নাটকের পথ তীক্ষ্ণ, মৃত্যুর পথ শান্ত, ফিরে দেখা নাট্যযোদ্ধা শাঁওলি মিত্রের যাত্রাপথ

পা টিপে টিপে, একটুও শব্দ না করে চলে গেলেন। রবিবারের সমস্ত দুপুরকে শান্ত রেখে, কারও “ঘুম ভাঙাবোনা বলে একটি পাতাও/ না ঝরিয়ে চলে যাচ্ছি”। চলে গেলেনও, “মৃত্যুর পাশ দিয়ে পা টিপে টিপে/ রক্তের পাশ দিয়ে পা টিপে টিপে” অতিরিক্ত সম্মান, গান স্যালুটের শব্দপ্রপাত, চ্যানেলে চ্যানেলে ব্রেকিংবাদ্যকে সামান্য সুযোগটুকু না দিয়ে চলে গেলেন শাঁওলি মিত্র, ৭৪ বছরে। বাবার মতোই। শান্ত সাধারণ হয়ে ১৯৯৭ সালে যে সিরিটি শ্মশানে আগুন হয়ে গেছিলেন শম্ভু মিত্র, ২০২২ এর জানুয়ারির শীতে সেখানেই উত্তাপ হয়ে গেলেন শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্রের কন্যা নাট্যকর্মী শাঁওলি মিত্র। শেষ ইচ্ছা সরকারি স্ট্যাম্প পেপারে লিখিত করে গিয়েছিলেন অভিনেত্রী শাঁওলি মিত্র। চেয়েছিলেন, “আমার একান্ত ইচ্ছে, আমার পিতাকে অনুসরণ করেই, মৃত্যুর পরে যতো দ্রুত সম্ভব আমার সৎকার সম্পন্ন করা হয়। ঐ শরীরটিকে প্রদর্শন করায় আমার নিতান্ত সংকোচ। ফুলভারের কোনও প্রয়োজন নেই। সামান্যভাবে সাধারণের অগোচরে যেন শেষকৃত্যটি সম্পন্ন করা হয়।” শাঁওলি মিত্রের এই ইচ্ছেকে সম্মান জানিয়েছেন তাঁর মানস পুত্র ও কন্যা সায়ক চক্রবর্তী এবং অর্পিতা ঘোষ। অন্ত্যেষ্টির পরেই মৃত্যুসংবাদ জেনেছে বাংলা, আক্ষেপ করেছে নাট্যজগত, কেউ কেউ চেনা বিতর্ককে জিইয়ে এনেছেন ফের।

টাটকা স্বাধীন একটা দেশে শাঁওলির জন্ম, সাল ১৯৪৮। বাবা মায়ের অভিনয় জলজ্যান্ত কিংবদন্তি হয়ে উঠেছে ততদিনে। অতএব নাটকই যাপন, থিয়েটারই জীবন। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাটকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর নাট্যচর্চার বাঁকে বাঁকে নতুন নতুন আবিষ্কার রেখে গিয়েছেন শাঁওলি। ১৯৪৩ সালে গণনাট্য সংঘের সঙ্গে যুক্ত হন বাবা শম্ভু মিত্র। মা তৃপ্তি মিত্রও আইপিটিএ-র নাটকে অভিনয় করে সাংগঠনিক বক্তব্যকে দৃঢ় করেছেন। নাট্যচর্চার শুরুর দিনগুলোতে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন শাঁওলি মিত্রও। পরে নিজের দল পঞ্চম বৈদিকের জন্ম হয়। শাঁওলি মিত্রের অভিনয় জীবনের শুরুর নেপথ্যের যোদ্ধা ছিলেন ঋত্বিককুমার ঘটক। ১৯৭৪ সালে ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্প’ সিনেমায় শাঁওলি মিত্রকে আবিষ্কার করে বাংলা চলচ্চিত্রের দীক্ষিত দর্শকরা। ঋত্বিক ঘটকের চেতনা দিয়ে তৈরি বঙ্গবালার চরিত্রটি ক্লাসিক সিনেমায় এবং বাংলা ভাগের ঘা নিয়ে বেঁচে থাকা মানুষদের মধ্যে এক শান্ত তোরঙ্গের মতো বেঁচে থাকে।

মঞ্চে শাঁওলি মিত্র এক দাপুটে চরিত্র। নাথবতী অনাথবৎ যারা প্রত্যক্ষ করেছেন সকলেই জানেন কেবল বাচন ও গলার বাঁক বদলে বদলে কীভাবে একাই শাঁওলি কখনও হয়ে উঠেছেন কর্ণ, কখনও পাঞ্চালী, কখনও যুধিষ্ঠির আবার কখনও শকুনি। কেন বারে বারে মহাভারত এবং দ্রৌপদী ফিরে আসে নাট্যচর্চায়, এই বিষয়ে নাথবতী অনাথবৎ প্রসঙ্গে শাঁওলি একবার জানিয়েছিলেন, “সময়টা আশি থেকে তিরাশি সাল। তখন মহিলাদের অবমাননাকর এমন বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছিল যা হয়তো দ্রৌপদীর অপমানের সঙ্গেই তুলনা করা যায়। আমার মনে হয়েছিল দ্রৌপদীর চরিত্রটা নিয়ে আমি কাজ করব।” শুধুই শিল্পের জন্য শিল্প নয়, শাঁওলির প্রতিটি নাটকই তাঁর নিজস্ব চেতনার, প্রতিবাদের মুখপত্র। আর তার সূত্রধর হয়ে এসেছে মহাভারতের নানা চরিত্র। সীতা কথা নাটকটি যার অন্যতম বড়ো উদাহরণ। শাঁওলি মিত্র খুব সুস্পষ্ট ভাবেই সামাজিক শ্রেণিবিভাজনের মধ্যে দ্বিতীয় লিঙ্গের প্রতি বিশেষ বৈষম্যমূলক বিভাজনকে তীব্র, তীক্ষ্ণ করে দেখিয়েছেন একের পর এক নাটকে। সামাজিক লিঙ্গ নির্মাণে সমাজের যে জ্যাঠাগিরি, লিঙ্গ রাজনীতির সেই ছবি ‘পুতুলখেলা’ নাটকের ক্যানভাসে এঁকেছিলেন অভিনেত্রী, নাট্যকর্মী শাঁওলি। ‘ডলস হাউজ’ অবলম্বনে বাবার লেখা ‘পুতুলখেলা’ নাটকে নোরা চরিত্রে শাঁওলি মিত্রের অভিনয় নাট্যকর্মীদের কাছে এক মাইলস্টোন নির্দ্বিধায়।

কথা অমৃতসমান নাটকটি শাঁওলি তৈরি করেন ১৯৯০ সালে। ঠিক তার দু’বছর পরেই ঘটে বাবরি মসজিদ ভাঙার ঘটনা, ঘৃণা আর ক্ষমতার উচ্ছ্বাস। এই প্রসঙ্গে শাঁওলি বলেছিলেন, “১৯৯২ সালের ডিসেম্বরের পরে যখন নাটকটা আবার মঞ্চস্থ করতে গেলাম, দেখলাম আর আমি পুরনো সংলাপে নিজেকে প্রকাশ করতে পারছি না। আমি শুরুটা আবার নতুন করে লিখলাম বাবরি মসজিদের ঘটনা মাথায় রেখে।” সমাজ-ধর্ম-অর্থনীতি-চেতনা বাদ দিয়ে নাটক নির্মিত হলে তার উদ্দেশ্য নিয়ে সততই প্রশ্ন উঠে আসে। নাটক শাঁওলির হাতিয়ার, নাটক সার্বিক চেতনার হাতিয়ার বলেই ত্রিংশ শতাব্দীর মতো নাটকে পারমাণবিক ঘৃণার কথা তুলে এনেছেন শাঁওলি, তেমনই বিতত বীতংস নাটকে পরিবেশ সংক্রান্ত একাধিক আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ইস্যুকে নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। আর কথা বলতে গিয়ে, নিজেকে আরও খুঁড়তে গিয়ে পারমাণবিক বর্জ্য নিয়ে কথা বলেছেন বহুজনের সঙ্গে, কারখানার অন্দরের রাজনীতির নানা অলিগলি দিয়ে গিয়েছেন। পাগলা ঘোড়াও একই ভাবে শাঁওলির দর্শনকেই তুলে ধরেছে।

নাট্যকর্মী শাঁওলির জীবনের বিতর্কিততম অধ্যায় বলা যেতে পারে ২০০৮-২০০৯ সাল। শুধু শাঁওলির জীবনে নয় যদিও, বাংলার রাজনীতির মোড় ঘোরানো সেই সময়কালে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনে কৃষকদের পাশে বুদ্ধিজীবীদের দলে প্রথম সারিতে ছিলেন শাঁওলি। স্বাভাবিক নিয়মেই শাসকদলের ঘনিষ্ঠতার কারণে শাঁওলির ব্যক্তিগত রাজনৈতিক দর্শন নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। বাম জমানার শেষ আর নয়া রাজনৈতিক ভাবনার সন্ধিক্ষণেই মহাশ্বেতা দেবীর পরে ২০১২ সালে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন শাঁওলি মিত্র। শারীরিক অসুস্থতার কারণে ২০১৮ সালে পদত্যাগ করলেও ফিরে আসতে হয় ফের। ১৯৯১ সালে নাথবতী অনাথবৎ বইয়ের জন্য আনন্দ পুরস্কার থেকে শুরু করে ২০০৩ সালে অভিনয়ের সম্মান হিসেবে সংগীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার, ২০০৯ সালে পদ্মশ্রী এবং ২০১২ সালে বঙ্গবিভূষণে সম্মানিত শাঁওলি। প্রাবন্ধিক শাঁওলি বাবা শম্ভু মিত্রের নাট্য জীবন ও থিয়েটার দর্শন লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন তাঁর বিখ্যাত বই ‘গণনাট্য, নবনাট্য, সৎনাট্য ও শম্ভু মিত্র’-তে।

More Articles