সরস্বতীপুজোয় খুঁজি ব্যক্তিগত বনলতা সেনকে, মুখে যার শ্রাবস্তীর কারুকাজ ব্রণ হয়ে ফুটে থাকে...

Saraswati Puja 2023: একটা অনভ্যস্ত পা শাড়ির কুঁচিতে হোঁচট খেতেই ধরে ফেলল অপটু এক সদ্য গোঁফ ওঠা হাত।

শীত চলে যাচ্ছে, বড় হচ্ছে দিন, বাড়ছে খেলার সময় ও রেগুলেটারের স্পর্ধা। নাগরিক রাস্তার পাশে যেটুকু ক্ষমাপ্রার্থী সবুজ রয়েছে, তারা তাদের সীমিত সাধ্যে সেজে উঠছে খানিকটা যেন শীতের স্মৃতিকে উপেক্ষা করেই। কয়েকদিন পর ধুলোর আশ্রয় হবে জেনেও নতুন পাতার জন্মে কোনও কুণ্ঠা নেই। সে তার নিজের খেয়ালেই মশগুল। বেরসিকরা বলে, এই সময় রোগ জীবাণু বাড়ে। বয়স কিন্তু জানে এই সময়ের প্রবলতম ছোঁয়াচে জীবাণুর নাম ভালোবাসা। শীত আর গ্রীষ্মের এই যে সন্ধিলগ্ন তা কখনও সখনও মনের যে সন্ধি ঘটিয়ে ফেলে তার সাক্ষী স্বয়ং কোকিল। সেই কোকিল যার বয়স হয়তো সময়ের চেয়েও বেশি। বাবা হঠাৎ কোত্থেকে শাড়ি নিয়ে আসে অফিস ফেরতা, মা-ই বা কেন হঠাৎ দাদার সঙ্গে শুতে বলে, তা ছোট মগজে না ঢুকলেও বয়ঃসন্ধি বুঝিয়ে দেয়। কান লাল লাগে নিজের, গলা শুকিয়ে যায় হঠাৎ হঠাৎ। এমন কিছু প্রশ্ন জন্ম নেয়, যার উত্তর নিজে খুঁজে বের করা ছাড়া কোনও উপায় থাকেনা। এইসব বাসন্তী ব্যাপার স্যাপার সামলাতেই দেবীপক্ষের বাইরে নিজের উদ্যোগেই যেন আমাদের জীবনে হাজির হন সরস্বতী।

যদিও সরস্বতীর সঙ্গে সম্পর্কটা ধীরে ধীরে সহজ হয় আমাদের। ছোটবেলায় সরস্বতীর সঙ্গে ভয়ের সমানুপাতিক সম্পর্ক থাকে। কারণ সরস্বতীর পিঠোপিঠি ভাই/বোনের নাম অ্যানুয়াল পরীক্ষা। আর পরীক্ষাকে ভয় না পাওয়ার মতো পামর ব্যাচে এক দু'জনের বেশি থাকে না। আমরা বাকিরা করজোরে বলতে বাধ্য হই “মা অঙ্কটা ম্যানেজ করে দাও, পরেরবার কুল পুজোর পর খাব, বাবা মা বেরিয়ে গেলেও পড়ব, টিভি দেখব না। এবারটা মা, অঙ্ক ম্যানেজ করে দাও।” এরপর বসন্তে বসন্তে বয়স বাড়ে, ভয় কমে, সরস্বতীর সঙ্গে কখন যেন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যেভাবে মা-ও একসময় বন্ধু হয়ে যান। আমরা বুঝি সরস্বতী আমাদের ফেল করাতে আসেন না, আসেন আমাদের উচাটন মনের সুরাহা করতে। আমদের প্রার্থনার ভাষা বাইরে থেকে শুনতে হয়তো একরকমই কিন্তু আমরা নিজেদের ভিতরে জানি প্রার্থনার মানে বদলে গেছে।

আরও পড়ুন- ডায়লগ মাথায়! নলিনকাকু স্টেজেই চেঁচিয়ে উঠল, “এই ছুরি ফেরত দে, খেলিস না…”

বাইরের লোক শুনছে, আপনি বলছেন "মা,অঙ্কটা ম্যানেজ করে দাও।” যে শুনছে সে ভাবছে ওহো! কী অধ্যাবসায়! সে তো আর বুঝছে না, আপনার প্রার্থনার অঙ্ক আর কোনও সাবজেক্ট নয়, অঙ্ক তার ছোটবেলার মানে ত্যাগ করেছে। এখন অঙ্ক মানে ‘কোল’। মাকে অঙ্ক ম্যানেজ করতে বলে আসলে একটা মোক্ষম কোল ম্যানেজ করতে অনুরোধ করছি। সেই কোল ঝিমলির না রিয়ার সেটা আমার আর মায়ের মধ্যেকার বোঝাপড়া। তা বাইরের মানুষের জন্য না হয় অনুচ্চারিতই থাকল!

আমরা যারা বেমক্কা বাংলা মিডিয়াম, মেয়ে দেখলে যাদের যাবতীয় বীরত্বের মুখে কুলুপ পড়ে যায়, সরস্বতী পুজো আমাদের এক আকাশ অজুহাত মেলামেশার। স্কুল থেকে পাঠানো হয় বিভিন্ন মেয়েদের স্কুলে নেমন্তন্ন করার জন্য, সেই স্কুলের গেট পার করার সময় নিজের সৌভাগ্যে নিজেই চমকে উঠি ক্ষণে ক্ষণে। সেই স্কুলের গেট, যার সামনে অবশ্যম্ভাবীভাবে সাইকেলের চেন গোলমালে নিত্য জর্জরিত, সেই গেট পার করার সময় নিজেকে কলম্বাসের দূর সম্পর্কের আত্মীয় মনে হতে থাকে। মেয়েদের গোপন পৃথিবীর পাসপোর্ট হস্তগত হয়েছে মনে হয়। মাঠ পার করার সময় লাজুক চোখ জানলার ধারে খোঁজে ব্যক্তিগত বনলতা সেনকে। মুখে যার শ্রাবস্তীর কারুকাজ বয়ঃসন্ধির ব্রণ হয়ে ফুটে রয়েছে।

আরও পড়ুন- হাতকাটা দুঃখরা ফুলহাতা হয় শীতেই, খোসা ছেড়ে আসে কমলালেবু, না হওয়া প্রেমরা…

আমরা যারা শাহরুখ, চন্দ্রবিন্দু যারা, প্রেম যে তাদের পেড়ে ফেলেছে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই! কিন্তু বাস্তব যে রামাধীর সিংয়ের ডায়লগ এটা বুঝতে বুঝতে ট্রেন স্টেশন ছেড়ে ধাঁ। এখন আর 'পলট' বললে হবে? মনে পড়ে, ছোটবেলায় নিজেদের করা পুজোয় শেষ মুহূর্তে বাজেট শেষ হয়ে যাওয়ার পর পারুলদির পৃথিবী বিখ্যাত কিপ্টে বাবার শালপাতার কারখানা থেকে বাটি চুরি করার সময় নিজেকে সূর্য সেন মনে হয়েছিল! কারখানাকে মনে হয়েছিল অস্ত্রাগার। অথচ প্রেমের দুটো কথা মুখ ফুটে বলতে যে অস্তগামী এই সূর্য তা কাকে বোঝাব? পুজোকে মর্নিং আর ডে তে ভাগ করবে এমন আহাম্মক সব যুগেই বিরল, তাই ওইদিন অ-এ অঞ্জলি, অ-এ অবাধ। খিচুড়ির দাগ লাগা চিঠি বিনিময়ের দিন।

আমি আজকের যুগকে কতটা চিনি তা নিয়ে নিজের মনেই সন্দেহ জেগেছিল। আজ নিশ্চয়ই আলাপ করার জন্য সরস্বতীকে উপলক্ষ্য করতে হয় না, সোশ্যাল মিডিয়া নিশ্চয়ই কমন বন্ধু, কমন উৎসাহ খুঁজে বের করতে সাহায্য করে! তাই প্রেম আর কিছু না হোক অনেক বেশি ডাটা সমৃদ্ধ অন্তত। আমাদের মতো ইডিয়ট নয়। অনেক স্মার্ট আজকের ভিকি, কৌশলগত ভাবেও এগিয়ে তাই। এটাই ভেবে যেতাম যে এদের আমি চিনি না, বদলাল একটা সরস্বতী পুজোতেই। একটা স্কুলে সরস্বতী পুজোয় আমি বিচারক হয়ে গেছি, খুবই সম্ভ্রান্ত স্কুল। চারপাশে ঝকঝকে মুখ, সপ্রতিভ চোখ দেখে আমারই চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। ঠিক সেই সময় ঘটল ঘটনাটা! একটা অনভ্যস্ত পা শাড়ির কুঁচিতে হোঁচট খেতেই ধরে ফেলল অপটু এক সদ্য গোঁফ ওঠা হাত। আমি মুহূর্তের মধ্যে দেখলাম, ওদের মুহূর্ত থেমে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে চিনে ফেললাম ওদের, ওরা তো প্রত্যেক যুগেই এক। ওই ছেলেটা ওই মুহূর্তে ওই মেয়েটির মতোই হয়ে গিয়েছিল। আস্ত একটা মিষ্টি ইডিয়ট!

More Articles