সবার মাঝে, সভার মাঝে, তবু একাকিত্বে ভুগছেন? কারণটা 'আদিম'

সকল লোকের মাঝে ব’সে
আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা?
আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
আমার পথেই শুধু বাধা?

-জীবনানন্দ দাশ

কবি ব্যক্তিগত নিঃসঙ্গতার অসুখের বয়ান লিখেছেন। তবে কেবল জীবনানন্দ দাশ নয়, এই বোধ তো প্রায় সকলেরই কখনও না কখনও এসেছে। ভিড়ের মধ্যেও একা লেগেছে আমাদের, চেনা-পরিচিতের মাঝে থেকে, পরিজনের মাঝে বসে থেকেও মনে হয়েছে বুঝি আমরা একা, খুব একা। এদিকে কেউ কেউ বাধ্য হয়ে একা থাকাকে মেনে নিয়েছেন, সবার আড়ালে গিয়ে, কেউ এই অস্বস্তিটা বয়ে বেড়াচ্ছেন। একা থাকার মধ্যে অনাবিল আনন্দ খুঁজে পেয়েছেন; খুঁজে পেয়েছেন প্রাণের আরাম, মনের শান্তি--এমনও রয়েছে। কথা হচ্ছে নির্জনতাপ্রিয় মানুষের এই অভিলাষকে একাকিত্ব বলা যায় না। একাকীত্ব স্বততই বেদনার। কেন এই অসুখে ভোগেন মানুষ, কোথায় রয়েছে এই একাকিত্বের বীজ?

বিজ্ঞান বলছে, একাকিত্বে ভোগার পিছনে নিউরোলজিক্যাল কারণ আছে, জিন এবং পরিবেশের প্রভাব। তার থেকেও আশ্চর্য বিষয়, একাকিত্বে ভোগার পিছনে রয়েছে দীর্ঘ অভিযোজনের ইতিহাস, এবং সেই ইতিহাস খুব সঙ্গত কারনে ছাপ ফেলে গেছে মানুষের জিনে। আর সেই জিন দীর্ঘ সময় ধরে এক প্রজন্ম থেকে বাহিত হয়েছে আরেক প্রজন্মে ।   

মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। আদিম মানুষের মধ্যে দল বেঁধে থাকবার প্রবণতা ছিলো অনেক বেশি: একসঙ্গে শিকার করা, তার থেকেও বড় কথা  হিংস্র বন্যপ্রাণী থেকে আত্মরক্ষা করাই সঙ্গবদ্ধ হয়ে থাকার প্রেরণা হয়েছিল। সেক্ষেত্রে সঙ্গবদ্ধ ভাবে বসবাস,পারস্পরিক নির্ভরতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল বেঁচে থাকার জন্য অত্যন্ত জরুরি। মানুষ তখনও সোজা হয়ে দাঁড়াতে শেখেনি, পালিয়ে বাঁচতে শেখেনি হিংস্র প্রাণী বা ছোটোখাটো প্রাকৃতিক দূর্যোগ থেকে।  ঠিক এই অবস্থায় যখন গোষ্ঠীর মধ্যে কোনও একটি সদস্য বিশ্বাসযোগ্যতা হারাত নিজের গোষ্ঠীর অন্য সদস্যদের প্রতি বা নিজের গোষ্ঠীর সদস্যদের থেকেই প্রাণনাশের আশঙ্কা থাকত, সে গোষ্ঠী থেকে আলাদা হয়ে যেত কেবল আত্মরক্ষার স্বার্থে।

বিজ্ঞানের ইতিহাসে চোখ রেখে আজকের গবেষকরা বলছেন, এই আলাদা হয়ে যাওয়ার ঘটনাই আজও কাজ করে একাকিত্ব-বোধের পেছনে। কিন্তু এইভাবে আলাদা হয়ে যাওয়ার বৃহত্তর উদ্দেশ্য কী ছিল? উদ্দ্যেশ্য একটাই - একটি নতুন গোষ্ঠী খুঁজে পাওয়া যা তার বেঁচে থাকা বা সার্ভাইভালের জন্যে আদর্শ। আর সে প্রকল্প স্বার্থক হলেই এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে সেই মানুষটির জিন বাহিত হবে এবং প্রজননের মাধ্যমে মানুষের সামগ্রিক জিনের গুণগত মানকে  সমৃদ্ধ করবে।

শুধু তাই-ই নয়, দেখা গেল যে মানুষগুলি সেই গোষ্ঠী থেকে আত্মরক্ষার তাগিদে আলাদা হয়ে গিয়েছিল, তারা সাম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে অনেক বেশি সজাগ হয়ে উঠল, যা ঘুরেফিরে আবার তাদের আত্মরক্ষার হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল। সংক্ষেপে বলতে গেলে, সেই সময় একাকিত্ব হয়ে উঠেছিল পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেওয়ার হাতিয়ার।

অন্য গবেষণায় আবার দেখা যাচ্ছে অভিযোজনগত কারণ ছাড়াও একাকিত্ব বংশানুক্রমিক ভাবে দেখা যেতে পারে। অর্থাৎ মা বা বাবা, কিংবা দুজনের হাত ধরেই এই জিনগুলি সন্তানের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে, যাতে অভিযোজন (evolution) ও অভিব্যক্তির (adaptation) নিয়ম মেনেই তারা একাকিত্বে ভোগার মধ্যে দিয়েই জীবনে নিজের বেড়ে ওঠা এবং বেঁচে থাকার জন্য আদর্শ সঙ্গী ও বন্ধু-বান্ধব খুঁজে পায়।

আমাদের একাকিত্বে ভোগার পিছনে কিন্তু একটি জিন কাজ করে না, কাজ করে একাধিক জিন।  কিছু মানুষদের মধ্যে সেই জিনগুলি একটু বেশিই সক্রিয় এবং তার পাশাপাশি কাজ করে পারিপার্শ্বিক অবস্থাও - ঠিক এই সমস্ত কারণেই কিছু মানুষ অন্যদের তুলনায়  একাকিত্বে বেশি ভোগেন।

কিছু কিছু মানুষ বিশেষ কিছু জিনের ধারক - এই মানুষগুলি যখন একা থাকেন, এই জিনগুলির নেতিবাচক প্রভাব ফলে: অর্থাৎ একাকিত্ব বোধ আরও গভীর হয়ে ওঠে। আবার, যখন এই মানুষগুলো আবার নিজের পছন্দের মানুষজনের সঙ্গে থাকে, তখন কিন্তু এই জিনগুলি ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে।

কোভিড মহামারীর কারণে সারা বিশ্বের প্রায় সবাই কখনও না কখনও একাকিত্বে ভুগেছেন। কারও ক্ষেত্রে একাকিত্বের মেঘ ঘন হয়ে ঘিরে ধরেছে, একাকিত্ব বাড়িয়ে তুলেছে মানসিক অবসাদের ঘটনা। আর তার পাশাপাশি প্রিয়জনের চলে যাওয়ার গভীর শোক একাকিত্বকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

যেহেতু একাকিত্ব, মহামারীর মত প্রসঙ্গগুলো এলো, এখানে একটি আশ্চর্যজনক তথ্য দেওয়া যাক। বিজ্ঞান বলছে, যে সমস্ত মানুষ একাকিত্বে ভোগেন বা একা থাকতে পারেন না , তাঁদের ক্ষেত্রে ইনফ্ল্যামেশন এবং ভাইরাস-ঘটিত সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্যে দায়ী জিনগুলি সক্রিয়তা কম দেখায়। বিজ্ঞানের ভাষায় জিনের সক্রিয়তা কমে যাওয়ার ঘটনাকে বলে 'ডাউনরেগুলেশন অফ জিন'। যাঁরা একাকিত্বে ভোগেন, ইনফ্ল্যামেশন বাড়তে পারে এমন জিন বা প্রো-ইনফ্ল্যামেটরি জিন বেশি সক্রিয়তা (আপ-রেগুলেশন অফ জিন) দেখায়।

আরও পড়ুন-রাজ্যে কোভিড বিধিনিষেধ, বেলাগাম ফূর্তির মাশুল? বছরের শুরুতেই কেন প্রয়োজন পড়ল?

বিজ্ঞানীদের মতে যাদের শরীরে ভাইরাস সংক্রমণ ও ইনফ্ল্যামেশন প্রতিরোধী জিন কম সক্রিয়, তাঁদের ক্ষেত্রে বেশি সামাজিক যোগাযোগের ফলে ভাইরাস সংক্রমণ বাড়তে পারে বলেই, তাঁদের মধ্যে সামাজিক ভাবে আলাদা হয়ে যাওয়ার (এবং ক্রমান্বয়ে একাকিত্বে ভোগা) প্রবণতা বেশি।

একাকিত্বে ভোগার কারণগুলি অভিযোজনগত দিক থেকে দেখতে গেলে দেখা যাবে, পরস্পর-বিমুখ বা প্যারাডক্সিক্যাল। অর্থাৎ একাকিত্বে ভোগা যেমন বেদনাদায়ক, একাকিত্বে ভুগতে ভুগতে যেমন অবসাদ গ্রাস করে, ঠিক এ-সবের পাশাপাশি একাকিত্ব আমাদেরকে বেঁচে থাকা এবং বেড়ে ওঠার জন্যে সঠিক মানুষ ও গোষ্ঠী খুঁজে নিতে সাহায্য করেছে সেই আদিম কাল থেকে। আজ আমাদের মস্তিষ্ক উন্নত মস্তিষ্ক আমাদেরকে একাকীত্বের অসুখে কাবু করে বুঝিয়ে দেয় - তুমি তোমার উপযুক্ত সংসর্গে নেই। 

একাকিত্বে ভোগার জটিল বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাকে একটি খুব সহজ উদাহরণ দিয়েই বোঝানো যায়। আমাদের তেতো স্বাদের প্রতি বেশি সংবেদী হয়ে ওঠা একটি অভিযোজনগত কারণ। সাধারণত বিষাক্ত জিনিস তেতো হয়, আর মানুষ যাতে বিষ চিনে তার হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারে, সেই জন্যেই আমাদের তেতো স্বাদের প্রতি অভিযোজনের কারণেই বেশি সংবেদী হয়ে ওঠা। আপনার কি তেতো স্বাদ পছন্দ? খুব সম্ভবত না। একাকিত্বের ঘটনাও ঠিক সেরকম!

More Articles