‘রসে’বশে মহাপ্রভু: শ্রীচৈতন্যের ভোজনবিলাসের কাহিনি আজও কিংবদন্তি

মিতাহার মানে ‘ভদ্রতা’--এই ধারণা আসেনি তখনও। ব্রিটিশ এই দেশ দখল করার পরেও নিজের খাওয়ার ধরন-ধারন ভুলতে বাঙালি উচ্চবর্ণের (মূলত ‘ভদ্রলোক’দের) বেশ খানিকটা সময় লেগেছে। ‘কুলীনকুলসর্ব্বস্ব’ নাটকে রামনারায়ণ তর্করত্ন যখন লিখছেন উত্তম, মধ্যম ও অধম ফলারের কথা, তা থেকে সে সময়ে বাঙালি উচ্চবর্ণের সাদামাটা খাবারের একটা আন্দাজ পাওয়া যায়। কিন্তু এ ঘটনা তারও কয়েকশো বছর আগেকার।

বঙ্গের দক্ষিণ অঞ্চলে প্রবল বৈষ্ণব ধর্মের জোয়ার চলছে। ভক্তি আন্দোলনের ঢেউ উপমহাদেশের দক্ষিণ থেকে বয়ে এসে লেগেছে নদিয়ার ঘাটে ঘাটে। শচী মায়ের নিমাই তখন চৈতন্য।  ভাবঘোরে দিশেহারা হয়ে চলেছেন বৃন্দাবনের পথে। পিছু নিয়েছেন নিত্যানন্দ, আচার্যরত্ন ও মুকুন্দ। গোপনে। ভাবের ঘোরে থাকেন যিনি, বলা কি যায় তাঁর কখন কী হয়! নামকীর্তনের সুরে আশেপাশে ইতস্তত জড়ো হচ্ছে কিছু লোকজন, বাচ্চা ছেলেপিলে। নিত্যানন্দ তাদের আড়ালে ডেকে কীর্তনের ব্যাখ্যা করে দিচ্ছেন। হরিভক্তির প্রচারও হচ্ছে, লোকজন শুনে আনন্দও পাচ্ছে। চৈতন্য ইতিমধ্যে বাচ্চাদের ডেকে আদর করে বৃন্দাবনের রাস্তা জিজ্ঞেস করলেন। তিনজন আড়ালে থেকে দেখছেন, কিন্তু পরিচয় দেননি তখনও। গঙ্গার তীর ধরে সোজা যে রাস্তাটা গিয়েছে, সেটা ধরে চৈতন্য খানিকটা এগিয়ে যেতেই নিত্যানন্দ আচার্যরত্নকে ডেকে বললেন, “শোনো, তুমি শীঘ্র অদ্বৈত আচার্যের বাড়ি যাও। নদীতীরে নৌকো নিয়ে তাঁকে অপেক্ষা করতে বোলো। আমি প্রভুকে নিয়ে ওঁর বাড়িতেই উঠব। তারপরে তুমি চলে যেও সোজা নবদ্বীপ। শচীমা আর সমস্ত ভক্তদের ডেকে নিয়ে এসো।”

উদ্ভ্রান্তের মত নিমাই চলেছেন। নিত্যানন্দ খুব বেশিক্ষণ নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারলেন না। কুশল আদানপ্রদানের পর চৈতন্য তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, “বৃন্দাবন কতদূরে তা কি তুমি জানো?” নিত্যানন্দ গঙ্গা দেখিয়ে বললেন, “এই যে! যমুনার জল। হরি হরি! দর্শন করুন প্রভু।” ভাবের ঘোরে চৈতন্য যেন তাই দেখলেন। যমুনা স্তব করে গঙ্গাস্নান সেরে উঠতে উঠতেই হল অদ্বৈত আচার্যের সঙ্গে দেখা। আচার্যকে নমস্কার করতে দেখে এতক্ষণে চৈতন্যের মনে জাগল সন্দেহ। “আপনি এখানে কোত্থেকে এলেন হে অদ্বৈত? বৃন্দাবনে এসেছি জানলেনই বা কী করে!” ব্যপারটা এইবারে খোলসা হল। অদ্বৈত সমস্ত খুলে বললেন নিমাইকে। তারপরে “এক মুঠো ভাত খেয়ে যাবে চলো আমার বাড়ি থেকে”, এই বলে তাঁকে নৌকায় চড়িয়ে নিয়ে এলেন বাড়ি।‌

সাধারণ বাঙালির মতোই চৈতন্য খেতে ভালোবাসতেন। কিন্তু খাওয়া তাঁর কী রকম ছিল, তা জানা যাবে এই নিমন্ত্রণের ঘটনায়। বৈষ্ণব সাহিত্যে, মূলত চৈতন্যের জীবনীগ্রন্থগুলিতে শোনা গিয়েছে বারবার। তবু উদাহরণের জন্য এই একটি যথেষ্ট বোধ হয়! ‘শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃতের’ মধ্যখণ্ডের তৃতীয় পরিচ্ছেদে রয়েছে এই বিবরণ। ‘এক মুঠো ভাত’ বলে অদ্বৈত গোরাকে বাড়ি নিয়ে গিয়েছিলেন বটে, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল তাঁর গিন্নি বিষ্ণুর প্রসাদ হিসেবে যা বাড়লেন তা আর যাই হোক এক মুঠো নয়। এমনকী সেই খাবারের বর্ণনায় কবিরাজ খান আঠাশেক পংক্তি বরাদ্দ করেছেন!

কেমন ছিল সেই খাবারদাবারের ফিরিস্তি?

খান বত্রিশেক এঁটে কলা বা বীচি কলা, মাঝে হলুদ ঘিয়ে ভেজা লাল শালি ধানের ভাতের স্তুপ, তার চারিদিকে ব্যঞ্জন পাত্র আর সঙ্গে মুগের ডাল। পটোল, কুমড়ো ও বড়ি দিয়ে রাই মরিচ সহযোগে শুক্তো রয়েছে। পাঁচ রকম ঝাল এবং তেঁতো। নিম বেগুন ভাজা, ফুল বড়ি ভাজা, কুমড়ো ও মানচাকি ভাজা, নারকেল, ছানা-- শর্করা দিয়ে মাখা, মোচাঘণ্ট, দুধ--এবং সবই যাচাই। টক মিষ্টি চাটনি, বড়া পাঁচ ছয় রকম। মুগডালের বড়া, মাষবড়া, মিষ্টি কলাবড়া, ক্ষীর পুলি, নারকেল পুলি ইত্যাদি নানা বিধ পিঠে। মাটির কলসিতে ঘি দেওয়া পায়েস, তিন বাটি ঘন দুধ, দুধ চিঁড়ে কলা আর দুধ লক্‌লকী, সারি সারি মাটির হাঁড়িতে চাঁপাকলা, দই, সন্দেশ ভরা। ভাত ও ব্যঞ্জনের উপর তুলসী মঞ্জরি রাখা, এবং পিপাসার জন্য তিন পাত্র সুগন্ধী জল। ব্যঞ্জনের পাত্র সংখ্যাও ছিল নাকি খান পঞ্চাশেক।

চৈতন্যের খাদ্যের পরিমাণ

এবং এই খাবার দেখে চৈতন্য যখন ‘না না’ করছেন, “করেছ কী? এত খাওয়া যায়! সন্ন্যাসী মানুষ, কিছু তো ফেলে রাখাও ধর্মে বারণ!” এই মিষ্টি নিষেধ শুনে অদ্বৈত জানান, নীলাচলে থাকতে চৈতন্য খান চুয়ান্নবার দিনে। তিন জন মানুষের গ্রাস তিনি খান একেক বারে। সে তুলনায় এ খাবার কতটুকু! তার দৈনিক খাবারের পাঁচ গ্রাসও নয়! এর থেকে বোঝা যায় চৈতন্য কেমন খেতে ভালোবাসতেন এবং কী বিপুল পরিমাণে খেতেন!

মহাপ্রভুর প্রিয়তম পদ

শুক্তো ছিল তাঁর পছন্দের খাবার! গুরুভোজনে আমাশয় হলে শুক্তো খেয়ে তার উপশম হত। এছাড়া তিনি নীলাচলে গেলে প্রতি বছর রথের সময় রাঘব পণ্ডিতের বাড়ি থেকে তাঁর প্রিয় খাবারদাবার শ্রীক্ষেত্রে পাঠানো হত। রাঘবের বাল্য-বিধবা বোন দময়ন্তী এর তত্ত্বাবধান করতেন। তাতে থাকতো--খইয়ের মোয়া, শালি ধানের খই দিয়ে তৈরি নাড়ু, চিড়ার নাড়ু, বাদামের নাড়ু, ক্ষীরের নাড়ু, ধনিয়া মৌহরী চিনি পাক নাড়ু, গঙ্গাজল বা গঙ্গাজলি নাড়ু, আতপচালের মুড়ির মোয়া, আম কাসুন্দি, আদা ঝাল কাসুন্দি, লেবু, তেঁতুল, আমসি, তেঁতুলের আচার, হরতকি, তিলের নাড়ু, আমসত্ব, আমলকি, তৈলাম্র আমতা, কর্পূর মরিচ, লবঙ্গ, এলাচ, আদা কাসুন্দি, ঝাল কাসুন্দি ইত্যাদি। রাঘবের বাড়ি থেকে যেত বলে এর নাম হয় ‘রাঘবের ঝালি’। সেই সময় তেতো পাতা, যেমন-নালিতা, নিম ইত্যাদি শুকিয়ে রাখা থাকত। এই ধরণের শুকনো পাটপাতার খোঁজ পাওয়া যায় এই রাঘবের ঝালিতে। এদের ‘পুরাণ শুকুতা’ বলা হত। বিপুল পরিমাণে পাঠানো এইসব খাবার চৈতন্য খেতেন অত্যন্ত তৃপ্তির সঙ্গে।

তাঁর খাদ্যপ্রীতির ছোঁয়া রয়ে গিয়েছে তাঁর জীবনীগুলোর আনাচে কানাচে। লোকের মুখে মুখে ফেরা কিংবদন্তিরা বিকেলের দীর্ঘ ছায়া হয়ে রাতে মিশে যাওয়ার অপেক্ষা করছে। বাঙালির খাবারদাবারের বৈচিত্র এখন আগের থেকে অনেক বেশি। বেছে নেওয়ার সুযোগ বেশি। যুগের ফেরে তা হওয়া অবশ্যম্ভাবী এবং প্রয়োজনও। মানুষের খাবার রুচি তাতে করে একটা নির্দিষ্ট ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক সীমানায় আবদ্ধ না থেকে ছড়িয়ে গিয়েছে গোলকের প্রান্তে প্রান্তে। কিন্তু সেই আন্তর্জাতিকতার মাঝেও বাংলার নিজস্বতা হারিয়ে যায়নি। যাবতীয় খাবারকে বাঙালি নিজের মতো নিয়েছে সাজিয়ে। বাঙালিয়ানার গন্ধ তাতে অটুট। বাঙালি মোঘলাই করলে, সে মোঘলাই জাতে বাঙালি হয়, চাউমিন করলে তাও! অন্তত আপামর সাধারণ বাঙালির ক্ষেত্রে তো তা বটেই। তাই চৈতন্যের মতো অসাধারণ মানুষদের মাটির শখ আহ্লাদ খাবারের গল্পেরা সাধারণের মধ্যে রয়ে যাবে চিরকাল। পৃথিবীর সমস্ত বইয়ের পাতা পোকায় কেটে শেষ করে ফেললেও। প্রজন্ম-স্রোতের থেকে বড় জীবনী আর কীই বা রয়েছে!

 

-কৃষ্ণদাস কবিরাজ, শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, মধ্য খণ্ড- তৃতীয় পরিচ্ছেদ ও অন্ত খণ্ড দশম পরিচ্ছেদ , সুকুমার সেন তারাপদ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত, আনন্দ

 

More Articles