সাতকোশিয়ার অদ্ভুত হাতছানি

ডিসেম্বরের ২৫ তারিখ থেকে নতুন বছরের শুরু অবধি একটা বেশ ছুটি ছুটি আমেজ থাকে আকাশে বাতাসে। সরকারি অফিস দপ্তর থেকে ক্ষুদেদের স্কুল কলেজ সবই বন্ধ প্রায়। তাই প্রতিবছর এই সময়টায় মন উসখুস করে পরিবার সমেত কটাদিন একটু কাছেপিঠে থেকে ঘুরে আসতে। তার ওপর আবার এ'বছর কোরোনার চোখ রাঙানি খুবই কম, ভ্যাকসিনেশন অনেকটাই সম্পূর্ণ। মানুষের মনে ধীরে ধীরে ভীতি শেষ হয়ে আসছে, স্বাভাবিক হচ্ছে জনজীবন। এমতাবস্থায় ছুটির কটাদিন পশ্চিমবঙ্গের কাছেপিঠে থেকে ঘুরে আসতে চাইলে উড়িষ্যার সাতকোশিয়া কিন্তু কোনও বিকল্প নেই। 

উড়িষ্যার মহানদীর তীরে প্রায় হাজার বর্গকিলোমিটার জুড়ে রয়েছে সাতকোশিয়া অভয়ারণ্য। পূর্বঘাট পাহাড় চিরে বয়ে গেছে মহানদী, তৈরি হয়েছে গভীর গিরিখাত প্রায় সাত ক্রোশ জুড়ে। যার জন্য এই অঞ্চলের নাম হয়েছে সাতকোশিয়া। এই অভয়ারণ্যে ঢোকার পথ রয়েছে বেশ কয়েকটি, সেই পথের আশেপাশেই জঙ্গলের কাছাকাছি উড়িষ্যা বন উন্নয়ন দপ্তর ব্যবস্থা করেছে থাকার। বিভিন্ন বিভিন্ন সুন্দর সুন্দর রিসর্ট গড়ে উঠেছে পাহাড়ের ধাপ বেয়ে বেয়ে। একই সাথে নদী, অরণ্য আর পাহাড়ের সমাবেশ এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশের সৃষ্টি করেছে সাতকোশিয়ায়। পৌঁছানোর সাথে সাথে অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকতে হয় এই অদ্ভুত মিলন সঙ্গমে। এখানকার রিসর্টগুলো পাহাড়ের গায়ে গায়ে ধাপে ধাপে ছড়ানো। নদীর তীরে বালু তটে বিছিয়ে রাখা সারি সারি তাঁবু, পাহাড়ের গায়ে ইতিউতি ছড়িয়ে থাকা কটেজ, পর্যটকদের যেন এক অদৃশ্য অহ্বানে নিজের কাছে টেনে নেয়। 

এক একটা কটেজ পাহাড়ের গায়ে জঙ্গলে ঘেরা, তার বারান্দা থেকে দেখা যায় দূরের সাতকোশিয়া গর্জ, চোখে পড়ে অস্পষ্ট পূর্বঘাট পর্বতমালা। পাখির কলকলানিতে ভরে থাকে চারদিক, আর কত না রংবেরঙের প্রজাপতি। গাছের ফাঁকে ফাঁকে চোখে পড়ে বেশ বড় বড় কাঠবিড়ালির মত এক প্রাণী, কিন্তু কাঠবিড়ালির মত ধূসর রঙের নয়, চমৎকার গাঢ় খয়েরি রঙের। জায়ান্ট স্কুইরেল বলে যাদের। চারিদিক থেকে ভেসে আসে নাম না জানা কত না পাখির ডাক, জঙ্গল থেকে ভেসে আসে অচেনা প্রাণীর কলতান। বারান্দায় এক কাপ চা নিয়ে বসে পর্বতমালার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে নিরিবিলিতে প্রকৃতির বুকে শান্তির মধ্যে সময় কেটে যায় তার ধারণাই থাকে না। 

উড়িষ্যা বন উন্নয়ন দপ্তর এক অসাধারণ সুন্দর ব্যবস্থা চালু করেছেন এখানে। রিসর্টের পরিকাঠামো তৈরি করে পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছেন বনসংলগ্ন গ্রামের লোকেদের, অবশ্যই বনদপ্তরের নিয়ন্ত্রণে। ফল হয়েছে চমৎকার। গ্রামের হতদরিদ্র মানুষগুলির আর্থিক সংস্থান হয়েছে, আর তারাও মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসে নিপুণভাবে পরিচালনা করছে সবকিছু। একেবারে দেশীয় ধাঁচে তৈরি হয়েছে পুরো রিসর্টটি, রুচির ছাপ রয়েছে সর্বত্র। গ্রামের মেয়েরা প্রতি সকালে এসে আলপনা দিয়ে সাজিয়ে দিয়ে যায় পুরো রিসর্ট চত্বর। পর্যটকদের রান্নাবান্নার দায়িত্বও থাকে তাদের। আতিথেয়তা নিয়ে অভিযোগের কোনও সুযোগই নেই। 

সাতকোশিয়া মহানদীর গর্জে রয়েছে মোটরচালিত নৌকো করে নদীর বুকে ভ্রমণ করার সুব্যাবস্থা। মহানদীর দু'পাশে মাথাউচুঁ করে দাঁড়িয়ে থাকে পূর্বঘাটের পর্বত। পর্বতের পাদদেশে ঘন বনের অস্তিত্ব। তার মাঝে নৈঃশব্দে ভরপুর মহানদীর বুকে এগিয়ে চলে পর্যটকদের নৌকো। নৌকো ভ্রমণকালীন সৌভাগ্যবশত দেখা পাওয়া যেতে পারে হাতির পালের কিংবা ব্যাঘ্র দর্শনের। দুপারে সারি সারি ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে ঘড়িয়ালের দল। মহানদীর মিষ্টি জল যাদের খুব পছন্দের। গভীর অরণ্যের বিশালাকায় বৃক্ষগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকলেই দেখতে পাওয়া যায় হাজার হাজার রকমের রং-বেরঙের পাখি। ইন্ডিয়ান স্কিমার সবথেকে বেশি দেখা যায় সাতকোশিয়ায়। কমলা রঙের ঠোঁট তাদের। ঝাঁকে ঝাঁকে বসে থাকে গাছের ডালে। কাছে গেলেই হুশ করে উড়ে চলে যায়। মনে হয় যেন আকাশে কেউ সূর্যাস্তের কমলা রং ঢেলে দিল খানিকটা। কী যে মনোরম সেই দৃশ্য তা বোধহয় একমাত্র অবর্ণনীয় শব্দ দিয়েই বোঝানো সম্ভব। 

এ'ছাড়াও এখানে রয়েছে একটি ছোট্ট পাহাড়ি ঝর্ণা। রিসর্ট থেকে বনপথে মাইল তিনেক রাস্তা। লোকাল কোনও গাইডকে সঙ্গে করে সে পথ দিয়ে যেতে যেতে গা ছমছমে বন্য প্রাণীর উপস্থিতির গল্প শুনতে শুনতে এগিয়ে গেলে দর্শন মেলে বন মুরগীর, জংলী খরগোশ এর। আলো আঁধারী মেশানো পথ পেরিয়ে ঝর্ণার কাছে উপস্থিত হলে দেখা যায় এক তিরতিরে প্রবাহের অফুরন্ত কলকলানি। চারপাশের আরণ্যক পরিবেশ যাকে করে তুলেছে বড্ড মায়াময়। খানিকটা সময় সেখানে কাটিয়ে আবার রিসর্ট-এ ফিরে অপেক্ষা করতে হয় সন্ধ্যা নামার। আকাশের ক্যানভাসে শিল্পীর নিখুঁত টানের মতোই প্রতিটা রংয়ের উপস্থিতি অনুভব করতে করতে ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে আসে। গ্রামের লোকেরা পরিবেশ করেন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। নাচ, গান, পালা মিলিয়ে দারুণ লাগে তাদের অনুষ্ঠান। এখানকার প্রকৃতি, মানুষ, জঙ্গলের প্রাণী সব মিলে যেন সৃষ্টি হয়েছে এক ঐকতান – সতর্ক থাকতে হয় আমদের মত আগন্তুকেরা যেন সেই সুরের রেশ না কেটে দিই।

কীভাবে পৌঁছাবেন? :-
ভুবনেশ্বর বা কটক থেকে যাওয়া যায় সাতকোশিয়া। ভুবনেশ্বর থেকে বাঘামারি, কালাপাথর হয়ে দু ঘণ্টার গাড়ির পথ। কটক থেকে সময় লাগে গাড়িতে তিন ঘণ্টা। 

রিসর্ট বুকিং কীভাবে করবেন? :-
রিসর্টের বুকিং হয় অনলাইনে। গুগল করে জেনে নিতে পারেন বিভিন্ন রিসর্টের নাম ও ফোন নাম্বার। অথবা নিকটবর্তী কোনও ট্রাভেল এজেন্টের সাথে যোগাযোগ করেও ব্যবস্থা করে নিতে পারেন।

বেড়াতে যাওয়ার আদর্শ সময় কখন? :-
বেড়ানোর আদর্শ সময় শীতকাল। যদি নদীর চরে থাকতে চান, তবে ১৫ই নভেম্বরের পরে। আর যদি নিরিবিলি চান, তবে চলে যান নভেম্বরের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহে।

More Articles