বিরোধিতা মানেই মামলা, গ্রেপ্তার! রোদ্দুর রায় প্রথম নন, তৃণমূল আমলে বারবার ঘটেছে এমন

এই দেশের এবং এই রাজ্যের শাসক গণতন্ত্রের পরোয়া করে না, গণতন্ত্র কাকে বলে বোঝে না, সমালোচনা নেওয়ার ন‍্যূনতম ক্ষমতা তাদের নেই।

কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনা করে রাজ্য সরকার- এমনটাই কাম্য। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী তা করেনও। কিন্তু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সমালোচনা করবে কে? কেন্দ্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মুখর যাঁরা, তাঁরা অনেকেই বেঁচে নেই– এই অভিযোগ আনাই যায়, তা কিয়দংশে সত্যও। দীর্ঘদিন জেলেও আছেন বহু প্রতিবাদী। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এই নিয়ে প্রশ্নও তুলতে পারেন, কিন্তু তিনি নিজে কি প্রতিপ্রশ্ন সহ্য করতে পারেন? অথচ ক্ষমতাকে প্রশ্ন করার অধিকারই গণতান্ত্রিক বোধ। সংবিধান অনুযায়ী প্রত্যেক মানুষের বাকস্বাধীনতা রয়েছে। তা সে রোদ্দুর রায় হোন বা শিলাদিত্য চৌধুরী। এই রাজ্যের এক মন্ত্রী প্রকাশ্য সভায় "পুলিশকে বোম মারুন" বলার পরেও বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়ান, পুলিশ সেক্ষেত্রে নির্জীব, কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর কবিতার সমালোচনা করার পরপরই রোদ্দুর রায়কে ভিন রাজ্য থেকে তুলে এনে নানা আজগুবি মামলা দিতে বেশ সক্রিয় পুলিশ। এই ধরনের ঘটনা রাজ্যে যে প্রথম হলো, এমনটাও নয়। আর সমস্যার শুরু ঠিক এইখান থেকেই। ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসে তৃণমূল। ঠিক তার পরের বছর থেকেই আমরা এই জিনিস ঘটতে দেখেছি বারবার।

২০১২ সালের এপ্রিলে কার্টুন কাণ্ডে গ্রেফতার করা হয় অম্বিকেশ মহাপাত্রকে। তাঁর বিরুদ্ধে রুজু করা হয় ফৌজদারি মামলা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মুকুল রায় এবং দীনেশ ত্রিবেদীকে নিয়ে একটি ব্যাঙ্গাত্মক কার্টুন ইমেলে পাঠানোর ঘটনার পরেই তৃণমূলের এক কর্মীর এফআইআর-এর ভিত্তিতে গ্রেফতার হন অম্বিকেশ। ভোগান্তির সেই শুরু। ইতিমধ্যে তথ্যপ্রযুক্তির যে ৬৬এ ধারায় তাঁর বিরুদ্ধে চার্জশিট হয়েছিল, ২০১৫ সালে সুপ্রিম কোর্টে তা বাতিল হয়ে গিয়েছে। ২০২০ সালে অম্বিকেশের সহ-অভিযুক্ত সুব্রত সেনগুপ্ত মারা গিয়েছিলেন কোনও বিচার না পেয়েই। এক দশক হয়ে গেল, এখনও চলছে সেই মামলা। গত বছর ‘আংশিক’ ছাড় পেয়েছেন অম্বিকেশ। ক্রমাগত প্রতিবাদ করেছেন, কাজ হয়নি কিছুই। দিল্লিতে ধরনায় বসেছেন, তাতেও কিছু লাভ হয়নি। শাসকের ক্রোধের ক্ষমতা এতটাই, যে মানসিকভাবেও তাঁকে বিপর্যস্ত করার ছক সাজিয়েই বসা হয়েছিল। এই গ্রেফতার আদৌ আইনিভাবে বৈধ কি না, কলকাতা হাই কোর্ট এই প্রশ্ন তুলেছিল।

২০১২-র ১৩ এপ্রিল রাতে পূর্ব যাদবপুর থানা তাঁদের গ্রেফতার করে। পরে কোর্ট থেকে জামিনে ছাড়া পান তাঁরা। রাজ্য মানবাধিকার কমিশন এই ঘটনায় অম্বিকেশদের ৫০,০০০ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সুপারিশ করে রাজ্য সরকারকে। সুপারিশ খারিজ করে সরকার। এরপরে হাই কোর্টের দ্বারস্থ হন অম্বিকেশ। বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত নির্দেশ দেন, এক মাসের মধ্যে অম্বিকেশদের দেড় লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। তাও দিতে অস্বীকার করে সরকার। বরং দত্ত-এজলাসের নির্দেশ চ্যালেঞ্জ করে তারা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতির বেঞ্চে আপিল-মামলা করেছে। এরপরে প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লু এবং বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর আদালতে মামলা চলাকালীন অবধারিতভাবে গ্রেপ্তার সংক্রান্ত প্রশ্ন তোলা হয়। গ্রেপ্তারের ঘটনা সম্পূর্ণ অস্বীকার করে রাজ্যের অতিরিক্ত অ্যাডভোকেট লক্ষ্মী গুপ্ত দাবি করেন, নিরাপত্তার স্বার্থেই সেই রাতে দু'জনকে ‘নিরাপদ হেফাজত’-এ নিয়েছিল পুলিশ। “তাহলে জামিন নিয়ে বেরোতে হল কেন?”- বিচারপতিদের এই প্রশ্নের আর কোনও উত্তর দিতে পারেনি শাসক দলের উকিল। যাই হোক, সেই মামলাতে এখনও সুবিচার পাননি অম্বিকেশ।

আরও পড়ুন: ষড়যন্ত্র, হিংসায় উসকানি- অভিযোগ একাধিক! কী পরিণতি হবে রোদ্দুর রায়ের?

দ্বিতীয় ঘটনা ঠিক তার কয়েক মাস পরেই। ২০১২ সালের ৮ আগস্ট বেলপাহাড়িতে সভা করছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই সময় শিলাদিত্য চৌধুরী নামে এক কৃষক একটু জোরে মুখ্যমন্ত্রীকে সারের দাম এত বেশি কেন, সেই সম্বন্ধে প্রশ্ন করেন। সেই প্রশ্নই তাঁর দুর্ভোগ ডেকে আনে। সঙ্গে সঙ্গে "সভায় মাওবাদীরা লোক ঢুকিয়েছে” বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী। শিলাদিত্যকে ধরতে নির্দেশ দেন পুলিশদের। পুলিশ তাঁকে মঞ্চের পিছনে নিয়েও যায় ধরে। এরপরে পুলিশের দাবি অনুসারে নাকি ‘কড়া’ নিরাপত্তার ফাঁক গলে পালিয়ে যান শিলাদিত্য। শিলাদিত্যর পরিবারের বয়ানে, পুলিশ ডাহা মিথ্যে কথা বলছে। মামুলি কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে সেদিন শিলাদিত্যকে ছেড়েই দিয়েছিল পুলিশ।

এরপর, ১০ আগস্ট বিনপুর থেকে বছর আটত্রিশের এই যুবককে গ্রেফতার করা হয়। ঝাড়গ্রাম এসিজিএম আদালত তাঁর জামিনের আবেদন খারিজ করে দেয়। শিলাদিত্যর আইনজীবী চিরঞ্জীব ভৌমিক প্রশ্ন তোলেন, শিলাদিত্যকে পুলিশ সত্যিই মাওবাদী মনে করলে নিজেদের কাস্টডিতে নেওয়ার আবেদন করল না কেন? যে চারটি ধারায় তাঁকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল, তার মধ্যে দু'টি– ৩৩২ (কর্তব্যরত সরকারি কর্মীকে আঘাতের চেষ্টা) ও ৩৫৩ (কর্তব্যরত সরকারি কর্মীকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা) ছিল জামিন-অযোগ্য। শুনানিতে এই সংক্রান্ত প্রশ্নও তোলেন চিরঞ্জীববাবু। আঘাতই যদি করা হয়ে থাকে, তবে কোনও ইনজুরি রিপোর্ট জমা পড়ল না কেন? শেষ পর্যন্ত জামিন মঞ্জুর হয় শিলাদিত্যর।

রোদ্দুরের কাজকর্মের সঙ্গে বাঙালির পরিচয় বেশ কিছুদিনের। যদিও আদতে তিনি কোনও ব্যক্তি নন, রোদ্দুর রায় একটি অভিনীত চরিত্রমাত্র। নিজের গবেষণার সূত্রেই দীর্ঘদিন সামাজিক মাধ্যমে একটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছিলেন অনির্বাণ রায়। তারই কিছু মাধ্যম ভিডিও হিসেবে প্রকাশিত। এই নিয়ে যেমন চূড়ান্ত বিতর্ক হয়েছে, আবার রোদ্দুর অনেকের কাছেই আইকন হয়ে উঠেছেন। প্রজন্মে প্রজন্মে যে লড়াই, তাও নখ-দাঁত বের করে ফেলেছে এই ইস্যুতে।

এতদিন এই নিয়ে শাসক দলের তেমন মাথা ব্যথা ছিল না। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর সমালোচনার পরেই তাঁকে ‘হিংসা ছড়ানো, মহিলাদের অপমান’ ইত্যাদি ধারাতে গ্রেপ্তার করা হল, এই ঘটনা বরং ইতিপূর্বে উল্লিখিত দু'টি ঘটনার দিকেই ইঙ্গিত করে। উদাহরণ আসতে পারে শার্জিল ইমাম, উমর খালিদ, স্ট্যান স্বামী, গৌতম নভলাখাদেরও, যাঁরা কেন্দ্রীয় স‍রকারের রোষে বন্দি, স্ট্যান স্বামীর মতো কেউ কেউ মৃত্যুবরণও করেছেন। তাহলে কি এই কথা বলা যায় যে, এই দেশের এবং এই রাজ্যের শাসক গণতন্ত্রের পরোয়া করে না, গণতন্ত্র কাকে বলে বোঝে না, সমালোচনা নেওয়ার ন‍্যূনতম ক্ষমতা তাদের নেই, তাই বারবার সাহস করে যাঁরা প্রশ্ন তুলতে চান, তাঁদের অস্তিত্ব বিপন্ন করে সাধারণ মানুষের প্রশ্ন করার ক্ষমতাকে আরও ভয়ে তারা নষ্ট করে দিতে চায়?

 

More Articles