হু হু করে বাড়বে রান্নার তেল, খাদ্যদ্রব্যের দাম? সংকটের মুখে ভারতীয় অর্থনীতি?

মূল্য বৃদ্ধি এবং শেয়ার বাজারে ধসের কারণ কি? শুধুই কি করোনা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘর্ষের জন্য এই পরিস্থিতি শেয়ার মার্কেটে?

লক্ষ্মীবারে ভারতীয় শেয়ার মার্কেটে বড় পতন। ভারতীয় শেয়ার সূচক সেনসেক্স একধাক্কায় নামল ১১০০ পয়েন্ট। লাগাতার পাঁচ দিন ধরে ধরে নেমেছে শেয়ারবাজারে। একই অবস্থা নিফটির ক্ষেত্রেও। একধাক্কায় অনেকটাই পতন হয়েছে নিফটির সূচকে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া-র তরফ থেকে রেপো রেট বৃদ্ধি করার পর থেকেই লাগাতার শেয়ার বাজারে ধস নামতে শুরু করেছে। গত এক সপ্তাহ ধরে শেয়ার বাজারের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছে সেনসেক্সের ওপর। বৃহস্পতিবার বাজার খুলতেই একের পর এক বড় সংস্থার শেয়ার কমতে শুরু করে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এই মুহূর্তে ভারতীয় শেয়ারে বিনিয়োগ করতে ভয় পাচ্ছে। তার কারণ অবশ্য ইউক্রেন এবং রাশিয়া যুদ্ধ। শুধুমাত্র যে এই কারণের জন্য শেয়ার বাজারে ধস নামছে, এটা বলা ভুল হবে।

 

বৃহস্পতিবার বাজার খুলতে না খুলতেই সবথেকে বেশি প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার শেয়ার। এই তালিকায় বেশ কিছু নামী সংস্থাও রয়েছে। রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ, আদিত্য বিড়লা গ্রুপের আলট্রাটেক সিমেন্ট, টাটা স্টিল, বাজাজ ফাইন্যান্স, লার্সেন টাব্রো, বাজাজ ফিনসার্ভ, ইন্ডাসইন্ড ব্যাঙ্ক-সহ একাধিক কঙ্গলোমেরেটস সংস্থার শেয়ারে নেমেছে ধস। গ্রিড সংস্থাগুলি লাভের মুখ দেখলেও, হংকংয়ের পরিস্থিতির কারণে শেয়ার মার্কেট বেশ কিছুটা নিচের দিকে। অনেক কোম্পানির অনেক বড় কন্সাইনমেন্ট আটকে রয়েছে। ফলে পরোক্ষভাবে ধস নেমেছে শেয়ার বাজারে।

 

রিজার্ভ ব্যাংকের রেপো রেট বৃদ্ধির পর থেকেই শেয়ার বাজারে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে। লাগাতার শেয়ার বাজারে শুরু হয়েছে পতন। একাধিক সংস্থা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। নিফটিতেও কোম্পানিগুলির শেয়ারের দাম ২ থেকে ৩ শতাংশ কমে গিয়েছে। তবে নিফটির ক্ষেত্রে সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আদানি পোর্ট। এই কোম্পানির নিফটি মার্কেটে কমতি হয়েছে প্রায় ৬ শতাংশ। ১১ এপ্রিল থেকে এখনও পর্যন্ত স্টক মার্কেট ইনভেস্টরদের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩৪ লক্ষ কোটি টাকা, যার মধ্যে শুধুমাত্র বৃহস্পতিবার ক্ষতি হলো ৫০০ কোটি। ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে দেশে। এরপর এক এক করে জিনিসের দাম বাড়া শুরু। সবথেকে বেশি বৃদ্ধি হয়েছে খাদ্যদ্রব্যের দামে। তার পাশাপাশি বেড়েছে জ্বালানি তেলের দাম। সোনার দাম ঊর্ধ্বমুখী। এই সমস্ত মূল্য বৃদ্ধি এবং শেয়ার বাজারে ধসের কারণ কি? শুধুই কি করোনা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘর্ষের জন্য এই পরিস্থিতি শেয়ার মার্কেটে?

 

আরও পড়ুন: পালাতে বাধ্য হয়েছেন রাষ্ট্রপতি, জ্বলছে প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি! কেন এমন হল শ্রীলঙ্কায়?

 

মার্কেট মুভার্স

 

আদানি পোর্ট থেকে শুরু করে ইন্ডাসইন্ড ব্যাঙ্ক, টাটা মোটর, টাটা স্টিল এবং হিন্দলকো কোম্পানিগুলির শেয়ারের পতন ঘটল প্রায় ৪ থেকে ৬ শতাংশ করে। উইপ্রো, ইকার মোটরস, এইচসিএল টেক, এবং টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিস যদিও বাজারের শেষে কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী গ্রাফ দেখেছে। সেটাও খুব একটা স্বস্তির বিষয় নয় এই সমস্ত কোম্পানির জন্য। খুব একটা লাভের মুখ দেখতে সক্ষম হচ্ছে না কোনও সংস্থা। ৫০টি স্টকের মধ্যে ৪৫টি স্টক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শুধুমাত্র বৃহস্পতিবার।

 

বিভিন্ন ব্যাংকের শেয়ার, মেটাল এবং ক্যাপিটাল গুডস, অটোমোবাইল, খনিজ এবং গ্যাস, পাওয়ার সেক্টর, ফার্মা কোম্পানি, রিয়েলটি সেক্টর, এফএমসিজি, কোম্পানিগুলির শেয়ারের পতন ঘটেছে প্রায় ৪ শতাংশ করে। এনএসই অগ্রিম পতনের অনুপাত পৌঁছে গিয়েছিল ২:৯ অনুপাতে। ৭৬০টি শেয়ার কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও, অনেকটাই পতন হলো ২,৬০১টি শেয়ারে, ৮৬টি শেয়ার ছিল অপরিবর্তিত। এছাড়াও, ১১২টি স্টক তাদের সর্বাধিক সীমায় পৌঁছলেও, ৫৩৩টি স্টক প্রায় শেষের মুখে। কিন্তু শেয়ার মার্কেটের এই ব্যাপক পতনের কারণ কি?

 

শেয়ার মার্কেটের পতনের প্রধান কিছু কারণ

 

  • আমেরিকায় মূল্যস্ফীতি

 

আমেরিকায় মূল্যস্ফীতির সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, এপ্রিল মাসে আমেরিকার মূল্যস্ফীতি ৮.৩ শতাংশে নেমে এসেছে। এই মূল্যস্ফীতি মার্চ মাসে ছিল ৮.৩ শতাংশ। তবে, মার্কেট বিশেষজ্ঞদের ধারণা ছিল, এই মূল্যস্ফীতির হার হয়তো ৮.১ শতাংশে পৌঁছবে। কিন্তু সেরকমটা হয়নি। এখনও পর্যন্ত, আমেরিকার মূল্যস্ফীতির হার কিন্তু স্বাভাবিকের থেকে বেশি। যখন বিশ্বের সবথেকে বড় অর্থনীতিতে কোনও সমস্যা হয়, তখন সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক ক্ষতি সামনে আসে। সেই পরিস্থিতি থেকে আমেরিকার মূল্যস্ফীতি আবারও আগের জায়গায় ফিরে আসা খুব একটা সহজ কাজ হবে বলে মনে করছেন না অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।

 

বুধবারের শিরোনাম থেকে পরিষ্কার হয়েছিল, আমেরিকায় মূল্যস্ফীতি খুব একটা ভালো জায়গায় নেই। গত মার্চ মাসে এই মূল্যস্ফীতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ৮.৫ শতাংশ। সিনিয়র মার্কেট এনালিস্ট এডওয়ার্ড ময়া-সহ আরও অনেকেই মনে করেছিলেন, এপ্রিল মাসে হয়তো এই মূল্যস্ফীতির পরিমাণ এতটাই কমে আসবে এবং ৮.১ শতাংশে দাঁড়াবে। কিন্তু সেরকমটা একেবারেই হলো না। গত কয়েক মাস ধরে ০.৩ থেকে ০.৬ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে আমেরিকার মূল্যস্ফীতি। প্রথমে আমেরিকার ওয়াল স্ট্রিট ভেবেছিল, এই মূল্যস্ফীতি খুব সহজেই কমে আসবে। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং করোনাভাইরাস পরিস্থিতির সহ আক্রমণে যা অবস্থা, তাতে আমেরিকার মূল্যস্ফীতি খুব একটা সহজে কমছে না।

 

  • শক্তিশালী হচ্ছে ডলার, এশিয়ার মার্কেট ডুবছে

 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যবৃদ্ধির দরুন মহার্ঘ হতে শুরু করেছে ডলার। একদিকে যেমন ডলারের দাম বাড়ছে, তেমনই এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মুদ্রার দাম কিন্তু ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। মার্কিন বাজারে দরপতন এরপর ডাও জোনস ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাভারেজ পয়েন্ট ৩২৬.৬৩ পয়েন্ট বা ১.০২ শতাংশ কমেছে। নাসদাক কম্পোজিট সূচক পড়েছে ৩.১৮ শতাংশ। মার্কেট ইকুইটি ধীরে ধীরে সমস্যার মধ্যে পড়তে শুরু করেছে এই ডলারের মূল্যবৃদ্ধির জন্য। এশিয়ার অধিকাংশ স্টক লাল কালির রেখায় চলছে। জাপানের বাইরে এশিয়া প্যাসিফিক শেয়ারের এমএসসিআই ইনডেক্স ০.৯২ শতাংশ কমে গিয়েছে। জাপানের নিক্কেই পড়েছে ১.০১ শতাংশ। হংকংয়ের হ্যাং সেং পড়েছে ১.০৫ শতাংশ। অন্যদিকে, দক্ষিণ কোরিয়ার কস্পি নেমেছে ০.৩৬ শতাংশ। এশিয়ার প্রত্যেকটি বড় বড় মার্কেটের শেয়ারের একই অবস্থা। আর সেই খাতায় নাম লিখিয়েছে ভারতের সেনসেক্স এবং নিফটিও।

 

মার্কিন মুদ্রা ডলার অনেকটাই শক্তিশালী হয়েছে এই মুহূর্তে। এই মুহূর্তে বিশ্বের প্রধান ৬টি মুদ্রার তালিকায় ডলারের সূচক উঠেছে ১০৩.৯২ অঙ্কে। বিগত দুই দশকের মধ্যে এটাই ডলারের সর্বোচ্চ স্তর। ডলারের এই রেকর্ড বৃদ্ধি মুদ্রা বাজারে অস্থিরতা বাড়াচ্ছে। ভারতীয় মুদ্রা ডলারের তুলনায় সর্বকালের সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছে দিয়েছে এই সপ্তাহে। ফলে একদিকে যেমন শেয়ার বাজারে বিরূপ প্রভাব পড়ছে, তেমনই কিন্তু মূল্যবৃদ্ধি শুরু হয়েছে গোটা বিশ্বে।

 

  • বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিক্রি বন্ধ

 

বিদেশি পোর্টফোলিও বিনিয়োগকারীরা গত কয়েক মাস ধরে ভারতীয় বাজারে শুধুমাত্র বিক্রেতা হিসেবে রয়ে গিয়েছে। বিক্রি অনেকাংশেই কমেছে। এফপিআই সেল কমার কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য ভারতীয় মার্কেট খুব একটা আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারছে না। প্রাথমিক তথ্য অনুসারে, ভারতের এফপিআই-গুলি বুধবার ৩,৬০৯.৩৫ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করেছে। অন্যদিকে মে মাসে এখনও পর্যন্ত ভারতীয় বাজার থেকে তুলতে পেরেছে ১৭,৪০৩ কোটি টাকা। এখনও পর্যন্ত ২০২২ সালে ভারতীয় মার্কেট থেকে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তুলতে পেরেছেন ১,৪৪,৫৬৫ টাকা।

 

  • ভারতেও মূল্যবৃদ্ধি কম নয়

 

বর্তমানে বিশ্ব বাজারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে কথা হলেও ভারতের মূল্যবৃদ্ধির অঙ্ক খুব একটা কম হবে না। অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের বর্তমান ধারণা অনুযায়ী ভারতীয় সিপিআই ইনডেক্স প্রকাশিত হলে ভারতীয় স্টক মার্কেট ইনভেস্টরদের জন্য বিষয়টা একেবারেই সুখকর হবে না। সম্ভাবনা রয়েছে, সংস্থাপক ইকুইটি এবং ভারতের সিপিআই এপ্রিল মাসে পৌঁছে যাবে ৭.৪ শতাংশের গণ্ডিতে। মার্চ মাসে এই সিপিআইয়ের পরিমাণ ছিল ৬.৯৫ শতাংশ। অর্থাৎ বৃদ্ধি হবে বেশ অনেকটাই। এর ফলে একদিকে যেমন বৃদ্ধি পাবে রান্নার তেলের দাম, তেমনই বৃদ্ধি পাবে জ্বালানি তেল, সাধারণ খাদ্যদ্রব্যের দাম এবং দাম বাড়বে সার্ভিস সেক্টরেও, যা ভারতীয় অর্থনীতির জন্য একেবারেই ভালো সংকেত নয়।

More Articles