মাত্র দেড়শো টাকা আর চূড়ান্ত অপমান! সেই মহালয়া উত্তমের কাছে ছিল অভিশাপের মতো

Mahisashuramardini: খোদ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর কাছেও নাকি গিয়েছিলেন উত্তম, পরামর্শ নিতে। বীরেনবাবুকে আকাশবাণী কিছুই জানায়নি।
১৯৩১ সাল। সে বারে অন্নপূর্ণা আর বাসন্তী পুজো পড়েছে একেবারে গায়ে গায়ে। দু'টি পুজোর মাঝখানে অল ইন্ডিয়া রেডিও একটি অনুষ্ঠান করল। 'দেবী বসন্তেশ্বরী'। তখনও রেডিওর নাম আকাশবাণী হয়নি। পঙ্কজ কুমার মল্লিকের নেতৃত্বে বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য, বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র, হরিশচন্দ্র বালি— কে নেই! সে অনুষ্ঠান এতটাই জনপ্রিয় হল, যে রেডিও কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিলেন, পরের বছর এভাবেই একটি চণ্ডীপাঠের আয়োজন করা হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী বৈদ্যনাথ 'মহিষাসুরমর্দিনী' লিখলেন। বাগবাজারের এই বৈদ্যনাথ ভটচাজকে লোকে তখন চিনত বাণীকুমার নামে। গান পরিচালনার ব্যাপারে প্রথমটায় হেমন্তকে ভাবা হয়েছিল। কিন্তু তিনি মুম্বইয়ে ব্যস্ত। কাজের সঙ্গে কোনও আপস করতে রাজি নন পঙ্কজ মল্লিক। কাজেই দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়কে ও দায়িত্ব দেওয়া হল। মূল পাঠ বীরেন্দ্র কৃষ্ণ করবেন। সে ভাবেই মহড়া চলছে। হঠাৎ খবর এল কলকাতা রেডিওর অফিসে হিন্দু সমাজের কয়েকজন নেতা হাজির হয়েছে। পঙ্কজ মল্লিকের খোঁজ পড়েছে। কী ব্যাপার? গেলেন পঙ্কজ। অফিসের আনাচে কানাচে টুকরো টাকরা ফিসফাস শোনা যাচ্ছে। জানা গেল, কোনও ভাবে তাঁদের কাছে অনুষ্ঠানের খবর গেছে। বীরেন্দ্র কৃষ্ণ মূল পাঠ করছেন সেও তাঁরা জানেন। কিন্তু 'ভদ্র' তো বামুন নন, কায়েত। কাজেই কায়েতের পো দেবীর স্তোত্রপাঠ করলে দেবীর অপমান, হিন্দু ধর্মের অপমান। এক্ষুনি তাঁকে বাদ দেওয়া হোক। ব্রাহ্মণ ছাড়া আর কেউ যেন মন্ত্রোচ্চারণ না করে। পঙ্কজ মল্লিক সেই সব নেতাদের খানিক ঠান্ডা দৃষ্টিতে দেখলেন। গলা তাঁর চড়ল না। কাটা কাটা ভাবে কঠিন অথচ ঠাণ্ডা স্বরে উত্তর দিলেন, "মহালয়ার অনুষ্ঠানে মন্ত্রপাঠ যদি কেউ করে, তবে বীরেনই করবে, নয়তো কেউ করবে না। আমাকে বাদ দিয়ে মহালয়া হলেও হতে পারে, বীরেনকে বাদ দিয়ে মহিষাসুরমর্দিনী চালানো অসম্ভব।" ও স্বরের উপর আর কথা চলল না কোনও। তবে বামুনেরা অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হয়ে ফিরে গেলেন। চারিদিকে বলে বেড়ালেন, ধম্মোটম্মো আর কিছু থাকল না। ভাবতে অবাক লাগে, পঙ্কজ মল্লিকের প্রতিভা চেনার ক্ষমতা ঠিক কোন মাপের ছিল! তখনও চণ্ডীপাঠ করেননি বীরেন্দ্র। কিন্তু রিহার্সাল শুনেই অমন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কথাগুলো বলে দিতে পেরেছিলেন। তা যে ভবিষ্যৎবাণী হয়ে উঠবে, এ কথা তখন কেই বা ভেবেছিল!
 
অনুষ্ঠান হল। তারপরে কীভাবে সে অনুষ্ঠান বাঙালি উৎসবের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠল, তা তো সবারই জানা একরকম। ১৯৬২ অবধি সরাসরি সম্প্রচারিত। তারপরে রেকর্ডেড অনুষ্ঠানই বাজানো হত। 'আশ্বিনের শারদ প্রাতে' সেই স্বর আজকের প্রজন্মও খানিক শুনেছে। আটটি দশক। সময়ের পথে কম দূরত্ব না। কিন্তু তাতে একফোঁটা দুর্বল হয়ে আসেনি সেই কণ্ঠস্বর। মরচে পড়েনি মহালয়ার ভোরে চণ্ডীপাঠ শোনার উত্তেজনা। উত্তেজনার কেন্দ্রে বামুন নয়, দৃপ্ত এক কায়েত কণ্ঠই। বেতার এবং এইচ এম ভি কর্মকর্তাদের নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শিল্পী সুরকারেরা নানান অভিযোগ জানিয়েছেন। আসলে তখন দু'টি ক্ষেত্রেই একটি করে প্লাটফর্ম সর্বেসর্বা। কাজেই কর্মকর্তারা যা ইচ্ছা তাই ফরমাশ খাটানোর একটা সুযোগ পেয়ে গিয়েছিলেন। সেই পথ ধরেই আসে ১৯৭৬। এমার্জেন্সিকালীন দ্বিতীয় দুর্গাপুজো। দিল্লির দাপট দেখছে বাংলা। দেখছে মানে ভালোরকম দেখছে। অত্যাচার কী পরিমাণে হিংস্র হয়ে উঠতে পারে! তার মাঝেই বেতারের কর্মকর্তারা দিল্লি থেকে হঠাৎ ঠিক করে ফেললেন সেবার 'মহিষাসুরমর্দিনী' হবে না। কোনও স্টারফেস সামনে রেখে অন্য কোনও অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে হবে। সে সময়টা উত্তমের কেরিয়রের খুব উজ্জ্বল সময় নয়। একের পর এক বাজে ছবি। একের পর এক ফ্লপ। হতাশা অবসাদ ঘিরে ধরেছে। তার ওপর শিল্পী সংসদের দায়িত্ব। অথচ 'মহানায়ক' বা স্টারভ্যালু তাঁর মতন তখনও কারও নেই ইন্ডাস্ট্রিতে। অবধারিতভাবে উত্তমকেই বেছে নেওয়া হল অনুষ্ঠানের জন্য।
 
আরও পড়ুন- 
 
মহানায়ক যিনি, তিনি কি আর জনরুচি বোঝেন না? মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার তলায় চব্বিশ ঘণ্টা অহরহ যাঁকে পিষে যেতে হচ্ছে তিনি তা যথেষ্ট ভালো বুঝতেন। নিজে ওরকম মাপের শিল্পী হয়েও গুণগ্রাহী ছিলেন বীরেন ভদ্রর। অনুষ্ঠানের প্রস্তাব তাঁর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন অসীমা মুখোপাধ্যায়। বাংলা সুরের জগতে যাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। কিন্তু কিছুতেই রাজি হতে চাননি উত্তম। অসীমার স্মৃতিচারণে এ কথার স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। বারেবারে বলছিলেন, শ্রোতারা আমাকে এইধরনের সম্প্রচারে মেনে নেবে না। খোদ বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের কাছেও নাকি গিয়েছিলেন উত্তম, পরামর্শ নিতে। বীরেন বাবুকে আকাশবাণী কিছুই জানায়নি। সব শুনে উত্তমকে তিনিই সাহস দিলেন, ভরসা দিলেন। বরফ খানিকটা গলল। এদিকে অসীমা-হেমন্তের পীড়াপীড়িতে শেষ অবধি নিমরাজি হতে হল মহানায়ককে। স্ক্রিপ্ট লিখলেন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগীয় প্রধান ডঃ গোবিন্দলাল মুখোপাধ্যায়। লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে, মান্না দে, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, আরতি মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে গান করালেন হেমন্ত। চমৎকার পরিবেশনা। নাম দেওয়া হল 'দেবী দুর্গতিহারিণীম'। কিন্তু প্রায় অর্ধশতাব্দী পরে পঙ্কজ মল্লিক আরও একবার জিতে গেলেন। ব্রাহ্মণ সন্তান অরুণ চাটুজ্যের অনুষ্ঠান এক কায়েত কণ্ঠের জন্যে ছুঁড়ে ফেলে দিল বাঙালি। সে প্রত্যাখ্যানের পরিমাপের সঙ্গে আজকালকার সামাজিক মাধ্যমে ট্রোলেরও তুলনা হয় না। ট্রোল একটা ঝোঁক, ভাসমান। 'দেবী দুর্গতিহারিণীম'-এর প্রত্যাখ্যান বাঙালির সংস্কৃতির গভীর থেকে উঠে আসা। সেটা যে কোনো ঝোঁকের বশে নয়, তা বোঝা যায় তখনই, যখন আমরা নিজের দিকে চোখ ফেরাই। আজ একুশ শতকে বসে ঘটনার অর্ধশতক পরেও সে বিষয় নিয়ে আড্ডা জমছে আমাদের। এই আলোচনাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় সে অনুষ্ঠানের ব্যর্থতার বহর।
 
বীরেন বাবুর প্রতি অনাচার তো হয়ছিলই। তাঁকে একবারও জানাবার প্রয়োজন বোধ করেনি কর্তৃপক্ষ। সরকারের ঔদ্ধত্যের ছোঁয়া তখন তাদের মধ্যেও। অনুষ্ঠানের জন্য মাত্র দেড়শো টাকার একটি চেক দেওয়া হয়েছিল মহানায়ককে। তাই নিয়েও অসীমা দুঃখ করেছেন। এ কি উত্তম কুমারের সাম্মানিক হতে পারে? উত্তমের নামে সমস্ত প্রচার চালিয়ে ছিলেন কর্তৃপক্ষ। অথচ উত্তমের কণ্ঠস্বর সেই অনুষ্ঠানে খুব বেশি হলে ছিল দু' আড়াই মিনিটের। 'উত্তমকুমারের মহালয়া' প্রচারের ফলে যেটা হল, ব্যর্থতার দায় সুন্দরভাবে এড়িয়ে গেলেন তারা। যাবতীয় অপমান নিয়ে একা সরে এলেন উত্তম। একে তো আকস্মিক সিদ্ধান্ত। রিহার্সালের তেমন সময়ই ছিল না। 'মহিষাসুরমর্দিনী'র রিহার্সাল যেখানে ছিল কর্মযজ্ঞ! কতদিন আগের থেকে মহড়া শুরু হত! তার উপর পঙ্কজ কুমার মল্লিকের প্রচণ্ড কড়া নেতৃত্ব। তারই ফাঁক গলে বেরিয়ে পড়তেন শ্যামল মিত্র, খাওয়া দাওয়া হত সবাই মিলে। সে এক দেখার মতো ব্যাপার। সেখানে দু'দিনের নোটিশে হুট করে একটা অনুষ্ঠান পরিবেশন করা যায়?
 
আরও পড়ুন- 
 
যে সময় মহানায়ক একেবারে নুয়ে পড়েছেন তখন বেতার কর্তৃপক্ষের এই অবিবেচকের মতো কাজ তাঁকে আরও খানিকটা খাদের দিকে এগিয়ে দিয়েছিল। শ্রোতাদের অনুষ্ঠান গ্রহণ করতে না পারাটা দোষের নয়, বিশেষ করে বীরেনবাবুর মাইলফলক যখন তাঁদের সামনে ছিল। নতুন পরিবেশনা করার চেষ্টাটাও দোষের নয়। কিন্তু পঁয়তাল্লিশ বছর যাঁর গলা ভাঙিয়ে মহালয়া চালিয়ে এলেন, সেই শিল্পীকে খবরটা জানানোর প্রয়োজনটাও বোধ না করা অপরাধ। মহড়ার সময় না দিয়ে শিল্পীদের আকস্মিক অনুষ্ঠানের মুখে ঠেলে দেওয়া অপরাধ। সমস্ত শিল্পীদের বিন্দুমাত্র প্রচার না দিয়ে উত্তমের নামে মহালয়ার প্রচার চালানো অপরাধ। একটি অবসন্ন ক্লান্ত কাঁধ আশ্রয় করে নিজেদের আড়াল করে পরীক্ষা নিরীক্ষার বন্দুক চালানোটাও অপরাধ বৈকি। নিজেদের ব্যর্থতার দায় নিজেরা না নিতে পারাটাও অপরাধ। এতগুলো দোষে দোষী বেতার কর্তৃপক্ষকে কেউ কিন্তু দোষেনি তেমন। বাকি শিল্পীরা তো প্রচারই পাননি, কাজেই ব্যর্থতার দায়ে তাঁদেরও দায়ী করেনি জনতা। এক জীবনের প্রায় শেষ প্রান্তে এসে যাবতীয় লাঞ্ছনা অপমান মাথায় নিয়ে নীরবে সরে গিয়েছিলেন মহানায়ক। ক্লান্ত, ভগ্নহৃদয়, বিধ্বস্ত। কী লাভ এমন ক্ষমতা প্রদর্শনে? বীরেন বাবু বা মহানায়কের মতো শিল্পী—কারো প্রতিই সুবিচার হল কি? বরং দু'জনেরই অপমান। যে অপমানের গ্লানি জীবিতাবস্থায় মুছে ফেলতে পারেননি দুজনের কেউই। অথচ সময়ের পথে এতখানি হেঁটে এসে, আজ এটুকু স্বীকার করাই যায়, বিন্দুমাত্র দোষ তাঁদের ছিল না। দুজনেই নির্লজ্জ ক্ষমতা প্রদর্শনের শিকার হয়েছিলেন মাত্র।

More Articles