ব্যর্থ প্রেমিক, মাতাল! বাঙালির দেবদাস কেন বারবার ফিরে আসে ভারতীয় সিনেমায়?

‘দেবদাস’-কে নিয়ে তৈরি সমস্ত ফিল্মই উপন্যাসকে অনুসরণ করে ক্লাসিক্যাল ফরম্যাটে তৈরি হয়েছে, ব্যতিক্রম অনুরাগের ‘ডেভ ডি’।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর ২৫ বছর বয়সে (১৯০১) লেখা ‘দেবদাস’ উপন্যাসটি প্রকাশ করেন তাঁর ৪১ বছর বয়সে (১৯১৭)। শোনা যায়, শরৎবাবু মনে করতেন উপন্যাসটি তাঁর অল্পবয়সের দুর্বলতম লেখা, তাই ছাপানোর ব্যাপারে মনস্থির করতে তাঁর ১৬ বছর লেগে যায়। বন্ধু প্রমথনাথ ভট্টাচার্যকে ১৯১৩-তে লেখা এক চিঠিতে শরৎচন্দ্র লিখেছেন, "ওই বইটা (দেবদাস) একেবারে মাতাল হইয়া বোতল খাইয়া লেখা।" অথচ বাস্তব হল, যে, এই ‘দেবদাস’-ই ভারতীয় সাহিত্যে একটি কাল্ট উপন্যাস হয়ে উঠল আর ভারতীয় সিনেমায় ‘দেবদাস’ এক কাল্ট চরিত্র হয়ে গেল। দেবদাস তার গ্রাম্য জমিদারি জীবনে ছেড়ে বারবার শহরে গেছে, সে বিলেত বা কলকাতা যাইই হোক, শহরের এত টানাটানিতেও ছেঁড়েনি তাঁর মনের গভীরের ওই গ্রামজীবনের শিকড়। তাই মরার আগে সে গ্রামে ফিরতে চায় আর সেখানেই মরে। সময়টা ১৯০১, যখন নগরসভ্যতার আকর্ষণে মানুষ গ্রামজীবনের খোলস ছেড়ে নাগরিক হওয়ার ব্রতে শহরে ছুটে যাচ্ছে, সেই সময় দেবদাস বিলেত ও কলকাতার মতো দুটো শহর ঘুরেও শেষ পর্যন্ত ফিরে যাচ্ছে তার গ্রামে।

 

১৯২৭ সালে নির্বাক চলচ্চিত্রের যুগে নরেশ মিত্রর পরিচালনায় প্রথম তৈরি হয় ‘দেবদাস’। ১৯৩৫ সালে প্রমথেশ বড়ুয়া প্রথম সবাক ‘দেবদাস’ পরিচালনা করেন এবং দেবদাসের চরিত্রে উনিই অভিনয় করেন। সেই ছবি বিরাট জনপ্রিয়তা প্রায়। অসমের গৌরীপুরের জমিদারতনয়টি ‘দেবদাস’ নিয়ে বেশ অবসেসড ছিলেন, নিজেও ছিলেন দেবদাসের মতোই রোম্যান্টিক, তাই পর পর ৩ বছর ৩টি ফিল্ম তৈরি করলেন ‘দেবদাস’-কে নিয়ে,বাণিজ্যিক সাফল্যও পেয়েছিলেন। ১৯৩৬ সালে হিন্দি ‘দেবদাস’, কুন্দনলাল সায়গল হলেন দেবদাস। ১৯৩৭ সালে অসমিয়া ভাষায় তৈরি করলেন ‘দেবদাস’। তিনের দশকে তৈরি প্রমথেশের ফিল্ম দু'টি (বাংলা/হিন্দি) ভারতীয় সিনেমার পথিকৃৎ ফিল্ম হিসেবে বিবেচিত হল। ১৯৫৫ সালে আরেক বাঙালি পরিচালক বিমল রায় হিন্দিতে ‘দেবদাস’ (দিলীপকুমার) তৈরি করলেন, যা ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে অন্যতম ক্লাসিক ছবির স্বীকৃতি পেয়েছে।

 

১৯৭৯ সালে আরও একজন বাঙালি পরিচালক দিলীপ রায় তৈরি করলেন ‘দেবদাস’ (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়)। ২০০২ সালে সঞ্জয় লীলা বনশালি ‘দেবদাস’ তৈরি করেন শাহরুখ খানকে (দেবদাস) নিয়ে। ২০০৯ সালে অনুরাগ কাশ্যপ তৈরি করলেন ‘দেবদাস’, তবে এবার তার নাম ‘ডেভ ডি’। বলে রাখা ভালো, এই সময় ধরে তেলুগু, তামিল ও মালয়ালম ভাষাতেও ‘দেবদাস’-কে নিয়ে ফিল্ম হয়েছে, মানে নির্বাক যুগ থেকে ধরলে ৮২ বছর ধরে বাঙালি দেবদাসকে নিয়ে ফিল্ম তৈরি হচ্ছে ভারতের বিভিন্ন ভাষায়, ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা বইকি। ভারতের আর কোনও ভাষায় লেখা উপন্যাসের নায়ককে নিয়ে এত বছর ধরে ভারতজুড়ে এতগুলো সিনেমা হয়নি। এর সঙ্গে এও বলা দরকার, যে, ১৯৪৭-পরবর্তী পাকিস্তানে ও ১৯৭১-পরবর্তী বাংলাদেশেও ‘দেবদাস’ তৈরি হয়েছে।

 

আরও পড়ুন: বিপ্লবী অজয় মুখোপাধ্যায়কে বাঙালি ভুলে গেল অথবা ভুলিয়ে দেওয়া হল

 

‘দেবদাস’-কে নিয়ে তৈরি সমস্ত ফিল্মই উপন্যাসকে অনুসরণ করে ক্লাসিক্যাল ফরম্যাটে তৈরি হয়েছে, ব্যতিক্রম অনুরাগের ‘ডেভ ডি’। শরৎবাবুর কাল্ট উপন্যাসটিকে ভিত্তি করে তাঁর ফিল্মটিকে ক্লাসিক্যাল ও মডার্ন যুগ পেরিয়ে যে উত্তরাধুনিক প্রেক্ষিতে স্থাপন করেছেন অনুরাগ, তাতে সময়ের হাতে ক্ষয়ে যাওয়া ‘দেবদাস’ চরিত্রটির এক ধরনের রেজারেকশন বা পুনরুত্থান হয়েছে। এই ডিজিটাল যুগে, আশা করা যায়, পরবর্তী প্রজন্মের এক বিশেষ ধরনের সিনেফিলরা দেখবে এই উত্তরাধুনিক ‘দেবদাস’-কে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ উৎসাহী হয়ে মূল উপন্যাসটি পড়তেও পারে।

 

ছবির টাইটেলেই অনুরাগ ফিল্মটিকে তাঁর আগের সমস্ত জঁর থেকে বিযুক্ত করেছেন, বাঙালির ‘দেবদাস’-কে ইংরেজি ‘ডেভ ডি’ করে। এক ঝলক দেখে নেওয়া যাক গল্পের কাঠামোটি।

 

চণ্ডীগড়ের ডেভ ডি (অভয় দেওল) বড়লোক বাপের অকর্মণ্য, নেশাখোর, অহংকারী ছেলে। যে পাড়ার মেয়ে পারমিন্দরের (পারো/ মাহি গিল) সঙ্গে প্রেম করে। ছেলের ভবিষ্যত অন্ধকার দেখে বাপ ভাবে, ছেলেকে লন্ডনে পাঠিয়ে যদি কিছু হিল্লে হয়। লন্ডন থেকে ফিরে এল যে ডেভ, সে আরও একরোখা ও অহংকারী। সে পারোর সঙ্গে প্রেম করে এবং সেক্সও করে। এই সময় ডেভ–এর কানে আসে যে যখন সে ছিল না, সেই সময় পারো আরও অনেকের সঙ্গে শুয়েছে। এই নিয়ে পারোর সঙ্গে তার অশান্তি। পারো এই অভিযোগের কী উত্তর দেবে? কারণ পুরোটাই তো মিথ্যে। ডেভ একথা মানতে পারে না, শেষ পর্যন্ত পারোর অন্য একজনের সঙ্গে বিয়ে হয়। এই বিয়েতে ডেভ ভেঙে পড়ে ও ড্রাগ আর অ্যালকোহলে মুক্তি খোঁজে।

 

জন্মসূত্রে আধা ইউরোপিয়ান লেনি (চন্দ্রমুখী/ কাল্কি কোয়েচিন) দিল্লির এক ছাত্রী, যে তার চেয়ে বয়সে অনেক বড় এক পুরুষের সঙ্গে প্রেম করে। তাদের সেক্স ভিডিওর এমএমএস কীভাবে যেন লিক হয়ে যায় এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় সেটি ভাইরাল হয়। যে ভিডিওটি লেনির বাবার চোখে পড়ে, এবং তিনি লজ্জায় আত্মঘাতী হন। লেনির পরিবার লোকলজ্জা এড়াতে তাকে একটি মফস্বল শহরে থাকতে বাধ্য করে, লেনি পরিবারকে প্রত্যাখ্যান করে চন্দা নাম নিয়ে স্বেচ্ছায় যৌনকর্মীর পেশা বেছে নেয় আর সেই পেশায় যথেষ্ট টাকা রোজগার করে, কারণ তাকে মেমসাহেবের মতো দেখতে। লেনি রাতে বেশ্যা আর দিনের বেলা কলেজের ছাত্রী। এই লেনির ঘরেই একদিন নেশায় চুর ডেভ এসে পৌঁছয়। তাকে লেনির ঘরে পৌঁছে দেয় চুনিলাল। তারপর থেকে ডেভ চন্দার সঙ্গে নেশা করে, সেক্স করে এবং শেষ পর্যন্ত তার প্রেমে পড়ে। তাকে তার পেশা ছেড়ে দিতে বলে, চন্দা রাজি নয়। চন্দাকে ত্যাগ করে ডেভ ক্রমশ নেশার হাত ধরে নিজেকে ধ্বংস করে দিতে চায়। জীবনের এক চরম সংকটে ডেভ আবার ফিরে আসে চন্দার কাছে, বেঁচে যায়, শুরু করে এক নতুন জীবন। সিনেমার ডেভ ডি উপন্যাসের দেবদাসের মতো অত্যধিক মদ্যপানে সিরোসিস অফ লিভার রোগে মরে যায় না।

 

এই ফিল্মের আলো আর ক্যামেরার ব্যবহারে অনুরাগ ব্রিটিশ পরিচালক ড্যানি বয়েলের বিখ্যাত নেশাড়ু ফিল্ম ‘ট্রেনস্পটিং’-কে (আর্ভিন ওয়েলশের উপন্যাস) অনুসরণ করেছেন, ওই রকম ট্রিপি আলো, নেশাগ্রস্ত ক্যামেরার নড়াচড়া দেখা যায় ‘ডেভ ডি’-তেও। যাঁরা ফিল্মটি দেখেছেন, তাঁরা আন্দাজ করতে পারবেন। এমনকী ফিল্মটির জন্য স্পেশ্যাল এফেক্টসের বাজেট ছিল না বলে, শোনা যায়, ড্যানি বয়েলের পরামর্শমতো স্টিল ক্যামেরা ব্যবহার করেন অনুরাগ স্পেশ্যাল এফেক্টস হিসেবে।

 

‘ডেভ ডি’-র আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল, এটি একটি মিউজিক্যাল ফিল্ম। ১৮টা ট্র্যাক আছে ফিল্মটিতে। না, আর পাঁচটা বলিউডি সিনেমার মতো একের পর এক নায়ক–নায়িকা–বিরহী প্রেমিকারা গান গেয়ে যাচ্ছে, এরকম নয়। অনুরাগ অনেকগুলো মিউজিক জঁরকে ব্যবহার করেছেন, কখনও চরিত্রের গলায়, কখনও থিম সং, কখনও অ্যাম্বিয়েন্ট সং আর পরিচালকের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সংগীত পরিচালক অমিত ত্রিবেদী তেমন সব এক্সপেরিমেন্ট করেছেন মিউজিক নিয়ে, নিজে গেয়েওছেন। এই ফিল্মটির সঙ্গে ৪ জন বাঙালি জড়িয়ে আছেন। লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, চুনিলাল চরিত্রে অভিনেতা দিব্যেন্দু ভট্টাচার্য, যে গানটি সবচেয়ে হিট করেছিল, সেই গানটির সঙ্গে জড়িয়ে আছেন দু’জন বাঙালি। গানটি লিখেছেন অমিতাভ ভট্টাচার্য আর গেয়েছেন আমাদের বন্ধু কলকাতার বনি চক্রবর্তী, যে কিছুদিন গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের কাছে গানও গেয়েছিল, এখন মুম্বইতে থাকে। রক ব্যান্ড জঁরের সেই গানটি হল ‘তওবা তেরা জ্বলওয়া/তওবা তেরা পেয়ার/তেরা ইমোশনাল অত্যাচার’। যে গানটি বিয়ের বারাতির গায়ক চরিত্রে সিনেমায় শোনা যায় নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকির গলায়। দেবদাসের জীবনটাই ইমোশনের খেলা। তাই অনুরাগও ফিল্মজুড়ে দেখান ডেভ ডি-র নিরন্তর নেশা করে যাওয়া আর ওই ইমোশনাল অত্যাচারের খেলাটা খেলেন সঙ্গে দর্শককের সঙ্গেও, তাকেও ওই ট্রিপের মধ্যে টেনে নিয়ে যান।

 

ভবিষ্যতে আর কি কেউ ‘দেবদাস’-কে নিয়ে সেরকম ফিল্ম তৈরি করবে?

 

গ্রাফিক্স: দীপ হাওলাদার

More Articles