কমলালেবুর উপত্যকা সিটংয়ে।

পাহাড়ের প্রতি বাঙালিদের অমোঘ টান। তার প্রধান কারণ মনে হয় দার্জিলিং। ছোট থেকেই বাবা-কাকা-মাসি-পিসিদের মুখে দার্জিলিংয়ের গল্প শুনতে শুনতে বড় হয় বাঙালিরা। অঞ্জন দত্তের 'মন খারাপ হলে কুয়াশা হয়, ব্যাকুল হলে তিস্তা', শুনতে শুনতে বড় হয় বাঙালিরা। কাঞ্চনজঙ্ঘার সাথে কাছের মানুষের হাসির তুলনা করতে করতে বড় হয় বাঙালিরা। কেভেন্টার্স, গ্লেনারিজের টেবিলে বসার স্বপ্ন নিয়ে বড় হয় বাঙালিরা। এহেন বাঙালি জাতির সাথে পাহাড়ের নাড়ির টান হওয়া অস্বাভাবিক নয়। সারাবছর ধরে খুচরো ছুটি জমাতে জমাতে বাঙালিরা বছরে একটা পাহাড়ের ট্রিপ করার ছুটি জমিয়েই নেয়। তারপর একদিন দার্জিলিং মেলের টিকিট কেটে, অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে, শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ব্যাগ পত্তর ট্রেনে তুলে, ট্রেন ছাড়ার বাঁশিকে চৌরাশিয়ার বাঁশি কল্পনা করতে করতে পাহাড়ের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় বাঙালিরা।

দার্জিলিংয়ের হরেক রকম আকর্ষণ, ভিন্ন তার মায়ের বাঁধন। যার মধ্যে একটি হলো এখানকার কমলালেবু। তবে আমরা অনেকেই যেটা জানি না সেটা হলো, উত্তরবঙ্গের বেশির ভাগ কমলালেবু আসে কার্শিয়াং মহকুমারের একটি বা একগুচ্ছ গ্রাম থেকে। যার নাম সিটং খাসমহল। পর্যটকরা যাকে কেবল সিটং নামেও ডেকে থাকেন। শীতকালে সিটং গেলে প্রথমেই চোখে পড়বে গাছে গাছে ভরপুর পাকা পাকা কমলালেবু। দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। গাছের ডালে ডালে ঝুলন্ত থোকা থোকা কমলালেবু যাঁরা পাড়েন, তাঁরা অনেক সময়েই পর্যটকদের হাতে তুলে দেন একটা দুটো কমলালেবু। চিরকাল ট্রেন বাজার হাট থেকে কমলালেবু কিনে খাওয়া বাঙালির হাতে যখন গাছ থেকে পাড়া কমলালেবু এসে পড়ে তখন তাদের উৎফুল্লতা হয় দেখার মতন। 

কমলালেবু ছাড়াও আরও অনেক কিছু দেখার রয়েছে সিটংয়ে। যাঁরা প্রথমবার যাবেন, নিউ জলপাইগুড়ি রেল স্টেশন অথবা বাগডোগরা বিমানবন্দর থেকে এখানে পৌঁছনোর পথে পড়বে মংপু। সিটং থেকে যার দূরত্ব মাত্র ৮ কিলোমিটার। মংপু বিখ্যাত বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গ্রীষ্মকালীন বসবাসের অত্যন্ত প্রিয় জায়গা হিসাবে। সাহিত্যিক মৈত্রেয়ী দেবী এবং তাঁর স্বামী মনমোহন সেনের বাংলোয় বেশ কয়েকবার গ্রীষ্ম কাটিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মরশুমের নিয়ম মেনেই ঝরাপাতার দল আলপনা এঁকে যায় রবি ঠাকুরের পাহাড়ী আস্তানার বাগানে। একই সঙ্গে বাগান আলো করে চেনা গাঁদা আর কিছু অচেনা বাহারী ফুল। সঙ্গে পাতাবাহারও হাজির। রবীন্দ্রনাথের এই শৈলাবাস দেখতে আসে সারা বিশ্বের মানুষ। সেই বাড়ি আজ রবীন্দ্র ভবন নামে বিখ্যাত। ২০১৮ সালে পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশন তাকে সংস্কার করে একটি জাদুঘর গড়ে তুলেছে। মংপু গেলেই বুঝতে পারবেন, এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কেন বারবার রবীন্দ্রনাথকে টেনে আনত। রবিঠাকুরের পদধ্বনি মিশ্রিত মংপুর আকাশ বাতাস। এক অদ্ভুত নৈশব্দতায় মোড়া রবীন্দ্র ভবনে ঢুকলে মনের ভিতরে ছড়িয়ে পড়ে দিগন্ত বিস্তৃত প্রশান্তি। মংপুতে কমলালেবু ছাড়াও প্রচুর সিংকোনার চাষ হয়, যার থেকে পাওয়া যায় ম্যালেরিয়ার ঔষধ কুইনাইন। সিনকোনা প্রসেসিং সেন্টারও আছে এখানে।

সিটংয়ে সারাবছর পর্যটকদের ভিড় সেভাবে না হলেও, অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর অবধি গাছ ভর্তি কমলালেবু দেখতে দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসে পর্যটকদের দল। সিটং-এর উচ্চতা মোটামুটি চার হাজার ফুট। কিন্তু ঠান্ডা সে তুলনায় কিছু বেশি। কারণ এটা একটা বৃহৎ ও ছড়ানো উপত্যকা। চারপাশ খোলা। উত্তুরে হাওয়া বয় পাগলের মতো। দূর দূর পর্যন্ত যতটুকু চোখ যায় শুধুই পাহাড়। ধাপে ধাপে ঘরবাড়ি। উপত্যকার মাঝখান দিয়ে বয়ে গিয়েছে নদীর স্রোত। চারদিকে মায়াবী সবুজ পাহাড়। এমন রূপকথার মতো পরিবেশে গ্রামের অবস্থান। ছবির মতো সুন্দর ঘরবাড়ি, বাস করেন মূলত লেপচারা। প্রত্যেক বাড়িতে রয়েছে বাগান। সব বাগানেই কমলালেবুর চাষ হয়। আগে দেখার অভিজ্ঞতা না থাকলে জীবনের কয়েক দশক পার হয়ে এসে প্রথম দেখা যায় গাছে ঝুলন্ত কমলালেবু। নানা আকার, আর কমলা রঙের নানা শেড। লেবুর প্যাকিং হয়, তারপর সেগুলো বাজারে যায়। বাজার মানে বৃহৎ তার পরিধি, দেশ ও দেশের বাইরে। যাঁরা বাগানে বা প্যাকিংয়ের কাজ করেন, তাঁরা সকলেই এ অঞ্চলের মানুষ। শীতকালে তাই পুরো গ্রাম ভরে যায় কমলা রঙে। 

সিটং এমনিতেই বেশ নয়নাভিরাম। উত্তরবঙ্গের আর সব অঞ্চলের মতোই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এখানেও উজার করে ঢেলে দিয়েছেন ঈশ্বর। তবে, কমলার বাগান দেখার অভিজ্ঞতাই আলাদা। আর কমলালেবুর ফলন দেখতে হলে আসতে হবে অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে। এছাড়াও এখানে সিনকোনা চাষ হয়। মংপু-সিটং বেল্টটা সিনকোনা চাষের জন্য বিখ্যাত। এর বাইরে হয় বড় এলাচ। আছে সব ধরনের শাকসবজি। ফলের মধ্যে কমলালেবু ছাড়াও হয় কলা, পেঁপে। আর ফুলঝাড়ু যে গাছ থেকে হয়, তারও চাষ হয় সিটং-এ। গ্রামের মানুষ মূলত কৃষিজীবী। নিজেদের খাওয়ার বাইরে উৎপাদিত শাকসবজির পুরোটাই তারা কালিম্পং ও কার্শিয়ং-এর বাজারে বিক্রি করে। এছাড়াও রুটিরুজির জন্য ড্রাইভারিকে পেশা হিসেবে নেয় অনেকেই। পুলিশ ও সেনা বিভাগের কাজেও যায় কেউ কেউ। স্থানীয় মানুষ পর্যটন ব্যাবসায় আসতেও আগ্রহী। কেউ কেউ করছেনও। তবে, রাস্তা ভালো হলে, এতে বাড়তি উদ্দীপনা যুক্ত হতে পারে, বলাই বাহুল্য। সিটং আদতে খাসমহল, অনেকগুলি ছোট ছোট গ্রাম মিলে গড়ে উঠেছে অঞ্চলটি। বসবাসের ইতিহাস বেশ প্রাচীন। রয়েছে শতাব্দী প্রাচীন এক গুম্ফা, বাঁশ ও মাটি দিয়ে তৈরি। গুম্ফাটি আপার সিটং-এ। ট্রেক করে উঠতে হয়। এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার  দারুণ ভিউ পাওয়া যায়। একটি অতি প্রাচীন গির্জাও রয়েছে। এটিও বাঁশ আর মাটির তৈরি ছিল আগে , সম্প্রতি সংস্কার হয়ে পাকা দালান। তবে, স্থাপত্যে পুরোনো আঙ্গিক ব্যবহার হওয়ায়, গির্জার প্রাচীন রূপটি রক্ষিত হয়েছে। 

সিটং গিয়ে এক বাগান থেকে অন্য বাগানে ইচ্ছে মতো ঘুরে বেড়াতে পারেন। দেখতে পারেন রিয়াং নদীর মোহময়ী রূপ – জল আর রোদের খেলা। পাখিপ্রেমীদের স্বর্গরাজ্য এই জায়গা। কাছেই রয়েছে পাখিদের মিলনভূমি লাটপাঞ্চার। আর মাত্র ১৩ কিলোমিটার দূরে মহানন্দা অভয়ারণ্য। আরও বেশি অ্যাডভেঞ্চার যদি পেতে চান, সিটংয়ে তৈরি হয়েছে ছোটো ছোটো পর্বতারোহণের উপযোগী বেস ক্যাম্প। এছাড়া কাছেই বেড়ানোর জন্য বেশ কিছু পরিচিত-অপরিচিত গন্তব্য রয়েছে। যেমন চটকপুর, বাগোরা, কার্শিয়াং – সবই ২০ থেকে ৩০ কিলোমিটারের মধ্যে। এক ঘণ্টা পাহাড়ে চড়লে পৌঁছে যাবেন সেলফু-সিত্তং-লাটপাঞ্চারের সবথেকে উঁচু পয়েন্টে। সেখান থেকে ডুয়ার্স, তরাই, কার্শিয়াং, দার্জিলিং, কালিম্পং এবং সিকিমের পাহাড়গুলোর অসাধারণ ভিউ পাবেন। নেপাল এবং ভুটানের বেশ কিছু অংশ দেখা যায়। আর চোখে পড়বে রাজকীয় কাঞ্চনজঙ্ঘা। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে পাহাড়ে উঠে চলে যেতে পারেন চটকপুর গ্রামে। মামরিং দিয়ে পাহাড় ডিঙিয়ে বাগোরা যাওয়া যায়। কিংবা মাউজা এবং মহলদিরাম হয়ে পাহাড়ে উঠে পৌঁছে যান কার্শিয়াং।

কীভাবে যাবেন? :- 
এনজেপি স্টেশন/শিলিগুড়ি তেনজিং নোরগে বাসস্ট্যান্ড/বাগডোগরা এয়ারপোর্ট থেকে গাড়িতে সরাসরি সিটং যেতে পারেন। 

গাড়িভাড়া কত? :-
পেট্রোল ডিজেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় ইদানিং কোনও নির্দিষ্ট গাড়িভাড়া বলা যায় না। তবে।মোটামুটি রিজার্ভ গাড়ি করলে ৩৫০০ এর মধ্যে হয়ে যায়।

থাকবেন কোথায়? :-
প্রচুর হোম-স্টে, ক্যাম্পসাইট ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সিটংয়ে। যাওয়ার আগে ইন্টারনেটে তাদের নাম ও নাম্বার খুঁজে ফোন করে বুকিং করে নিতে পারেন।

থাকা খাওয়ার খরচ কেমন? :-
১২০০-১৩০০ টাকা মাথা পিছু, থাকা এবং তিনবেলার খাবার মিলিয়ে। 

কখন যাবেন? :-
অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাস হলো সিটংয়ে যাওয়ার আদর্শ সময়। শীতকালে মারাত্মক ঠান্ডা পড়ে, তাই ভালো করে শীতবস্ত্র গুছিয়ে নিয়ে যাবেন। বর্ষাকালে এ জায়গায় না যাওয়াই ভালো। রাস্তা খুব একটা ভালো না থাকায়, যাত্রা কষ্টকর হয়ে ওঠে। 

More Articles