সংরক্ষণ মানে অমরত্ব, কবে বুঝবে লিটল ম্যাগাজিন?

হার্ড কপি-র সংরক্ষণের কথাও বিবেচনায় রাখতে হবে।

কাজ মানে শুধু কাজ করা নয়, করা কাজ ধরে রাখাও এক কাজ। এই সময়ে দাঁড়িয়ে সম্ভবত আরও বড় কাজ। যা আমি করছি, যা আমরা করছি, তাকে আমাদেরই ধরে রাখতে হবে। সংরক্ষণের টানা পথে হাঁটতে হবে। শুনতে এসব বাণীসম বটে, কিন্তু আসলে নিখাদ কেজো কথা। জাতিগত অবস্থান থেকে এই দায় ও দায়িত্ব সত্যিই আজ নিতে হবে উৎসাহী বাঙালি পাঠক কিংবা বিদ্যাচর্চায় আগ্রহী জনকে। তা না হলে দেরি হয়ে যাবে। আর, কোনও একদিন দেখব, আমরা আমাদেরই হারিয়ে ফেলেছি।

 

বাংলার ছাপার ইতিহাস নিয়ে যাঁরা কাজ করেছেন, সেইসব গুণীজনেরা নিশ্চয় একথা স্বীকার করবেন যে, সেদিন ব্রিটিশ সরকারবাহাদুরের হাজারটা অন্যায় ধান্দার সঙ্গে জুড়েছিল সংরক্ষণের এক ‘বাতিক’; আর তা ছিল বলেই হয়তো সে-যুগের কাজগুলো আজ আমাদের পক্ষে চাক্ষুষ করতে পারা সহজতর হয়েছে। সুযোগ মিলেছে বাংলা বইপত্রের ইতিহাস-বিষয়ক বিবিধ গবেষণার। সেকালের জেমস লং থেকে এ-সময়ের গ্রাহাম শ- বাংলা বইয়ের তালিকা নির্মাণেও প্রাথমিকভাবে তাঁদের মুখাপেক্ষী হয়েই থাকতে হয়েছে বাঙালিকে। যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য কিংবা মোফাখখর হোসেন খানের মতো বিদ্বজ্জনের সুবিস্তৃত কাজের কথা মাথায় রাখলেও এই সত্য এড়িয়ে যাওয়া কঠিন। ব্রিটিশ লাইব্রেরির সাম্প্রতিককালের ‘টু সেঞ্চুরিজ অফ ইন্ডিয়ান প্রিন্ট’ কিংবা ‘এনডেনজার্ড আর্কাইভ’-এর মতো প্রকল্পগুলি আরও বেশি করে স্পষ্ট করে দেয় এই সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা। ক্রমাগত টের পাই, ডিজিটাইজেশনের মাধ্যমে দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থের ভাঁড়ার মানুষের সামনে হাট করে দেওয়ার সুফল। ক্রোমে শুধু নয়, আলো অপেরায়, মোজিলায় আসিতেছে!

 

নয়ের দশকে গ্রন্থাগারগুলোতে ডিজিটাইজেশন যখন শুরু হয়, একে একে পশ্চিমবঙ্গের গ্রন্থাগারগুলোও তাতে শামিল হতে থাকে। প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে কালক্রমে এর পরিধি আরও বেড়েছে। KOHA, DSPACE, LIBSYS ইত্যাদি সফ্টওয়্যারের ব্যবহারে গতি এসেছে। বিশ্বভারতী, কলকাতা কিংবা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এই প্রয়াসে যুক্ত হয়েছে। খড়্গপুর আইআইটি-র সহায়তায় ন্যাশনাল ডিজিটাল লাইব্রেরি অফ ইন্ডিয়া গড়ে উঠেছে। দুষ্প্রাপ্য নথি, কপিরাইটের মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়া বইয়ের সফ্ট কপি চাইলে ডাউনলোড করে ধরে রাখা যাচ্ছে নিজের কম্পিউটারের হার্ড ডিস্কে। আরও ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ার, ডিজিটাইজেশন আরও ত্রুটিবিহীন করার, মেটা ডেটার তথ্যাদি আরও সুবর্ণিত হওয়ার সুযোগ থাকলেও এখনও পর্যন্ত বাংলা ভাষায় ডিজিটাইজেশন যতটুকু সম্ভব হয়েছে, যতটা সহজে হাতের নাগালে এসে গিয়েছে বইপত্রের বিপুল সংগ্রহ, তা-ও নেহাত কম পাওয়া নয়!

 

আরও পড়ুন: বাংলা ভাষা একটি চব্বিশ ঘণ্টার বিনোদন প্যাকেজ

 

আবিশ্ব ডিজিটাইজেশনের প্রয়োজনীয়তা যখন অনুভূত হচ্ছে, সেখানে বাংলা লিটল ম্যাগাজিনগুলো কোন স্থানাঙ্কে দাঁড়িয়ে? দীর্ঘদিন ধরে যে অসামান্য কাজকর্ম ছোট পত্রিকার দুনিয়ায় হয়ে এসেছে, আজও কিছু কিছু হচ্ছে, বাঙালির স্বভাবসিদ্ধ নিস্পৃহতায় তাকে হারিয়ে যেতে দেওয়া উচিত কাজ বলে মনে হয় না। দুই বাংলা ও তার বাইরে থেকেও বাংলা ভাষায় নিরন্তরভাবে অজস্র কাজ করেছে লিটল ম্যাগাজিন। তবে কি না, যা ধরে রাখা গিয়েছে, তার চেয়ে ঢের বেশি ইতোমধ্যেই বোধহয় খোয়া গিয়েছে। তাই অবিলম্বে, ব্যাপকভাবে, এসবের সংরক্ষণ ও ডিজিটাইজেশন জরুরি। গবেষণামূলক গভীর কাজগুলো তো বটেই, পাতলা কিন্তু ধারালো সংখ্যাগুলোও আগামী প্রজন্মের জন্য ধরে রাখা দরকার। বস্তুত, আপাত অকিঞ্চিৎকর মুখচোরা একটি সংখ্যাকেও এই কাজে বাতিলের দলে ফেলা উচিত না। মহাকালের ভাঁড়ারে সে থাকুক। স্রেফ সমসময়কে সার্ভ করা লিটল ম্যাগাজিনের ধর্ম নয়; সে ভবিষ্যতের ইস্তাহার। চিরকাল সে চেয়েছে সময়ের থেকে এগিয়ে থাকতে। তাহলে এই ডিজিটাল প্রযুক্তির সদর্থক ব্যবহারেই-বা আজ কেন সে পিছিয়ে পড়বে?

 

কলকাতার সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস-এর তত্ত্বাবধানে একদা বাংলা সাময়িকপত্র ডিজিটাইজ করার যে-কাজ হয়, হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েব-ভাঁড়ার মারফত সেসব ঘাঁটতে গেলে উপলব্ধি করা যায়, এর প্রাসঙ্গিকতা ও সম্ভাবনার দিকটি। গুণমান যথাযথ নয়, তবু লিটল ম্যাগাজিনের ডিজিটাইজেশনের দিকটিতে আজ গুরুত্ব দিয়েছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ও। ছোট ছোট করে হলেও, অনেকের ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা এক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকর হতে পারে। ফেসবুকের ‘লিটল প্রচার লিটল প্রসার: in love of Little Magazines’ গ্রুপটিতেই যেমন দেখি ‘শ্রীময়ী’ পত্রিকার তরুণ সম্পাদক সুশোভন রায়চৌধুরীকে, এই ধরনের কাজে অবিরাম লেগে থাকতে; কখনও ডিজিটাইজেশন সম্পর্কিত, কখনও দেশ-বিদেশের পত্রপত্রিকার বিবিধ হদিশ দিয়ে আমাদের কুয়োর ব্যাসার্ধটি আরেকটু বড়ো করে নেওয়ার প্রয়াসে তিনি সর্বদা রত। অতিমারীর ঘরবন্দি সময়ে অগ্রজ বন্ধু প্রসূন মজুরদারকে দেখেছি কোনও প্রত্যক্ষ স্বার্থ ছাড়াই বাংলা ওয়েব ম্যাগাজিনগুলির একটি দীর্ঘ তালিকা বানিয়ে সামাজিক মাধ্যমে পেশ করতে; আমার পরিচিত একাধিক লেখক-গবেষককে ইতোমধ্যে সেই তালিকা ব্যবহার করে উপকৃত হতেও দেখেছি। এ-ধরনের ব্যক্তিগত উদ্যোগের পাশাপাশি সম্মিলিত প্রয়াসও আছে। পুরনো লিটল ম্যাগাজিনের লেখাপত্র থেকে পূর্ণাঙ্গ ই-বুক বানিয়ে ই-গ্রন্থাগার গড়ে তোলার কাজে সম্প্রতি হাত দিয়েছে ‘কেতাবি’। উপস্থিত অ্যান্ড্রয়েড এবং আইওএস-এ ব্যবহার করা যাচ্ছে এই অ্যাপটি। খানিক পেশাদার ঢঙেই যে তাঁরা ভাবার চেষ্টা করছেন, তা-ও আশার কথা।

 

 

Golpokobita Little magazine

 

এভাবেই ছোট-বড় প্রয়াসে এই কাজে আরও বহু মানুষের আজ এগিয়ে আসা প্রয়োজন। ‘পাশে আছি’ বলে পাশ কাটিয়ে যাওয়া নয়, দরকার সক্রিয় অংশগ্রহণ। গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারেন পত্রিকার সম্পাদকরাই। সামান্য শ্রমে নিজেদের পুরনো সংখ্যাগুলিই তো তাঁরা ডিজিটাইজ করে পাবলিক ডোমেনে ছাড়তে পারেন, ইন্টারনেট আর্কাইভে রেখে সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে পারেন। কিছুটা সময় ব্যয় করে বানিয়ে ফেলতে পারেন নিজের পত্রিকায় প্রকাশিত লেখাপত্রের বিস্তারিত ক্যাটালগ। এসবে আর্থিক ক্ষতি তো নেই-ই, বরং পরোক্ষে বিপণনের আরেক পথ খুলে দিতে পারে এমন উদ্যোগ। এতে বহু মানুষের কাছে খুব সহজে পৌঁছে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। আগামী পাঠকের জন্য আহ্বান আছে। আর আছে, ‘সংরক্ষণ’ মানে ‘অমরত্ব’– এই সহজ সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে পারার অপার্থিব স্বার্থ।

 

আরও কিছু মানুষের সাগ্রহ উপস্থিতি লিটল ম্যাগাজিনের এই কাজকে অনেক দূর এগিয়ে দিতে পারে। যাঁরা সংগ্রাহক, ভাষা ও শিল্প-সাহিত্যের চর্চায় তাঁদের অবদান ঢের। সেইসব ঐশ্বর্যও নির্দিষ্ট ঠিকানা আর ফেসবুকের পোস্টে আটকে না রেখে, যথাযথ স্বীকৃতি-সহ বৈদ্যুতিন মাধ্যমে সহজলভ্য করার প্রক্রিয়া আরও ব্যাপক হওয়া দরকার। আইনি স্বত্বের বিষয় বিবেচনা করে অতীতের দুর্মূল্য সব মণিমুক্তো প্রকাশ্যে আনা আমাদের আশু কর্তব্য। যে একক অধিকারের বোধ বহু সময়ই তাঁদের তাড়িত করে, তা থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। বিশেষত, আমাদের গ্রন্থাগার সংস্কৃতির আজকের এই ক্ষয়িষ্ণু হাল দেখে মনে হয়, সংগ্রাহকদের সদিচ্ছা থাকলে এইভাবে হয়তো একটা সমান্তরাল ব্যবস্থা ধীরে ধীরে গড়ে তোলার কথা ভাবা যায়।

 

এমন অনেক জলধারা একত্রে মিশলে স্রোত যে অচিরেই তৈরি হবে, সন্দেহ নেই। সেই স্রোতকে বিপুল তরঙ্গে পরিণত করার প্রেক্ষাপটও আমাদের তৈরি আছে। বাঙালির সৌভাগ্য যে, তার ভাষায় প্রকাশিত লিটল ম্যাগাজিন সংরক্ষণের জন্য একটি সংস্থা প্রায় ব্যক্তিগত উদ্যোগেই গত চুয়াল্লিশ বছর ধরে কাজ করে চলেছে। একইসঙ্গে বাঙালির দুর্ভাগ্য যে, বর্তমানে স্থানাভাব হয়ে উঠেছে সংস্থাটির প্রধান অন্তরায়। কলিকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র। সংস্থার কর্ণধার সন্দীপ দত্তের সঙ্গে সবিস্তার আলোচনায় জেনেছি, জায়গার জন্য বর্তমান রাজ্য সরকারের সঙ্গে একাধিকবার কথাবার্তা চালানো হলেও তা শেষমেষ ফলপ্রসূ হয়নি। ক্রাউড ফান্ডিং-এর চেষ্টা করে কিছু সাড়া মিললেও, পৌঁছনো যায়নি বিশেষ সুবিধেজনক অবস্থায়। কারণ, দু'-চার লাখ টাকায় এই সমস্যা মেটার নয়। অথচ বাংলা ভাষা ও বাঙালির বিদ্যাচর্চার স্বার্থেই প্রতিষ্ঠানটির সযত্ন দেখভাল জরুরি ছিল। এবং যা নিশ্চিতভাবেই একটি জাতির কর্তব্য; কারও ব্যক্তিগত দায় হতে পারে না।

 

লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরির স্থানাভাব মেটানো শুধু নয়, সেখানে থাকা পত্রিকাগুলোর যথাযথভাবে পুরোদস্তুর ক্যাটালগিং হওয়া দরকার। দরকার রক্ষণাবেক্ষণ। এবং অবশ্যই ডিজিটাইজেশন। বর্তমানে আনুমানিক নব্বইহাজার পত্রপত্রিকার সংখ্যা রয়েছে এই লাইব্রেরিতে। ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’, ‘বঙ্গদর্শন’, ‘প্রবাসী’ থেকে শুরু করে ‘সবুজ পত্র’, ‘কবিতা’, ‘কৃত্তিবাস’, ‘সুন্দরম’ কিংবা হালফিলের অধিকাংশ লিটল ম্যাগাজিন। সবচেয়ে বড় কথা, পরিচিত পত্রপত্রিকা ছাড়া এমন অনেক অনামী কাগজও রয়েছে, অন্যত্র হয়তো চট করে তার হদিশ পাওয়া মুশকিল। অতীতে ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন ফর দ্য আর্টস-এর আর্থিক সহায়তায় এখানে ডিজিটাইজেশনের কাজ শুরুও হয়। এ-পর্যন্ত কম-বেশি দেড় হাজার পত্রিকার সংখ্যা ডিজিটাইজ করা সম্পূর্ণ হয়েছে; অঙ্কের হিসেবে দেখলে যা মোট সংগ্রহের ১.৭ শতাংশমাত্র। অতএব, কী বিপুল সম্পদ ও সম্ভাবনা এই প্রতিষ্ঠানে লুকিয়ে রয়েছে তা সহজেই অনুমেয়!

 

একই সঙ্গে এ-কথাও মাথায় রাখা দরকার, ডিজিটাইজেশন সত্য, কিন্তু পৃথিবীর শেষ সত্য নয়। তাই উপযুক্ত পদ্ধতিতে এই হার্ড কপি-সমূহের সংরক্ষণও সমান প্রয়োজন। বিশেষত লিটল ম্যাগাজিনের ক্ষেত্রে তো বটেই। কারণ, শুধু টেক্সটটুকুই তার সর্বস্ব নয়। কাগজ, কালি, হরফ, বাঁধাই, তার ‘সস্তা’ নির্মাণে পরীক্ষামূলক যাবতীয় কারুকৌশলের স্পর্ধা নিশ্চিতভাবে চর্চা ও গবেষণার উপাদান। ‘সারস্বত প্রকাশ’, ‘কলকাতা’-র মতো পত্রিকাগুলোর এক-একটি সংখ্যা হাতে নিয়ে না দেখতে পারলে তাদের মাহাত্ম্যকে আংশিক ছোঁয়া যায় বড়জোর। কিংবা ধরা যাক, ‘গল্পকবিতা’। তার ১৯৬৮ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যাটিতে সূচিপত্রের শিরে লেখা হচ্ছে– ‘কোন রঙে কে’। তারপর গোলাপি, ধূসর, বাদামি, সাদা ইত্যাদি সাতটি রঙের উল্লেখ করে সাতটি স্তম্ভে জানানো হচ্ছে লেখকদের নাম। আর গোটা পত্রিকাটির এক-একটি ফর্মা ওই ওই রঙের কাগজে ছেপে, বাঁধিয়ে নির্মিত হচ্ছে উক্ত সংখ্যাটি। কোন বৈদ্যুতিন মাধ্যম পারবে এ-জিনিস স্পর্শ করে দেখার অনুভূতি এনে দিতে? কাজেই, হার্ড কপি-র সংরক্ষণের কথাও বিবেচনায় রাখতে হবে। এই সামগ্রিক ভাবনা থেকে এখনও যদি আমরা সমবেত, সচেষ্ট ও সরব না হতে পারি, তাহলে আফসোস ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে বলে মনে হয় না।

 

ছবি সৌজন্য: লেখক, গ্রাফিক্স: দীপ হাওলাদার

More Articles