ধর্মে মুসলমান, কণ্ঠে শিবের গীত, রাজস্থানের আশ্চর্য জাতি মাঙ্গানিয়ার

পশ্চিম রাজস্থানের মরুপ্রান্তরে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা বারমের ও জয়সলমিরের নানা স্থানে মাঙ্গানিয়ার লোকশিল্পীদের এক একটা গ্রাম। সেখানে তাদের গান ও জীবনযাপন ছিল আমাদের কাজের উপজীব্য বিষয়।

 

সে এক মারাত্মক গরমের মধ্যে ছবি তুলতে গিয়েছি, পায়ের তলায় বালি আর যাকে বলে, মাথার ওপর প্রখরতার চূড়ান্ত অবস্থায় থাকা সূর্যের সঙ্গে ঘর। তার সঙ্গে ছিল বাঁধাধরা সময়ের চাপ। পশ্চিম রাজস্থানের মরুপ্রান্তরে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা বারমের ও জয়সলমিরের নানা স্থানে মাঙ্গানিয়ার লোকশিল্পীদের এক একটা গ্রাম। সেখানে তাদের গান ও জীবনযাপন ছিল আমাদের কাজের উপজীব্য বিষয়। সেই কাজ করতে গিয়ে আমাকে প্রথমেই যেটা বিস্মিত করে, তা হলো মাঙ্গানিয়ার শিল্পীদের গানের নানা রকম প্রকারভেদ। যা এক বিরাট পরিব্রাজনের ফলশ্রুতি। এর ধারাবাহিকতা চলে আসছে দশকের পর দশক, পরিবার থেকে পরিবারে, গুরু-শিষ্য পরম্পরায়। এদের আবার দেখা মিলেছে পাকিস্তানের সীমান্ত বরাবর সিন্ধ প্রদেশের থারপারকার এবং সাঙ্গহার জেলায়। এই জনগোষ্ঠী মূলত মুসলমান ধর্মাচারি। কিন্তু সেভাবে নামাজি নয় সকলে।

এদের জীবন-জীবিকা সম্পূর্ণতই সংগীত নির্ভর।গবেষকরা প্রাথমিকভাবে এদের উৎস হিসেবে যাযাবরদের সঙ্গে মিল পেয়েছে। তবে তখন তারা ছিল ভ্রাম্যমান। পরবর্তীতে এদের পৃষ্ঠপোষকতা করতে এগিয়ে আসে রাজপুত যজমানরা। এরাই এদের থাকার জায়গা দেয়, ঘর বানিয়ে দেয়, বছরভর টাকা জোগায় আর পরিবর্তে তাদের বিয়ে, অন্নপ্রাশন, উৎসবে মাঙ্গানিয়ার শিল্পীরা গানবাজনা করে। প্রত্যেক মাঙ্গানিয়ার শিল্পীর আলাদা আলাদা যজমান আছে। আর আছে যজমানের জন্য তাদের অপার মান্যতা।

শুরুতেই ইঙ্গিত করেছি, ওদের বৈচিত্র্যময় গান নিয়ে। এরা সুফি আর কাওয়ালি যেমন গায়, তেমনই মীরা বা কবীরের ভজনও গায় আবার গনেশ বন্দনা থেকে শিবের উপাসনাও চলে আসে এদের সুরে-তালে, যেভাবে আসে প্রকৃতি, প্রেম আর উৎসবমুখরতা নিয়ে নানা পদ আর লোককথা। মাঙ্গানিয়ারদের মধ্যে অসাধারণ সব জনপ্রিয় শিল্পী আছেন। শুধু নিজেদের যজমানদের গান শোনানোই নয়, এরা সারা পৃথিবীতে অনুষ্ঠান করে বেড়ায়। আপাতভাবে সেমি-ক্লাসিকাল মনে হলেও আসলে মাঙ্গানিয়ারদের গান হলো প্রান্তিক জীবনের লোকগান যা প্রতি প্রহরে নির্মিত হয় সুরসপ্তকের গভীর চলাচল থেকে। তার হয়তো কোনও সংগঠিত ব্যাকরণ নেই। কিন্তু সুপ্রাচীন ধারাবাহিকতা আছে, সুর-সংশ্লেষ আছে, তালের আত্মস্থতা আছে।

আরও পড়ুন: যাযাবর, অচ্ছুৎ, ‘আধা-বেশ্যা’! যেভাবে বাঁচে রাজস্থানের কালবেলিয়ারা

এবার আসি ওদের গায়কী, কন্ঠস্বর আর ভাবের কথায়। এককথায় বলতে গেলে, লা জবাব! একেক জনের একেক রকম। হারওয়ারের গাজি খান মাঙ্গানিয়ার দেখেছি শুধু গান নয়, কী এক যেন নাটকীয়তায় সমৃদ্ধ সেই পারফরম্যান্স। উনি গান করতে করতে গান দেখান। মাঙ্গানিয়ার শিল্পীরা সাধারণত বসে গান করেন। কিন্তু গাজি খান তাঁর অঙ্গভঙ্গি ও হাতের নানা মুদ্রায় গানকে চিত্রিত করেন। গান করতে করতে তাঁর পাগড়ি ছুঁড়ে দেন দর্শকের দিকে। সেই বলিষ্ঠ ভঙ্গি এবং তীক্ষ্ম স্বরক্ষেপণ পদের প্রসারতাকে যেন লোকগাথায় চিহ্নিত করে। গাজি খান সাহেবের করা একাধিক গান ব্যবসায়ীক বিন্যাসে পরবর্তীতে বলিউড কাঁপিয়ে দিয়েছে। যেমন 'নিম্বুরা নিম্বুরা' গানটি। যা তিনি শিখেছিলেন তার মায়ের কাছ থেকে। তাঁর নামও কেউ উল্লেখ করেনি কখনও। দেখা হতে, আক্ষেপ করে বলেছিলেন, "গান গাও, মানুষকে শোনানোর জন্যই সংগীত। কিন্তু তার উৎস ও ঐতিহ্যকে তো ভুলে গেলে চলবে না!"

Manganiyar tribe

ছবি সৌজন্য: লেখক

 

আরও বহু মাঙ্গানিয়ার শিল্পীদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। মুলতান খান, পেঁপে খান, বারনার গাজি খান, খরতালের বিস্ময় গফুর খান- এমন বহু মাঙ্গানিয়ার গুরুদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছি, গান শুনেছি আর ছবি তুলেছি। মাঙ্গানিয়ার গানে খরতাল ছাড়াও হারমোনিয়াম ও ঢোলকের ব্যবহার হয়। আর ব্যবহৃত হয় খামাইচা। এই যন্ত্রটি তুরস্ক, কুর্দিস, আজারবাইজান, আর্মেনিয়ান ও পার্সিয়ান লোকসংগীতে ব্যবহার হতো। আজ ক্রমেই অপ্রচলিত হয়ে পড়েছে। এটা একটা তারের যন্ত্র, যা ছড় দিয়ে বাজানো হয়। খামাইচা তৈরি করার কারিগরও আজ অপ্রতুল। অসম্ভব মিষ্টি এই বাদ্যযন্ত্রটি চড়া থেকে খাদে নিপুণভাবে বাজানো যায়।

মাঙ্গানিয়ারদের সঙ্গে লাঙ্গাদের এক ধরনের মিল আছে। রাজস্থানের এই দুই জনগোষ্ঠীর মিউজিসিয়ানরা প্রায় একই ধরনের গান গান। কখনও কখনও তাঁরা একই মঞ্চ ভাগ করে নেন‌। লাঙ্গাদের মতো মাঙ্গানিয়ার শিল্পীরাও সারা পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ান। সারা বছরই তাঁদের অনুষ্ঠান থাকে দেশে বিদেশে। এঁদের মধ্যে একাধিক শিল্পী আছেন, যাঁরা রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে ভূষিত।

এমনই এক মাঙ্গানিয়ার শিল্পীকে দিয়ে এই লেখা শেষ করব। তিনি হলেন মাঙ্গানিয়ার গুরু পদ্মশ্রী আনোয়ার খান মাঙ্গানিয়ার। সাংস্কৃতিক রাষ্ট্রদূত হিসেবে তিনি অন্তত পঞ্চাশটা দেশে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। অসম্ভব পরিশীলিত ও লব্ধপ্রতিষ্ঠ এই গায়কের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় ফরাসি দেশে। দেশেও নানা অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছে। সেবার সরাসরি উপস্থিত হয়েছিলাম বারমের শহরে তাঁর বাড়িতে। অনাড়ম্বর জীবনযাপনে এই সংগীত-গুরুকে দেখলে সত্যিই বিস্মিত হতে হয়।

আজকের দু'দিনের সংগীত শিল্পীদের যা ঠাটবাট দেখি! সেবার দিনের বেলা আনোয়ার খান সাহেবের বাড়িতে খানিকটা গানবাজনা আর খাওয়াদাওয়ার পর ওকে নিয়ে গিয়েছিলাম কিরাডু মন্দিরে। পাকিস্তান সীমান্তের কাছে এই মন্দিরেই ছিল আমাদের পূর্বনির্ধারিত শুটিংয়ের ব্যবস্থা। লম্বা রাস্তা কিরাডু। তাই সময় নষ্ট না করে গাড়িতেই একটা দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। সারা দেশের ধর্মভিত্তিক বিভাজন ও দাঙ্গা হাঙ্গামার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে প্রশ্ন করেছিলাম। প্রবীণতম এই সংগীত শিল্পী নির্দ্বিধায় বললেন, "এটা দেশের পক্ষে ভালো হচ্ছে না। ধর্ম যার যার তার তার। কে কীভাবে ধর্মাচরণ করবে, সেটা সেই ব্যক্তির ওপর নির্ভর করে। ধর্মের প্রেক্ষিতে মারামারি, হানাহানি আমার দেশের ঐতিহ্য নয়। যেমন আমার ধর্ম হলো আমার সংগীত। আমি সেই শিক্ষাই দিয়ে যাচ্ছি নতুন প্রজন্মকে।" কিরাডুতে পৌঁছে জিজ্ঞেস করলাম, কী গান গাইবেন? উনি বললেন, এখানে একটা শিবের উপাসনা গাইব।

আমি আবারও অবাক বনে যাই!

More Articles