মাত্র তিনদিনেই দার্জিলিং জমজমাট! চেনা জায়গায় অচেনা সফরের স্বাদ পেতে ঘুরে আসুন

মাত্র তিনদিনে চেনা দার্জিলিংকে নতুন করে চিনুন

 

বর্ষার আবার ঘরে ফেরার সময় ঘনিয়ে এল বোধহয়। চাতক পাখির তৃষ্ণা নিবারণের পর দক্ষিণবঙ্গ ছেড়ে দ্রুত গতিতে পালাচ্ছে বৃষ্টি, আর সেই সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাপমাত্রা আবারও ঊর্ধ্বমুখী। এইরকম সময়ে যদি কেউ আপনাকে টুক করে নিয়ে গিয়ে পাহাড়ের কোলে বসিয়ে দিত, কেমন হত তাহলে? নিশ্চয়ই মন্দ হত না! তা কিছু বিষয় কল্পনাতেই বেশ ভালো লাগে, আমাদের কাছে তো আর ভূতের রাজার উপহার দেওয়া জুতো জোড়া নেই যে, তালি মারলেই একেবারে পৌঁছে যেতে পারব হিমালয়ের ওপরে। তাই পাহাড়ে যদি যেতেই হয়, তবে আর দেরি না করে চটপট টিকিট কেটে বেড়িয়ে পরাই ভালো। তবে এবার আর বড়সড় প্রস্তুতির কোনও দরকার নেই। মাত্র তিনদিনেই ঘুরে আসা যাক, বাঙালির চিরাচরিত পাহাড়ি গন্তব্য দার্জিলিং-এর কোল থেকে।

 

কীভাবে যাবেন?
যে কোনও শনি-রবিবারের আগের শুক্রবারে অফিস থেকে যদি একটা ছুটির বন্দোবস্ত করতে পারেন, ব্যাস, তাহলেই কেল্লা ফতে। বৃহস্পতিবার অফিস থেকে ফিরে, রাত্রের ট্রেন ধরে রওনা দিন নিউ জলপাইগুড়ির উদ্দেশে। সারাদিনের খাটাখাটনিতে ক্লান্ত হয়ে কখন যে ট্রেনের একঘেয়ে দুলুনিতে ঘুম নেমে আসবে আপনার চোখে, তা বুঝতেও পারবেন না। সকাল হয়েই দেখবেন, পোঁছে গেছেন গন্তব্যে। সন্ধে ৭টা ৩৫ মিনিট থেকে পরপর বেশ কয়েকটি ট্রেনই রওনা দেয় উত্তরবঙ্গের উদ্দেশে। ট্রেনের টাইমটেবিলে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে নিজের সুবিধামতো একটা ট্রেনে চেপে পড়তে পারলেই হল। তবে ট্রেনের টিকিট এই মরশুমে পাওয়া দুষ্কর। তাই আগে থেকে ওঁত পেতে রাখতে হবে। একটা ছোট্ট কথা না বললেই নয়। যেহেতু হাতে সময় কম, তাই নিউ জলপাইগুড়িতে নেমে বা দার্জিলিং পৌঁছে হোটেল খুঁজতে গেলে খানিকটা সময় নষ্ট হতে পারে, তাই সম্ভব হলে থাকার জায়গাটা আগে থেকে ঠিক করে যাবেন।

 

প্রথম দিন
নিউ জলপাইগুড়িতে পৌঁছে, সেখানে সকালের জলখাবার খেয়ে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়ুন, দার্জিলিংয়ের পথে। কিন্তু এইবার দার্জিলিং যান মিরিক লেক হয়ে। এনজেপি থেকে ঘণ্টাদেড়েক চলার পরেই সমতল থেকে আপনি ক্রমশ ওপরে উঠতে থাকবেন। এরপরেই চোখে পড়বে মিরিক লেক। পাহাড়ি এলাকায় বোটিং করার স্বাদ নিতে একেবারেই মিস করবেন না যেন। এরপরে দুপুরের খাবার খেয়ে, লেক-লাগোয়া বন্য এলাকায় খানিকটা সময় কাটিয়ে, গাড়ি নিয়ে সরাসরি পৌঁছে যান দার্জিলিং। এতখানি পথ অতিক্রম করে আসার পর, স্বাভাবিকভাবেই সেদিন আপনার আর কিছু করতে ইচ্ছা করবে না। সন্ধেবেলা ম্যালে ঘুরে কিছু কেনাকাটা করে নিতে পারেন। এরপর আর সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি রাত্রের খাবার খেয়ে পাড়ি দিন ঘুমের দেশে, কারণ দ্বিতীয় দিনের সূচনালগ্নেই আপনাকে পৌঁছে যেতে হবে টাইগার হিলের সূর্যোদয় দেখতে।

আরও পড়ুন: দিঘা-পুরী-দার্জিলিং নয়, বাঙালির মনে জায়গা পাকা করছে চটকপুর

 

দ্বিতীয় দিন
পরের দিন ভোর সাড়ে ৩টে থেকে ৪টের মধ্যে আগে থেকে ঠিক করে রাখা গাড়িতে চড়ে বেড়িয়ে পড়ুন টাইগার হিলের উদ্দেশে, এর থেকে দেরি হলে কিন্তু হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে সেই চরম মুহূর্ত। অন্ধকারের বুক চিরে অসংখ্য গাড়ির ভিড়ে ঘুমচোখে ইতিমধ্যেই আপনি পোঁছে গেছেন গন্তব্যে। তবে এক্ষেত্রে গাড়ি আপনাকে বেশ খানিকটা নিচে নামিয়ে দেবে, বাকি রাস্তা আপনাকে যেতে হবে পায়ে হেঁটে। মর্নিংওয়াকটা না হয় একদিন এভাবেই সেরে ফেলুন, ক্ষতি কী! এরপর কফি কিংবা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে দেখুন, কী সুন্দরভাবে অন্ধকার চিরে গোটা আকাশে একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়তে থাকে আলো। কীভাবে সাদা বরফে ঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা নিমেষের মধ্যে পরিণত হয় সোনার পাহাড়ে। এরপর নিচে নেমে আসার পালা। টাইগার হিল থেকে নামার পথে আপনার নজরে পড়বে ‘ঘুম স্টেশন’। নিচে নেমে আপনি দু'টি কাজ করতে পারেন। প্রথমটি হল, সেখান থেকেই আবার গাড়ি চেপে সকালের জলখাবার খেয়ে, সোজা চলে যেতে পারেন বাতাসিয়া লুপ আর দ্বিতীয়টি হল হোটেলে ফিরে খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে, জলখাবার খেয়ে আবার বেড়ানো। বাতাসিয়া লুপ থেকেও আপনি কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করতে পারবেন। বাতাসিয়া লুপে সময় কাটানোর সময় আপনার সাক্ষাৎ ঘটতে পারে দার্জিলিং-এর বিখ্যাত ট্রয়ট্রেনের সঙ্গে। বাতাসিয়া লুপেই ট্রয়ট্রেনগুলো গোল করে একবার পাক খায়। এই অঞ্চলেও আবার একটি বাজার রয়েছে, চাইলে এইখান থেকেও কিছু কেনাকাটা করতে পারেন আপনি। এরপর চলে যান বৌদ্ধ মন্দিরের উদ্দেশে। আর তারপর বিখ্যাত দার্জিলিং জু ও ‘হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইন্সটিটিউট’-এ ঘুরে আপাতত ফিরে যান হোটেলে। আপনি যদি টয় ট্রেন চড়ার অভিজ্ঞতা লাভ করতে চান, তবে বিকেলবেলা দার্জিলিং টয় ট্রেন স্টেশন থেকে ঘুম, আবার ঘুম থেকে দার্জিলিং অবধি একটি ছোট্ট ট্রিপ করে ফেলতেই পারেন। সন্ধ্যাবেলা একবার ম্যালের মহাকাল মন্দিরটির দর্শন করে চলে যান, গ্লিনারিজ-এ। দার্জিলিং-এ এসে যেসমস্ত জায়গা একেবারেই মিস করা চলে না, তারমধ্যেই একটি হল এই গ্লিনারিজ। গ্লিনারিজ-এর আভ্যন্তরীণ মায়াময় পরিবেশে ডুব দিয়ে কাটিয়ে দিতে পারেন সারাটা সন্ধে। চাইলে নৈশভোজও সারতে পারেন এইখানেই।

 

তৃতীয় দিন
আজ বাড়ি ফেরার পালা। স্বাভাবিকভাবেই মন একটু খারাপ। সেই মনখারাপ কাটিয়ে উঠতে সোজা চলে যান ‘কেভেন্টার্স’-এ। দূরের কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখতে দেখতে সেরে ফেলুন ‘ইংলিশ ব্রেকফাস্ট’। শেষদিন হলেও এখনও অনেককিছুই দেখা বাকি রয়ে গেছে। সেই ছোট্টবেলা থেকেই আমরা সকলেই বইয়ের পাতায় পড়েছি, দার্জিলিং-এর চা স্বাদে এবং গন্ধে জগত বিখ্যাত। তাই দার্জিলিং-এ এসে চা-বাগান না দেখলে চলে? সকালের জলখাবারের পর বেরিয়ে পরা যাক ‘টি গার্ডেন’-এর উদ্দেশ্যে এবং সেখান থেকে কিছু চা কিনে সোজা চলে যান ‘রক গার্ডেন’। রক গার্ডেন-এ আসতে গেলে বেশ খানিকটা পথ নিচে নামতে হয়, তাই এই যাত্রাটিও বেশ মজাদার। রক গার্ডেন-এ রয়েছে একটি বিশাল আকারের প্রাকৃতিক ঝরনা। এরপর, আবার হোটেলে ফেরার পালা। সেখান থেকে নিজেদের ব্যাগ গুছিয়ে, খাবার খেয়ে দার্জিলিং-কে বিদায় জানিয়ে নিউ জলপাইগুড়ি। স্বল্প সময়ে হয়তো অনেককিছুই দেখা হল না আপনার, কিংবা দেখা হলেও হয়তো মন ভরল না। তবে মনখারাপ করার কিছুই নেই। আসলে এই অপূর্ণতাই আপনাকে আবারও টেনে নিয়ে যাবে দার্জিলিং-এ, সেইবার না হয় একটা বড় টানা ছুটি নিয়ে ঘুরে আসবেন।

More Articles