স্টেলা মাজ, রাজপরিবারের ব্রিটিশ 'রানি', লাস্যময়ীর অন্ধকার যাত্রা

পাঞ্জাবের কপুরথলা রাজপরিবারের গল্প। অন্য বেশ কয়েকটি প্রিন্সলি স্টেট এবং রাজকীয় প্যাশন, খ্যাতি, যশ এবং শেষমেশ ক্ষয়ের গল্প। তবে এইসব গল্পের সঙ্গে যখন মিশে যায় দেশ পেরনো সুদূর কোনও নারীর স্মৃতি এবং দুই লেগ্যাসির মিশেলে এক নূপুরের নিক্বণ, তখন তা এক অন্য অর্থ বহন করে। আর তাছাড়া যে গল্প তার পরবর্তী প্রজন্মের কাছে রেখে দেয় কণামাত্র চিহ্ন, সেই গল্প খুঁজে বের করাও ভেতরেও বোধ করি থেকে যায় অন্য প্যাশন, মাদকতা। প্রিয় পাঠক, তেমনই এক গল্প, ইতিহাস, মিস স্টেলা মাজ।

কে এই স্টেলা মাজ? কপুরথলা রাজপরিবারের প্রসঙ্গে শুরুতেই এসেছিলাম। সেই প্রসঙ্গ ধরবার আগে স্টেলার জীবনটায় একটু আলো ফেলা যাক। মিস অ্যালিসে এ. ভিলার্সের জন্ম ইনলন্ডের কেন্টের কার্টন অঞ্চলে, ১৯০৪ সালের ১৩ অক্টোবর। ছোট থেকেই পিয়ানো আর ব্যালে নাচে তুখোড় অ্যালিসের এক সময়ে লন্ডনের লিটল থিয়েটারে কোরাসে যোগদান। লাল ঠোঁট, তন্বী অ্যালিসের আকর্ষণ ফেরাতে পারা অসম্ভব হয়ে পড়ত ব্রিটিশ তরুণদের। যদিও নিয়তি অন্য ভাবে এই গল্প লিখছিল। লিটল থিয়েটার প্যারিসে শো করতে গেলে সেদেশের ‘ফোলিয়ে বারজে’ ক্যাবারে মিউজিক হলের চট করে চোখে লেগে যায় অ্যালিসকে। কেমন হবে নাইট ক্লাবের ক্যাবারে নর্তকী হিসেবে এই তরুণীকে পেলে? আর সেদিনই আলো অন্ধকারের এক করুণ গল্পের সূচনাপর্ব। ‘ফোলিয়ে বারজে’ মিউজিক হলে অ্যালিসের নাম বদলে হয়ে যায় স্টেলা মাজ। আর এই স্টেজ নেমে উত্তাল দর্শকের ভেতর এক ভারতীয় চোখ আপন করে নেয় স্টেলাকে। গল্প এগিয়ে চলে ।

লাস্যময়ী স্টেলা মাজ

একটু বিরতি নিই। বরং একফাঁকে মহারাজা পরমজিৎ সিং-এর কথায় আসা যাক। হিমাচল প্রদেশের জুব্বাল অঞ্চলের সুন্দরী ঝকঝকে বৃন্দা দেবীর সঙ্গে বিয়ে হয় পরমজিতের। বছর সাতেকের বৃন্দা বছর নয়ের পরমজিতের বাগদত্তা ছিলেন ওই বয়স থেকেই। শ্বশুর মহারাজা জগৎজিৎ সিং পুত্রবধূকে প্যারিসে পাঠালেন ফরাসি আদবকায়দা এবং শিক্ষায় রপ্ত করতে। ফিরে এসে বৃন্দা এতটা চমকে দেবেন মহারাজা নিজেও ভাবেননি। বিদেশি এটিকেটে তাক লাগিয়ে দিতেন রাজমহলের প্রতিটা দেওয়ালকেও। অবশ্য পুত্রসন্তান হয়নি বৃন্দার, তিন তিনটে ফুলের মতো কন্যা ভরাট করে তুলেছিল কপুরথলার ঘর-গেরস্থালি। আর তখনই মঞ্চে এক ক্যাবারে নর্তকীর প্রবেশ।

১৯২২ সালে স্ত্রী বৃন্দাকে নিয়ে ‘ফোলিয়ে বারজে’ মিউজিক হলে আসেন পরমজিৎ। রূপে এই প্রবল পরাক্রমশালী এবং হ্যান্ডসাম ঝকঝকে পরমজিৎকেও পাগল করে দেয় স্টেলার রূপ-লাবণ্য। ১৮ বছরের স্টেলাকে শো শেষে এক বহুমূল্য বোকে উপহার দেন পরমজিৎ, এবং তার সঙ্গে প্রত্যেকটি শো-তেই স্টেলার আকর্ষণে ‘ফোলিয়ে বারজে’-র দরজায় কড়া নাড়তে থাকেন এই ভারতীয় রাজকুমার। এক সময়ে স্টেলাকে ভারতে নিয়ে আসেন পরমজিৎ। প্রথমদিকে পুরোটাই গোপনে হলেও স্টেলার নিজেরই দাপটে খবর রটতে সময় লাগেনি একেবারেই। আর তখনই গল্পে  ট্যুইস্ট। নিজে একসময়ে এক স্পেনীয় নর্তকী অনিতা ডেলগাডোকে বিয়ে করা খোদ জগৎজিৎ যদিও ছেলের এহেন আচরণকে ভালো চোখে নিলেন না বিশেষ। বিশেষ স্নেহধন্যা কন্যাসমা বৃন্দার অপমান আসলে তো নিজেরই অপমান। কপুরথলা প্যালেসে ঢুকতে দেওয়া হল না স্টেলাকে। আর এই কপুরথলাতেই প্রেয়সীর জন্য ‘স্টেলা কটেজ’ বানিয়ে সেখানেই থাকতে শুরু করলেন পরমজিৎ।

আর তখনই গল্পে তৃতীয় নারীর প্রবেশ। পছন্দের বৃন্দাকেও দুয়োরানি করা হল শুধুমাত্র পুত্রসন্তান দিতে না পারায়। আরেক পাহাড়ি মেয়ে হিমাচলের কাংড়া উপত্যকার লীলাবতীর সঙ্গে ছেলেকে জোর করে বিয়ে দিলেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ জগৎজিৎ। কিন্তু বিয়ে তো হল? সন্তান? স্টেলার মোহে আবিষ্ট পরমজিৎ তো গ্রাম্য পাহাড়ি মেয়ে লীলাকে ছুঁয়েও দেখতেন না। এখানেই মোক্ষম চাল চাললেন কুশলী জগৎজিৎ। স্টেলার অর্থলোভ লোকসমক্ষে প্রচারিত হচ্ছিল দিনকে দিন। আর এই সুযোগকেই লুফে নিলেন মহারাজা। গোপনে স্টেলার সঙ্গে দেখা করে প্রায় দশ লক্ষ অর্থের লোভে প্রেয়সীকে দিয়ে ছেলেকে নববধূর সঙ্গে মিলনের এক ট্র্যাজিক বিষাক্ত খেলায় রাজি করালেন জগৎজিৎ। বহু কষ্টে, শেষমেশ একদিন প্রবল অশান্তির পরে জেনানায় পাঠানো হল পরমজিৎকে। আর সেদিনই বংশের বহুকাঙ্ক্ষিত পুত্রসন্তান সুখজিৎ সিং-এর বীজ বপন। এবং সেখানেই ইতি।

আরও পড়ুন-বাঙালির ইয়েতি অভিযান, সিনেমা নয়, এই গল্পটা সত্যিই…

কপুরথলাকে চিরকালের জন্য বিদায় জানিয়ে দেশ পেরিয়ে ব্রিটিশ মাটিতে চলে এলেন স্টেলা-পরমজিৎ। ১৯৩৭ সালে ইংলন্ডের এক গুরুদ্বারায় বিয়ে হয় দু'জনের। ক্যাবারে নর্তকী স্টেলা মাজ সেদিন থেকে হয়ে গেলেন নরিন্দর কউর। একথা মিথ্যে নয়, বিত্তের প্রলোভন বুঁদ করে রাখত স্টেলাকে। পোশাকের রঙের সঙ্গে মানিয়ে স্বামীর দেওয়া দামি চারচাকাকে রং করিয়েছিলেন তিন তিনবার। কিন্তু ওইটুকুই। নিয়তি আবারও অন্য কিছু ভাবছিল।

১৯৪৮ সালে পরমজিৎ কপুরথলার মহারাজা হলেও সে খেতাব বেশিদিন থাকল না। দীর্ঘ রোগভোগ এবং শেষমেশ ১৯৫৫ সালে অকালমৃত্যু। স্বামীর শেষকৃত্যে আসতে দেওয়া হল না স্টেলাকে। বৃন্দার দাপটে কপুরথলার সম্পত্তির কানাকড়িও পেলেন না ব্রিটিশ তরুণী। যদিও প্রেমিক তথা স্বামীর বেঁচে থাকা অবস্থাতেই একটা সময় পর্যন্ত রয়্যাল লেগ্যাসির অনেককিছুই হাতে পেয়ে গেছিলেন ‘মানি গ্র্যাবার’ মিস স্টেলা। কপুরথলা থেকে বিতাড়িত হয়ে বাধ্য হয়ে ইংলন্ডে ফিরে এলেও নিজের দেশের মাটিতে মনোটনি গ্রাস করল ক্রমশ ভারতীয় লেগ্যাসির ছোঁয়া পাওয়া সুন্দরী স্টেলাকে। ফিরে এসে দিল্লির ডিফেন্স কলোনিতে থাকতে শুরু করলেও শেষমেশ ১৯৫৭ সাল থেকে সিমলার সিসিল হোটেলের চিলেকোঠার মতো একটি ঘরে বাকি দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল স্টেলার। নেশায়, প্রবল নেশায় তলিয়য়ে যাচ্ছিলেন তিনি। এ নেশা অবশ্য অর্থ বা খ্যাতি না। মদের গ্লাসে বেহিসেবি জীবনযাপন করা অসুস্থ এক নারীর জীবনের জ্যাকেটটা যেন স্বেচ্ছায় গায়ে চাপিয়ে নিয়েছিলেন স্টেলা । ষাট পেরলেও অবারিত যৌনতার দরজা বন্ধ হয়নি।

শেষমেশ  ১৯৮৪-র ফেব্রুয়ারির এখ রাতে নিজের ২৭ বছরের চেনা ভ্যাপসা হোটেলের ঘরে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলেন। সেখান থেকে দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স হসপিটাল। ২৩ ফেব্রুয়ারি, অ্যালিসে ভিলার্স, ওরফে স্টেলা মাজ, ওরফে নরিন্দর কউর -এর জীবনমঞ্চে নেমে আসা চিরকালীন এক অন্ধকারের তারিখ ।

সিমলার সিসিল হোটেল

পরে দু'এক জায়গায় ইতস্তত ছড়িয়ে রাখা হয়েছে স্টেলাকাহিনি। ১৯৯৭ সালে ব্রিটিশ টিভি স্টোরি ‘ফর লাভ অর মানি’তে ধরে রাখা হয় স্টেলা মাজের জীবন। লেখক কোরালি ইয়ঙ্গারের নন-ফিকশন বই ‘Wicked Women of the Raj’-এর পাতায় পাতায় ব্রিটিশ প্রিন্সলি স্টেটের বেশ কিছু বিদেশি রানির ভেতর আলো করে আছেন স্টেলাও।

অবশ্য তাও আর কতটুকু! দিল্লির পৃথ্বীরাজ রোড ঘুরে এলে বিখ্যাত ক্রিশ্চিয়ান সিমেটেরি চোখে পড়বে। আর চোখে পড়বে রানির মৃত্যুর অনেকদিন পর অজ্ঞাতনামা কারও গড়ে তোলা ছোট্ট একটি এপিটাফ। সে স্মৃতিফলকে স্টেলার নাম আজও জলে লেখা-

‘Stella of Mudge

1904-1984

... A Fable ...’

কোথাও লেখা নেই কপুরথলার মহারানি শব্দটি। কারও ফুল না পড়া, ছায়া না পড়া এক ছাই ছাই রঙের ভাঙা কাদামাখা একলা কংক্রিট স্ল্যাব।

সত্যিই, নিঃশব্দ এক রূপকথা, এক ফেবল, মিস স্টেলা মাজ ...

তথ্যসুত্রঃ

১.ট্রিবিউন ইন্ডিয়া

২হিন্দুস্তান টাইমস

৩ মিডিয়াম

More Articles