যৌনমিলনের জন্য লাল-নীল হয় কচ্ছপের মাথা! কেমন আছে চম্বলের বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীরা?

বটাগুর কচ্ছপ পাওয়া যায় ভারত, বাংলাদেশ এবং নেপালের কিছু কিছু অঞ্চলে। চম্বল তাদের মধ্যে অন্যতম।

চম্বল বলতেই ফুলন দেবী, মান সিং, নির্ভয় সিং গুজ্জর, পান সিং তোমার, জগজীবন পরিহার– এঁদের নাম মনে আসে। ডাকাতদের সঙ্গে চম্বলের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। মান সিংয়ের নামে খেরা রাঠোরে রয়েছে একটি মন্দিরও। কিন্তু আপনি কি জানেন, এছাড়াও একটি বিশেষ কারণে চম্বল বিশ্ববিখ্যাত? চম্বল নদীর উপত্যকা আধা-শুষ্ক প্রকৃতির। সেমি অ্যারিড অর্থে শুষ্ক, কিন্তু তুলনামূলকভাবে আর চার-পাঁচটা জায়গার থেকে বেশি বৃষ্টিপাত হয়। এই আদর্শ আবহাওয়ার জন্য নদী-তীরবর্তী গিরিখাত, উঁচু-নিচু জমি, বালির মধ্যে পাওয়া যায় অধুনা প্রায়-অবলুপ্ত বটাগুর কছুগা। সাধারণত এটি রেড ক্রাউনড রুফড কচ্ছপ নামেই বেশি পরিচিত। এই প্রজাতির পুরুষদের মধ্যে ডাইমর্ফিজম দেখা যায়। অর্থাৎ, পুরুষ কচ্ছপদের মাথায় লাল, নীল ও হলুদ রঙ দেখা যায়। বিশেষত যৌনমিলনের সময় স্ত্রী কচ্ছপকে আকৃষ্ট করতে পুরুষেরা এই রং ধারণ করে। তবে এই প্রজাতি প্রায়-অবলুপ্ত। ৫০০টিরও কম স্ত্রী কচ্ছপ বেঁচে রয়েছে এই অঞ্চলে।

চম্বল নদীর ৪২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ উপত্যকাজুড়ে ন্যাশনাল চম্বল স্যাংচুয়ারি তৈরি হয় ১৯৭৯ সালে। এই অঞ্চলেই মিষ্টি জলের বাসিন্দা বড় বড় বটাগুর কচ্ছপ পাওয়া যায়। চম্বলের গতি মধ্যম। স্রোত খুব বেশি নেই। এই জলে মোট আট ধরনের কচ্ছপ রয়েছে। তাদের মধ্যে দু'টি বটাগুর প্রজাতির। ভারতের টার্টল সার্ভিল্যান্স অ্যালায়েন্স সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত শৈলেন্দ্র সিং জানান, তাঁর মতে এই নদী এবং পারিপার্শ্বিক বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ কেন্দ্রের মতো বসতি সম্ভবত এই প্রজাতির কচ্ছপদের আর কোথাওই নেই তেমন। বটাগুরের অপর যে জাতটি এই অঞ্চলে পাওয়া যায়, তার নাম বটাগুর ঢোঙ্গোকা। এটি থ্রি স্ট্রাইপড রুফ টার্টল নামেই বেশি পরিচিত।

চম্বলের এই অঞ্চলে কচ্ছপ সংরক্ষণের কাজ শুরু হয় ২০০৬ নাগাদ। টিএসএ-র অধীনে কাজ শুরুর পর পরই দেখা গিয়েছিল দশটি প্রজাতির মিষ্টি জলের কচ্ছপ অধুনা-বিপন্ন। এদের এক্ষুনি দেখভাল শুরু করা প্রয়োজন। তার মধ্যে তিনটি অতি-বিপন্ন লুপ্তপ্রায় প্রজাতিই চম্বলে পাওয়া যায়। গত ষোলো বছরে কচ্ছপদের আটটি বড় আকারের বসতি খুঁজে পাওয়া গিয়েছে নদীর দু'ধারে। সেখানে প্রায় ৫০০০-এরও বেশি বটাগুরের বাসা সংরক্ষণ করেন টিএসএ-র লোকজন। যেসব বাসার অবস্থা ভালো না, সেখান থেকে ডিম নিয়ে গিয়ে রাখা হয় হ্যাচারিতে, ডিম ফুটে বাচ্চা বেরোলেও কিছুদিন তাদের তত্ত্বাবধানে রাখা হয়। বাচ্চা একটু বড় হলে, তাদের গায়ে ট্রান্সমিটার লাগিয়ে ফের জলে ছেড়ে দেওয়া হয়, যাতে কচ্ছপের গতিবিধির ওপরে নজর রাখা যায়। সিং-এর বয়ানে, “২০১৩ সালে এই ট্রান্সমিটারেই দেখা গিয়েছিল ছেড়ে দেওয়ার পরে এই কচ্ছপেরা পাড়ি দেয় প্রায় ২০০ কিমির বেশি পথ। বোঝাই যাচ্ছে উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান এবং মধ্যপ্রদেশের মধ্যে বোঝাপড়া আরও ভালো হওয়া দরকার। চম্বল নদী তো আর রাজ্যের সীমানা মেনে চলে না!”

আরও পড়ুন: প্রলয় আসছে, দায়ী আপনি, রাষ্ট্রনেতার চোখে চোখ রেখে বলে যান গ্রেটা

সাম্প্রতিককালে টিএসএ নজর রাখার জন্য একটি বিশেষ যন্ত্র আমদানি করেছে। একটি অ্যাপের মাধ্যমেই এখন নির্ণয় করা সম্ভব, কোন অঞ্চল কচ্ছপদের বাসের জন্য উপযুক্ত নয়। সেখান থেকে অন্য জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে কচ্ছপদের। এতেই পেশ করা যাবে বনবিভাগ ও টিএসএ কর্মচারীদের রিপোর্টও। এই অ্যাপ নিয়ে আশাবাদী টিএসএ।

বটাগুর কচ্ছপ পাওয়া যায় ভারত, বাংলাদেশ এবং নেপালের কিছু কিছু অঞ্চলে। চম্বল তাদের মধ্যে অন্যতম। যদিও সংরক্ষণের ব্যবস্থা এখানে রয়েছে, তবে এই এলাকার কিছু বিশেষ প্রতিকূলতা রয়েছে। প্রথমত, চম্বলের পাড় থেকে বেআইনিভাবে প্রচুর বালি তোলা হয়। এই বালি পাচারের জন্য জন্তুগুলো বিপদে পড়ে। পাড়ের বালিতে এরা সাধারণত রোদ পোহায়, বাসা করে। খোঁড়াখুঁড়িতে তাদের স্বাভাবিক জীবন ব্যহত হয়। এমনকী, মারাও যেতে পারে কচ্ছপরা। এছাড়া গরমের সময় নদীর জল তুলে চাষবাস এবং প্রচুর পরিমাণে মাছ ধরা কচ্ছপগুলিকে বিপদের মুখে ঠেলে দেয়। সঙ্গে রয়েছে পাড়ের বালিতে তরমুজ, শশা, খরমুজ ইত্যাদির চাষ। ফলে কচ্ছপদের স্থান অকুলান। আবদেশ কুমার রাজপুত এমনই এক চাষি। তাঁর বাড়ি উত্তরপ্রদেশের এটাওয়ায়। এই অঞ্চল চম্বল উপত্যকার মধ্যেই পড়ে। জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত নদীতীরে চলে এই চাষবাস। এই অঞ্চলে তিন প্রজন্ম ধরে চাষ করছেন তাঁরা। তিনি জানালেন, এই গ্রামে এমন আরও ষাট ঘর চাষা রয়েছে। ১৩ একর জমিজুড়ে এমন চাষ হয়। মে মাসের পরে বন্যায় আশপাশের জমি ডুবে গেলে আর চাষ করা যায় না। তাঁর মতে পাড়ের বালিতে ফলানো তরমুজের এক বিশেষ স্বাদ হয়, যা মাটিতে হওয়া সম্ভব নয়। সেই জন্যই এই অঞ্চলে চাষবাস থাকবেই। তবে তিনি নিজে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে কচ্ছপদের দেখভাল করেন। যে অঞ্চলে বাসা রয়েছে, ডিম রয়েছে, সেই জায়গা বাদ দিয়ে চাষ করেন। কচ্ছপরা সাধারণত উঁচু জমিতে বাসা করে, চাষের ক্ষেতের আশেপাশে তাদের খুব একটা দেখা যায় না।

এই ধরনের সচেতনতা যাতে আরও বাড়ে, সেদিকে নজর রাখা উচিত। এটাওয়াতে একটি কচ্ছপ সংরক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই অঞ্চলে সচেতনতা বাড়াতে সক্ষম হয়েছে টিএসএ। টিএসএ-র প্রোজেক্ট অফিসার পওন পারিক জানালেন, আগে কচ্ছপরা ডিম ফুটে বাচ্চা বেরনোর পর পরই বর্ষাকালীন বন্যায় বাসা ভেসে গিয়ে বহু কচ্ছপ মারা যেত। এখন সংরক্ষণ কেন্দ্রে তাদের বড় করা হয়। বছরদুয়েকের মধ্যে কিলোখানেক ওজন হলে এদের আবার জলে ছেড়ে দেওয়া হয়। নদীতে থাকাকালীন একটি কচ্ছপের ওজন হতে পারে তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশ কিলো পর্যন্ত।

 

 

More Articles