চলের "১২ জন পার্টিকর্মী, সমর্থক এবং দরদি সেই সময় শহীদ হয়েছিলেন। তাঁদের পরিবারের হাতেও স্মারক তুলে দেওয়া হয়।"

এই শহিদের এলাকায়, সেই দিনগুলোতে, নকশালদের 'সত্তরের দশককে মুক্তির দশকে পরিণত করার' ডাক এবং 'আধা ফ্যাসিবাদী' সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সিপিআই(এম)-এর তীব্র লড়াই-সংগ্রাম— প্রকৃতপক্ষে, এই সবই যেন সংকটমোচন হনুমান মন্দিরের শরণাপন্ন হয়েছে। আমি চারপাশে কেবল তারই আর্তি শুনছি। গোটা রাজ্যেই 'ভোটের বাজারে' বামপন্থীদের কোনও অস্তিত্ব নেই। অশোক মিত্র লিখেছিলেন, বাঙালি স্বভাব-বামপন্থী। সেই স্বভাব কীসের অভাবে নষ্ট হলো? কলোনিতে কলোনিতে যে বাম দুর্গ গড়ে উঠেছিল এক সময়, তার এই চেহারা কেমন করে হলো? এবং তার সমাপতন কি শেষে সংকটমোচন-এ? খুব ইন্টারেস্টিং ব্যাপার!

আরও পড়ুন: তাঁর থেকে লটারির টিকিট কিনে লাখপতি হয়েছে অনেকে, কিন্তু নিজে কেমন আছেন বিশ্বনাথবাবু?

তবে, এই 'আধা ফ্যাসিবাদী' শব্দবন্ধ শুনলেই যেন কেমন 'পুলিশের মৃদু লাঠিচার্জ' মনে হয়। সিপিআই(এম) অবশ্য নকশাল আর কংগ্রেসকে এক করে সেই সাতের দশকে আরও এক অভিনব শব্দবন্ধ আবিষ্কার করেছিল, 'কংশাল'! যদিও, এই রাজ্যে কংগ্রেস এখন আর সিপিআই(এম)-এর শত্রু নয়। ভোটে এই দুই দলের জোট হয়। দু'জনে মিলে একসঙ্গে ব্রিগেড সমাবেশ করে। এবং নকশালরাও বৃহত্তর স্বার্থে বামফ্রন্টের সঙ্গে অনেক কর্মসূচিতে শামিল হয়। ২০১৬, ২০২১ সালের বিধানসভার ভোটের আগে, সিপিআই(এম), তৃণমূল আর বিজেপিকে মিশিয়ে নতুন আরও একটা শব্দবন্ধ বাজারে ছেড়েছিল, 'বিজেমূল'! পরে অবশ্য দেখা গেল, সিপিআই(এম) ছেড়েও কেউ কেউ বিজেপি-তে গেছে। এবং সিপিআই(এম) ছেড়ে, বা বামফ্রন্টের বাড়ির কেউ কেউ তৃণমূলেও গেছে। তৃণমূল থেকে বিজেপি-তে গিয়েও আবার কেউ কেউ তৃণমূলে ফিরে এসেছে। এসব পর পর মনে রাখা ইতিহাস বইয়ের সাল-তারিখ মনে রাখার মতো গুরুত্বপূর্ণ এবং কঠিন। বস্তুত, দেশে এখন এমন এক অবস্থা চলছে, যার প্রেক্ষিতে কখনও কখনও মনে হয় শিবসেনার ভূমিকাও সদর্থক। এরাজ্যের উন্নয়নের নকুলদানাও মহাপ্রসাদ!

ডিম সিদ্ধ, পেঁয়াজ কুচি, সরষের তেল মেখে, কাঁচা লঙ্কা ডলে, ভাত খেলাম। অমৃত! শরীরটা এখন ঠিক লাগছে। একবার কী একটা কাজে মল্লিকবাজারে গিয়ে, মোটরগাড়ির যন্ত্রাংশ বিক্রি-মেরামতির দোকানগুলোর সামনের একটা ফুটপাথে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছিল। তখন ওই ফুটপাথেই, দুপুরবেলা, একজনের ছাঁট মাংস রান্না দেখেছিলাম। ওইরকম একটা তেল-কালির ফুটে, প্রচণ্ড নাক জ্বালা করা পেট্রোল-ডিজেলের গন্ধের মধ্যে, একটা উনুনে হাঁড়িতে রান্না হচ্ছিল। সেই গনগনে আগুনের শিখা, সেই হাঁড়ি থেকে নির্গত ধোঁয়া, আর সেই অপূর্ব মোহময় সুগন্ধ! আহ্! একেবারে উত্তরাধুনিক ডিসকোর্স! আজকে ডিম সিদ্ধ দিয়ে ভাত মেখে খেতে খেতে, ওই রান্নার দৃশ্য দেখছিলাম। তৃপ্তি! ঢেকুর হয়েছে একটা— সাংগীতিক!

গাছতলা থেকে গড়িয়ার দিকে একটুখানি এগিয়ে গেলে রাস্তার বাঁদিকে পড়ে একটা পুলিশ কোয়ার্টার, তার ঠিক আগে ফুটপাথ বন্ধ করে বাইক, অটো সারানোর দোকান। এর উল্টোদিকেই আজাদ হিন্দ ধাবা। তো, সেই গোটা ফুটপাথটা এখানে তেল-কালি পোড়া মোবিল আর ধুলোয় মাখামাখি। হালকা গ্লসি, হালকা ম্যাট— কালো একটা স্লেট যেন। এই কালোর বুকে পড়েছিল একটা রুদ্রপলাশ। আমি সেদিন হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ পায়ের কাছে দেখলাম পড়ে আছে— তার কমলা ঘেঁষে লালচে রঙের দ্যুতি, যেন আগুন জ্বলছিল। মুহূর্তে সব সাদা-কালো হয়ে গেল। রং শুধু আটক রইল ওই পলাশের গায়ে। মাথা নিচু করে ফুলটার দিকে চেয়ে রইলাম। অপূর্ব! এই রূপের কি কোনও তুলনা হয়?

বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটা কবিতা আছে, "তোর কি কোনও তুলনা হয়"— এই কবিতায় সুর করে গান হয়েছে। আমার কানে কানে কে যেন সেই গান গেয়ে গেল। কী একটা অপরিসীম ভালো লাগা ঘিরে ফেলল আমাকে! আমি যেন একটু একটু করে ফুলতে শুরু করলাম। সারাটা শরীর কেমন ঝিমঝিম করতে লাগলো। সে যে কী ভালো লাগা!

খুব জ্বর হলে চৌকিতে শুয়ে থাকতাম, মা বালতি করে জল এনে মাথা ধুয়ে দিত। অয়েল ক্লথ বাড়িতে ছিল না, মা মিলিদের বাড়ির কলাগাছের একটা পাতা কেটে নিয়ে আসত। সেটা আমার মাথার তলায় দিয়ে, তার ওপর গামছা ভাঁজ করে পেতে, আমার মাথাটা ধরে আলতো করে শুইয়ে দিয়ে জল ঢালা শুরু করত। পাখাটা তিনে চলত। আমি আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়তাম। তখন আমার সেই ছোটবেলা এই ফুটপাথে এসে যেন দাঁড়াল আমার পাশে। মায়ের মুখটা খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল। ফুলটা আমি তুলে নিলাম। কলোনির সেই কলকাতার যতই দেমাক বাড়ুক, তাকে আমি খুব খুব ভালবাসি।

কোনও পথের ধারে কিছু দেখলে তা আমার জীবনে টুক করে ঢুকে পড়ে। এ শুধু রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতেই যে কাজে লাগে তা নয়। 'বঙ্গজীবনের অঙ্গ'-র মতো নানা ওঠাপড়ায়-ই লাগে। এই শহরও নানাবিধ উপাদানে ঠাসা‌। কতরকমভাবে যে আমাকে রসদ জোগায়!

ইলিশ মাছ আমি আর খেতে পারি না। অত দাম দিয়ে কেনা সম্ভব নয়। ১২০০ টাকা  দামের ইলিশ নাকি ইলিশ-ই নয়। ১৮০০ বা ২০০০ টাকা কিংবা আড়াই হাজার টাকা না হলে নাকি ইলিশটা ঠিক জমবেই না। বাপ রে!

কিন্তু এই কলকাতায়—

আমার বাড়ির আশেপাশেই কেউ না কেউ ইলিশের মরশুমে, জলের রুপোলি শষ্য পাক করে। আমি গন্ধ পাই। সেই সময়, সঙ্গে সঙ্গে কড়াইয়ে সরষের তেল গরম করে, তাতে কালো জি়ঁরে আর কাঁচালঙ্কা ফোড়ন দিয়ে, লম্বা লম্বা করে কাটা বেগুন ছেড়ে, শুধু হলুদ আর নুন দিয়ে নাড়াচাড়া করে, জল ঢেলে ঢেকে রাখি। দশ মিনিট পরেই তৈরি হয়ে যায় অপূর্ব এক যুগলবন্দি— ওবাড়ির ইলিশ আর এবাড়িতে তার গন্ধে জারিত বেগুনের টলটলে ঝোল! ভাত খাওয়া হয়ে যায় পরমানন্দে। প্রকৃতপক্ষে, দামি-নামী ইংলিশ আর ইলিশ এখন আমি ছবিতেই দেখি। ভালোই লাগে। ইউটিউব-এ কতজন কী যত্ন করে রান্না করে। দুর্দান্ত। কিন্তু—

এই যে বাঙালির পাতে ইলিশ এইরকম দুষ্প্রাপ্য হয়ে গেল, এটা কি ঠিক হলো? দেশ জানে, কথায় বলে, মাছে-ভাতে-বাঙালি— এই অভিধা কি এবার বদলে যাবে? সিঙ্গুরে কৃষিজমি চরিত্র বদলে শিল্পতালুক হয়ে আবার কৃষিজমিতে হাজির হলেও জমির চরিত্র কি আর ফিরে পেয়েছে? বাঙালি ইলিশ না পেয়ে পেয়ে কি তেমন কোনও আবর্তে ঘুরপাক খেয়ে মরবে? কে জানে! 

জল খেয়ে একটু আধশোয়া হয়ে 'এই সময়' পত্রিকা দেখছি। ২ মার্চের কাগজ। ২০২২ সাল। একটা খবর আছে, খুঁজছি। এদিনের কাগজেই ছিল খবরটা। দেখেছিলাম। এই যে, পেয়েছি—

      কলকাতায় অতি-ধনী বেড়ে দ্বিগুণ
               নাইট ফ্র্যাঙ্ক রিপোর্ট

"এই সময়: কলকাতায় গত পাঁচ বছরে অতি-ধনী ব্যক্তির সংখ্যা ১১৫.৫% বেড়েছে। বৃদ্ধির হারে কলকাতা গােটা দেশে এক নম্বরে। সম্পত্তি উপদেষ্টা সংস্থা নাইট ফ্র্যাঙ্ক ইন্ডিয়ার এক রিপাের্টে এই তথ্য উঠে এসেছে। মঙ্গলবার প্রকাশিত রিপাের্ট অনুযায়ী, ২০১৬ সালে কলকাতায় ৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (প্রায় ২২৫ কোটি টাকা) বা তার বেশি নিট সম্পত্তি থাকা ব্যক্তির সংখ্যা ছিল ১১৯, যা ২০২১-এ বেড়ে হয়েছে ২৫৭।

পাঁচ বছরে অতি-ধনী ব্যক্তির সংখ্যা বৃদ্ধির নিরিখে কলকাতা অনেকটাই পিছনে ফেলে দিয়েছে মুম্বই, হায়দরাবাদ, পুনে, বেঙ্গালুরু, দিল্লি, চেন্নাই ও আমেদাবাদকে। মোট অতি-ধনী ব্যক্তির সংখ্যার নিরিখে কলকাতা ভারতের মধ্যে পঞ্চম স্থানে। মুম্বই, হায়দরাবাদ, পুণে ও বেঙ্গালুরুর পরেই। নাইট ফ্র্যাঙ্কের রিপাের্টে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে মুম্বই, হায়দরাবাদ, পুণে ও বেঙ্গালুরুতে অতি-ধনী ব্যক্তির সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১,৫৯৬, ৪৬৭, ৩৬০ ও ৩৫২। দিল্লিতে ২০২১ সালে অতি-ধনী ব্যক্তির সংখ্যা ছিল ২১০, যা কলকাতার থেকে কম। বিলিয়নারের তালিকায় ভারত বিশ্বের দেশগুলির মধ্যে তৃতীয় স্থানে।

২০২০ সালের গােড়ায় ভারতে করােনার ঢেউ আছড়ে পড়েছিল। করােনা-লকডাউনের ফলে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল দেশের অর্থনীতি। বহু মানুষ কাজ হারিয়েছিলেন। অনেকের কাজ থেকে গেলেও কমে গিয়েছিল রােজগার। কিন্তু, অবাক ব্যাপার সেই ভয়াবহ করােনা পরিস্থিতির মধ্যেও ২০২০-২১ অর্থবছরে ভারতে অতিধনীর সংখ্যা ১২,২৮৭ থেকে থেকে বেড়ে ১৩,৬৩৭-এ পৌঁছে গিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এতে ফের প্রমাণিত যে অতিমারীর ফল হিসাবে আর্থিক বৈষম্য বেড়েছে।

নাইট ফ্র্যাঙ্কের পূর্বাভাস, ২০২৬ সালের মধ্যে কলকাতায় অতি-ধনী ব্যক্তির সংখ্যা ৪৩.২% বেড়ে হবে ৩৬৮। নাইট ফ্র্যাঙ্ক ইন্ডিয়া চেয়ারম্যান ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর শিশির বাইজাল বলেন, 'ভারতে অতি-ধনী ব্যক্তির সংখ্যা বৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি শেয়ার বাজার ও ডিজিটালের ব্যবহার।' ভারতে অতি-ধনী ব্যক্তির সংখ্যা ২০২৬-এর মধ্যে বেড়ে ১৯,০০৬ হবে বলে রিপাের্টে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।"

তার মানে কলোনিতেও ফ্ল্যাটের দাম এক কোটি টাকা থেকে শুরু হতে কোনও বাধা নেই আর। 'অতি-ধনী' ব্যক্তিরা সর্বত্র, অলি-গলিতে ছড়িয়ে পড়েছেন। করোনাকালে লকডাউনের সময়ও 'অতি-ধনী' ব্যক্তিরা আরও আরও 'ধনী' হয়েছেন! এ-ও যেমন একটা খবর, তেমনি এ-ও একটা খবর—

                চিন্তা আরও বাড়ল
        শহরে বেকারত্বের পরিসংখ্যানে
                নিজস্ব সংবাদদাতা

"অতিমারির তৃতীয় ঢেউ কাটিয়ে আর্থিক কর্মকাণ্ডে গতি এলে কাজের বাজারের হাল ফিরবে বলে আশা ছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল উল্টো ছবি। শুধু যে দেশে বেকারত্ব বাড়ল তা-ই নয়, শহরাঞ্চলে তা ছাড়িয়ে গেল ১০ শতাংশের গণ্ডিও। উপদেষ্টা সংস্থা সিএমআইই-র সমীক্ষা বলছে, ১৩ মার্চ শেষ হওয়া সপ্তাহে দেশে বেকারত্বের হার ৭.৭৩%, গ্রামে ৬.৪৫% এবং শহরে ১০.৩৬%। তিনটিই আগের থেকে বেশি।"
                                 আবাপ, ১৬.৪.২০২২

শহরের পথে বেকার আমি দেখতে পাই। তাঁদের লটারির টিকিট কিনতে আসেন বিশ্বনাথ ব্যানার্জির কাছে। কিন্তু এক কোটি টাকা দিয়ে কলোনিতে কারা ফ্ল্যাট কিনতে আসেন? তাঁদের এখনও এই চর্মচক্ষে দেখতে পাইনি। কালাচাঁদ দরবেশ অবশ্য একটা গান বহুদিন আমাকে গেয়ে শুনিয়েছেন—

         মন তোর চর্মচক্ষু বন্ধ না হইলে,
          ফুটবে না রে জ্ঞানের তারা

যদিও এই গানের প্রেক্ষিৎ পৃথক এবং কালাচাঁদদা-ও আর নেই ধরাধামে, তবুও এই গানের কথাই মনে পড়ল আমার এখন। আমার সবই চর্মচক্ষু দিয়ে দেখা। জ্ঞান আর হয়েই উঠছে না। কত কিছু তাই উপলব্ধিই হয় না আমার। এই যেমন, এবিপি আনন্দের খবরের মাঝে একটা তেলের বিজ্ঞাপন দেখা যায়, কোনও একটা অলিভ অয়েল-এর। ওই বিজ্ঞাপনে এক মহিলা হাতে-পায়ে যখন তেল মাখেন তখন ভয়েসওভার হয়— 'ত্বক যা কবিতার মতো'।

আমাদের এই কলকাতা 'একদিন' কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে, একথা সেই ছোটবেলা থেকেই শুনছি। যেমন, ছোটবেলায় আরও শুনতাম, নেতাজি জীবিত, 'একদিন' ফিরে আসবেন। যদিও ২০২২ সালের কলকাতা বইমেলায়, মেলা কমিটি একটা হোর্ডিং-এ নেতাজির মৃত্যুর তারিখ লিখে কেস খেয়েছে। তাড়াতাড়ি আবার ওই তারিখ মুছে ফেলতে হয়েছে। তা না হয় হলো, কিন্তু কবিতার বেলায় কী হবে? 

কবিতায় কবি না হয় বলে দিলেন, কিন্তু তা হবে কী করে? কল্লোলিনী বা তিলোত্তমা একটা শহর কী প্রক্রিয়ায় হবে? মানে, এই হয়ে ওঠার জন্য কী কী উপাদান লাগবে? এইসব উপাদান কি বায়বীয়, বৌদ্ধিক, কাব্যিক, আক্ষরিক, কী? 'মালমেটেরিয়ালস্' লাগবে কিছু? ঠিকাদার, সাপ্লায়ার, ব্রোকার লাগবে না? না কি—

ওই যে আমার চর্মচক্ষু, সে তো মর্মবস্তু দেখে না। দেখতেই পায় না। জ্ঞানই হয়নি এতটুকু। তাই সে কবিতার কথা বুঝিতে ব্যাকুল হলেও বুদ্ধির দৌড়ে পেরে ওঠে না। এবং ঠিক এই কারণেই ত্বক কী করে কবিতার মতো হয়, তা-ও বোঝা বিশেষ কঠিন হয়ে পড়ে। আসলে কবিতা যে ঠিক কী বস্তু, তা-ই আমার অজ্ঞানচক্ষু অনুধাবন করতে পারে না। হায়! তবে—

অলিভ অয়েল মেখে ত্বক যদি কবিতার মতো হয়, তাহলে এখনকার কলকাতাও নীল-সাদা রং মেখে আর ত্রিফলা বাতির নেকলেস পরে কল্লোলিনী তিলোত্তমা হয়েছে। এগুলো বোধহয় এভাবেই হয়।

পৃথিবীতে গোলাপ আর কবিতা— এই দুই বস্তুকে নিয়ে যত আদিখ্যেতা হয়ে চলছে, তার সঙ্গে অন্য কোনও কিছুরই কোনও তুলনা চলে না। লোকে বুঝুক না বুঝুক, হে হে করেই চলেছে। করুক। যার যা ভালো লাগে, তাই করুক। তবে, অন্যের উদ্দেশে কিছু দেগে না দিলেই সমাজের মঙ্গল। এ নিতান্তই আমার মত। যাই হোক, আমি গাছতলায় একজনের জ্যান্ত চামড়া দেখেছি আজকে সকালেই, যখন কাগজ কিনতে যাচ্ছিলাম। ছবিও তুলেছি।

কালীবাড়ি ব্রিজ থেকে এনএন দত্ত রোড-এ পড়লেই বাঁদিকে একটা দেওয়ালের মধ্যে ফ্ল্যাট। ডানদিকে বাড়ি। এগিয়ে গেলেই  বিশ্বনাথ ব্যানার্জির লটারির রিকশা গাড়ি। তারপর একটা লেবু গাছ। এরই উল্টোদিকে বাঁ দিকে, 'একটা এক কোটি' টাকার ফ্ল্যাট। আগেই বলেছি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখায় আছে, একটা ভূত দশ টাকা। এখন সবকিছুই মহার্ঘ।

তারপর গাড়ি সারাইয়ের 'রাস্তা ওয়ার্কশপ'। ট্যাক্সির পার্কিং। আর চালকদের গুটখামুখী আড্ডা। কালো পিচের রাস্তায় কমলা রঙের অসংখ্য নকশা। এর উল্টোদিকে, চা, সিগারেট, মুদি ও স্টেশনারি দোকান, ফলের দোকান, সবজির দোকান। উল্টোদিকেও পরপর তিনটে সবজির দোকান। এরপর বাঁদিকে চলে গেছে মুর অ্যাভিনিউ। সোজা গাছতলা। এই ক্রসিং-এ সন্ধেবেলা মাছের বাজার বসে। সোজা এগিয়ে গেলে বাঁদিকে ব্যাঙ্ক, অটো স্ট্যান্ড, একটা স্কুল। ফুলের দোকান। ডানদিকে স্পেনসার-এর দোকান। এখানে মদের কাউন্টারে বিরাট লম্বা লাইন হয়। তারপর আরও তিনটে মুদি-স্টেশনারি দোকান, রক্ত-পেচ্ছাপ পরীক্ষার দোকান। স্কুলে দিতে-নিতে আসা মায়েদের জটলা। বাদামওলা। উল্টোদিকে একটা বড়ো গাছের তলায় ভগবানের ছবিয়ালা টাইলে বাঁধানো, রেলিং দেওয়া একটা বেদী। তারপর কচুরি-ডিম সিদ্ধ। ভাতের হোটেল। উল্টোদিকে, জামা-কাপড়ের দোকান। পাশে হাবিব-এর চুল কাটার দোকান। চলে এলাম গাছতলা। ৩৫২ পা। এই পথের দু'দিকেই ফাঁক ফোকরে ডিয়ার লটারির টেবিল। নেই নেই করেও খান সাতেক। রাস্তার দুদিকে ছড়িয়ে থাকা এইসব দেখতে দেখতেই চোখে পড়েছে সেই চামড়া।

খালি গা। বারমুডা পরা। লম্বালম্বি কাটা বাঁশের একটা ফালি হাতে চলেছেন এক বৃদ্ধ যেন 'মহাপ্রস্থানের পথে'। অথবা কোনও 'দৈব পিকনিকে'। মন্থর তার পদচারণা। আমিও চলেছি পিছনে। খুবই ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে। তাঁর খোলা পিঠটা যেন একটা মহাদেশ। কিন্তু পিঠজুড়েই কেবল বিস্তীর্ণ-রুক্ষ ঊষর জমি। কোথাও একফোঁটা প্রাণের নড়াচড়া নেই, কেবল আমার সামনে বৃদ্ধের হেঁটে যাওয়াটা ছাড়া। তিনি হাঁটছেন।

আমি ক্লাসে বসে আছি।

তিনি হাঁটছেন।

আমি শুনছি—

আমাদের মেরুদণ্ড আমাদের বসতে, দাঁড়াতে, হাঁটতে, মোচড় খেতে, বাঁকতে সাহায্য করে।

বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে পড়লেন।
স্যার বললেন—
তাহলে আমরা কী দেখলাম,
মেরুদণ্ডের অংশগুলি কী কী?
সবাই একসঙ্গে বলে উঠল—
একটি সুস্থ মেরুদণ্ডে তিনটি প্রাকৃতিক বক্ররেখা থাকে যা একটি এস-আকৃতি তৈরি করে। এই বক্ররেখাগুলি আমাদের শরীরের ধাক্কা শোষণ করে এবং মেরুদণ্ডকে আঘাত থেকে রক্ষা করে। অনেকগুলি অংশ মিলে মেরুদণ্ড তৈরি করে।
স্যার বললেন, কী কী?
বৃদ্ধ এবার উবু হয়ে বসে পড়লেন। তাঁর পিঠটা ঠিক  ধনুকের মতো বেঁকে রইল। আমিও দাঁড়িয়ে পড়লাম। তাঁরই কাছে। মাথাটাকে একটু নিচু করে ঝুঁকিয়ে রাখলেন। ঘড় ঘড় করে একটা শব্দ হচ্ছিল, বোধহয় তাঁরই গলা থেকে। আমিও তাঁর পাশে বসে পড়লাম, জিজ্ঞেস করলাম, জল খাবেন?
কোনও উত্তর দিলেন না।
আবার বললাম, জল নিয়ে আসব?
তিনি নড়েচড়ে উঠে দাঁড়ালেন। আমি তাঁকে ধরতে গেলাম, বাঁ হাতটা ঝটকা দিয়ে সরিয়ে নিলেন।
রেডিও চলতে চলতে সিগন্যাল চলে গেলে যেমন শব্দ হয়, ঠিক তেমন শব্দ ভেসে এল ক্লাসরুম থেকে। কেউ যেন প্রাণপনে টিউনিং করে চলেছে। কী কী অংশ মিলে মেরুদণ্ড তৈরি হয়, শোনা গেল না। বৃদ্ধ ধীরে এগিয়ে চললেন। আমি তাঁর উদলা পিঠের ছবি তুললাম। গাছতলার শনি মন্দির চলে এল। বক্সে গান বাজছে—

       আমার মাটির ঘরে বাঁশের খুঁটি মা
       পাই যেন তায় খড় জোগাতে, মা
       মাটির ঘরে বাঁশের খুঁটি, মা
       পাই যেন তায় খড় জোগাতে
       আমার মাটির ঘর যে সোনার ঘর মা
       মাটির ঘর যে সোনার ঘর মা   

বৃদ্ধ মন্দিরের সামনে এসে আবার উবু হয়ে বসে পড়লেন। রিকশা স্ট্যান্ডের একজন বলল, কত আছে?

—থার্টি রুপিজ। তিরিশ টাকা।
—দাও দেখি।
বৃদ্ধ এবার পুরো শরীরটা রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে ডান পকেটে অনেক কষ্টে হাত ঢুকিয়ে প্লাস্টিকের একটা ব্যাগ বার করে এনে রিকশায়ালার হাতে দিয়ে এলিয়ে পড়লেন। রিকশায়ালা বলল, গুণতে হবে? বৃদ্ধ মাথা নাড়িয়ে না বললেন। রিকশায়ালা শনি ঠাকুরের ঘটের কাছে একটা থালা থেকে ৩০ টাকা নিয়ে এসে বৃদ্ধকে দিল। বৃদ্ধ টাকাটা হাতে নিয়ে চোখের সামনে এনে দেখলেন। একটা ১০ আর একটা ২০ টাকার নোট। টাকাটা পকেটে ভরে বৃদ্ধ বললেন,
—বাট্টা?
—বাট্টা লাগবে?
—বাট্টা।
—লাগবেই?
—বাট্টা।
—বাপরে বাপ! খুব টেটিয়া তুমি বুড়ো।
—বাট্টা।
—দাঁড়াও দিচ্ছি।

বক্সে গান বাজছে—

          চাই না মা গো রাজা হতে
          রাজা হবার সাধ নাই মা গো
          দু'বেলা যেন পাই মা খেতে
          চাই না মা গো রাজা হতে।

কলোনির উপকণ্ঠে, এক কোটি টাকার ফ্ল্যাটের একেবারে বিপরীতে, এনএন দত্ত রোডের এই প্রান্তে, রাস্তায় এক চর্মসার বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর পিঠে চড়া রোদ্দুর পড়েছে গাছের পাতার ফাঁকা দিয়ে। যেন গোটা মানবসভ্যতার ওপর ফাল্গুন মাসের সূর্যরশ্মি আপতিত হচ্ছে। বৃদ্ধ ঈষৎ টলছেন। চামড়ার ওপর একটা পিঁপড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাঁর খুব রুক্ষ-কর্কশ চামড়া। বৃদ্ধ বিড়বিড় করে বলেই চলেছেন— বাট্টা। বাট্টা। বাট্টা।

ত্বক সত্যিই কবিতার মতো!

More Articles