সত্যিই কি শুরু হয়ে গেল তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ?

ইস্তানবুলে রাশিয়া ও ইউক্রেনের বৈঠককে যুদ্ধ শেষের প্রথম ধাপ হিসেবে দেখছিলেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ, কিন্তু সে আশা দুরাশায় পরিণত হয়েছে। ১৫ এপ্রিল ইউক্রেনের নিক্ষেপ করা ক্ষেপণাস্ত্রে ধ্বংস হয় রুশ যুদ্ধজাহাজ ‘মস্কভা’। এই ঘটনার অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই রাশিয়ার একটি সরকারি টেলিভিশন চ্যানেল দাবি করে, ‘মস্কভা’ ধ্বংস হওয়ার মধ্যে দিয়েই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে গিয়েছে। ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত অধিকাংশ দেশই রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে জেলেন্সকির পক্ষ নিয়েছে। এছাড়াও ইউক্রেনকে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে আমেরিকা। রাষ্ট্রপুঞ্জেও সর্বতোভাবে কোণঠাসা করা হয়েছে ভ্লাদিমির পুতিনের দেশকে। পক্ষান্তরে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে পুতিনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সিরিয়ার মতো কয়েকটি দেশ। ফলত, ইউরোপে যে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতি একেবারে নেই, সেকথা জোর দিয়ে বলা চলে না। তবু প্রশ্ন থেকেই যায়, এখনই কি রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধকে ‘বিশ্বযুদ্ধ’-র তকমা দেওয়া চলে? এ-প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তর অনুসন্ধানের আগে একটু চোখ রাখা যাক ইতিহাসে।

১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর হিটলারের সৈন্যরা পোল্যান্ড আক্রমণ করে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত হয়। এর ঠিক আঠাশ দিনের মাথায় সমগ্র পোল্যান্ড চলে আসে জার্মানি ও রাশিয়ার দখলে। এরপর যুদ্ধের পরবর্তী প্রস্তুতির কথা মাথায় রেখে অল্প কয়েকদিনের জন্য যুদ্ধবিরতির পথে হাঁটেন অ্যাডলফ হিটলার। মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলি এই যুদ্ধবিরতি পর্বকে ‘ফোনি ওয়ার’ আখ্যা দেয়। চারের দশক থেকে অক্ষ ও মিত্রশক্তি নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শনের প্রক্রিয়া পুরোদমে শুরু করে দেয়। অক্ষশক্তির অন্তর্গত দেশগুলো ছিল জার্মানি, ইতালি এবং জাপান। পক্ষান্তরে মিত্রশক্তির সদস্য ছিল রাশিয়া, গ্রেট ব্রিটেন এবং ইউএসএ। যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে অক্ষশক্তি নিজেদের জয় সুনিশ্চিত করার পথেই অগ্রসর হচ্ছিল, কিন্তু নানা দিক থেকে তাদের ওপর চাপ এসে পড়ে। প্রথমেই ‘অপারেশন বারবারোসা’-য় রাশিয়ার কাছ থেকে বড় রকমের ধাক্কা খান হিটলার। ইতিমধ্যে জাপানের বিমানবাহিনী পার্ল হারবার আক্রমণ করবার ফলে যুদ্ধের শরিক হয়ে ওঠে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

কালক্রমে মিত্রশক্তির হাতে অক্ষশক্তি পরাজিত হতে আরম্ভ করে। ১৯৪৩ সালে ইংরেজ এবং মার্কিন সৈন্যরা সমবেতভাবে সিসিলি দখল করে। এর ফলে ইতালির একনায়ক বেনিটো মুসোলিনির পতন ঘটে। এর অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই জার্মানির দখল নেয় স্তালিনের লাল সৈন্যরা। সেখানকার চ্যান্সেলর অ্যাডলফ হিটলার শিয়রে সংকট দেখে আত্মহত্যা করেন। দীর্ঘ ছ'বছর পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে ঠিকই, কিন্তু তার বিভীষিকার ছাপ থেকে যায় সর্বত্র। ১৯৪৫ সালে হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে অ্যাটম বোমা নিক্ষেপ করে মার্কিন সৈন্য, যার ফলে মৃত্যু হয় ২৪ হাজারেরও বেশি মানুষের।

আরও পড়ুন: রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে আসলে জিতছে কি আমেরিকাই?

এবার দেখে নেওয়া যাক, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আদৌ কোনও মিল পাওয়া যাচ্ছে কি না। ৭ এপ্রিল ইউক্রেনের বিদেশমন্ত্রী দিমিত্র কুলেবা ন্যাটোর মুখ্যসচিবের সঙ্গে বৈঠকের পর টুইট করে জানান, এই যুদ্ধে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের প্রয়োজন, 'ওয়েপন্স, ওয়েপন্স অ্যান্ড ওয়েপন্স।' ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহের সিদ্ধান্ত নেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই ঘটনার ঠিক তিনদিনের মাথায়, অর্থাৎ ১০ এপ্রিল জেলেন্সকির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আচমকাই ইউক্রেনে হাজির হন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠক শেষে তিনি জানান জেলেন্সকির যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে সমস্তরকমভাবে সাহায্য করবে ইউকে। ইতিপূর্বে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনকে নৈতিক সমর্থন জানিয়েছে ন্যাটো। এছাড়াও মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলিকে 'যুদ্ধবাজ' রাশিয়ার সঙ্গে সমস্তরকম বাণিজ্যিক সম্পর্ক রদ করার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু এত তর্জন-গর্জনের পরেও ইউক্রেন বাদ দিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয়নি কেউই, বরং কূটনৈতিক চালেই পুতিনকে পরাস্ত করার পন্থা অবলম্বন করেছে ন্যাটোর অন্তর্গত দেশগুলো। অর্থাৎ, পরোক্ষভাবে যুদ্ধের অংশীদার হলেও ন্যাটো সদস্যদের মধ্যে কেউই প্রত্যক্ষভাবে পুতিনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ময়দানে নামেনি। বিভিন্ন অবস্থানে থাকা দেশগুলোর মধ্যে কোনওরকম স্পষ্ট বিভাজনও এই যুদ্ধে নেই, ফলত রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধকে ঠিক 'বিশ্বযুদ্ধ' বলা চলে কি না, তা নিয়ে সংশয় থেকে যায়। বরং ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’-র সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতির কিছু ক্ষেত্রে মিল লক্ষ করা যাচ্ছে। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জঠর থেকেই ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’ জন্ম নিয়েছিল। সোভিয়েত রাশিয়া আবিশ্ব পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের কাছে কিঞ্চিত ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। ফলত, ইউরোপ এবং আমেরিকার বেশ কিছু দেশ এককাট্টা হল। ইতিপূর্বে ব্রিটেন, ফ্রান্স, হল্যান্ড এবং বেলজিয়ামের উদ্যোগে ব্রাসেলস চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এবার তার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ল ইউএসএ, কানাডা, ডেনমার্ক এবং ইতালির মতো দেশগুলি। গড়ে উঠল ‘নর্থ অআটলান্টিক ট্রিটি অর্গ্যানাইজেশন’ বা ‘ন্যাটো’। স্তালিনের মৃত্যুর পর নিকিতা ক্রুশ্চেভের মতো নেতারা আমেরিকার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে উদ্যোগী হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই বোঝা যায়, সে গুড়ে বালি। পাঁচের দশকে ‘কিউবান মিসাইল ক্রাইসিস’-এর মধ্য দিয়ে ফিদেল কাস্ত্রোর কিউবাও ঠান্ডা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ‘কিউবান মিসাইল ক্রাইসিস’-কে কেন্দ্র করেই আমেরিকা এবং রাশিয়ার চাপানউতোর পৌঁছয় তুঙ্গে। কিন্তু ইতিমধ্যে ঘটে গিয়েছিল হিরোশিমা-নাগাসাকির বর্বরোচিত ঘটনা। এছাড়াও দু'তরফেরই নব্য নির্মিত হাইড্রোজেন বোমার প্রয়োগ ঘিরে কিছুটা সংশয় ছিল, সম্ভবত সেই কারণেই পরস্পরের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক যুদ্ধ চালালেও কেউ সম্মুখ সমরে আসেনি। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধেও দেখা যাচ্ছে এমন কূটনৈতিক কলহের প্রবণতা। বস্তুত, রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশ মনে করছেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনকে শিখণ্ডী হিসেবে ব্যবহার করছে ‘পশ্চিমা’ দেশগুলি। এবং এই দ্বিতীয় 'ঠান্ডা যুদ্ধ'-র ফলেই ইউরোপের পরিস্থিতি দিন দিন জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে।

রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের দু'-মাস পূর্ণ হতে আর কয়েকদিন মাত্র বাকি। ইতিমধ্যে দু'তরফের হতাহতের সংখ্যাই মাত্রা ছাড়িয়েছে। ইউক্রেনের শহরাঞ্চলগুলি রুশ অস্ত্রের আঘাতে কার্যত ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। এমতাবস্থায় দুই দেশের রাষ্ট্রনেতারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে যত শীঘ্র সমাধানসূত্র বের করবেন, তত মঙ্গল।  এই সংঘর্ষ যদি সত্যিই ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ’-র দিকে মোড় নেয়, তাহলে আপামর বিশ্ববাসীর জন্য তা মোটেই সুসংবাদ হবে না। 

More Articles