কিছু বিক্ষিপ্ত ছবি এবং তার পিছনের কাহিনি
আজ বলবো কিছু ছবির পিছনে লুকিয়ে থাকা ইতিহাসের কথা, যা হয়তো আপনাদের নিয়ে যেতে পারবে সেই সময়ে। ছবির হাত ধরে আপনারা যেমন হারিয়ে যেতে পারবেন রবিবারের ডেনমার্কের কোন এক গলিতে, তেমনই আবার বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা বিস্ময় ঘটতে পারে মনে।
Northern European Children Celebrating Fastelavn
ফাস্টিলাভন মূলত শিশুদের উত্সব। ডেনমার্কের এই উত্সবটি পালিত হয়ে থাকে রবিবার কিংবা সোমবার । এই ছুটির দিনটি রোমান ক্যথলিক ঐতিহ্যের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠা পেয়ে থাকে। তবে সময়ের সঙ্গে আজ এই উত্সবটি নিজের রঙ হারিয়েছে। ঐতিহ্য বলে, অতীতে একটা ছোট পিপায় একটি কালো বিড়াল রাখা হতো এবং তারপর অনেকে মিলে ফাস্টেলাভন্সরিস ( এটি বিভিন্ন কিছু হতে পারে , যেমন – লাঠি কিংবা কোন গাছের ডাল) দিয়ে সেই পিপায় ক্রমাগত সজোরে আঘাত করতো যতক্ষণ না সেই পিপা সম্পূর্ণরূপে ভেঙে গিয়ে বিড়ালটি মুক্তি পায়। এই কালো বিড়ালটিকে মুক্তি দেওয়ার মাধ্যমে অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটানো হয় বলে অনেকে মনে করেন। এই রীতির সঙ্গে অনেকে অষ্টাদশ শতাব্দীতে প্রচলিত ‘গুড ফ্রাইডে’র সম্পর্ক আছে বলে আবার অনেকে মনে করেছেন। এই সময় যীশুর ক্রুশ বিদ্ধ হওয়ার যন্ত্রণাকে মনে করানোর জন্য বা তা অনুভব করানোর জন্য বাচ্চাদের চাবুক দিয়ে প্রহার করা হয়ে থাকতো । তবে এই প্রথা যে সব জায়গায় সমানভাবে প্রচলিত ছিল, তেমনটা নয়। এই ঘটনারও আগে, ‘গুড ফ্রাইডে’র দিনে বন্ধ্যা কিংবা অল্প বয়সী নারীদের চাবুকঘাত করার এক রীতির কথাও শোনা যায়। এবার আসা যাক উত্সবের কথায়, বিড়ালটি মুক্তি পেলে অঞ্চলের কচিকাচারা নানান সাজে সবাই মিলে লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে চকলেট সহ অন্যান্য আহারাদি এবং অর্থ দাবি করে। সবশেষে আবারো অশুভ শক্তিকে বিতাড়িত করার জন্য এক বিশেষ ধরনের গানও গাওয়া হয়ে থাকে এই দিনে। ডেনমার্ক এবং নরওয়েতে এই উত্সব পালিত হয়ে থাকে তবে এই উত্সবে যে সবাই আনন্দে গা ভাসান এমনটা নয় কারণ এই উত্সব মূলত পারিবারিক ঐতিহ্যকেন্দ্রিক।
Shell Shock In The Trenches
ছবিতে দেখা যাচ্ছে ‘সেল সক’এ আক্রান্ত রক্তাক্ত এক মানুষকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এই আধুনিক সময় আমরা যাকে বলি PTSD বা পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার, তাকেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পরিচিতি লাভ করেছিল ‘সেল সক’ নামে। ছবিটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন এক ছবি। যুদ্ধও যাদের প্রাণ কাড়তে পারেনি, সেসব সৈনিকরাও একদিন বাড়ি ফিরেছিল, বাড়ি ফিরেছিল ‘সেল সক’ নামক মানসিক এক যুদ্ধ রোগে আক্রান্ত হয়ে। যুদ্ধে অনবরত সেলের ব্যবহারে থেকে একরকম ভীতির জন্ম নিয়েছিল বেঁচে ফেরা মানুষগুলির মধ্যে। শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষগুলির মধ্যে নানানরকম সাংঘাতিক প্রতিক্রিয়া দেখা দিত এই রোগের কারণে। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার এই রোগ যে কেবলমাত্র যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছিল এমনটা নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যেও এই ভীতির জন্ম ঘটে। ‘সেল সক’ ছিল এমন এক রোগ যে ধীরে ধীরে তার জাল ক্রমশ বিস্তৃত করছিল অথচ রোগ নিরাময়ের কোন পন্থা কারোর জানা ছিল না। অনেকে নানান থেরাপির সাহায্য নিয়েছিলেন আবার অনেকের উপর প্রয়োগ করে হয়েছিল ইলেকট্রিক সক। জর্জ জেমসন অনুমান করেছেন, এই রোগের মূলে যুদ্ধে ব্যবহৃত সেল ছাড়াও এক বিরাট ভূমিকা পালন করেছিল জার্মানদের ব্যবহার করা ট্রেঞ্চ মর্টার। ইংরেজ চিকিৎসক চার্লস মায়ার্স আবার ১৯১৫ সালে তাঁ ‘সেল সক’এর প্রথম গবেষণা পত্রতে বলেছিলেন এই রোগটির লক্ষণগুলি আসলে কোন না কোন শারীরিক আঘাত থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি আরো বলেছিলেন, বরংবার বিস্ফোরণের সম্মুখীন হওয়ার কারণে, সৈনিকদের মস্তিষ্কে আঘাত লাগে এবং সেখান থেকেই এই লক্ষণের সৃষ্টি। একজন ইতিবাসবিদ অনুমান করেছেন, সেই সময় প্রায় ২০ শতাংশ পুরুষ এই মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন কিন্তু অনেকেই চিকিৎসায় অনিচ্ছা প্রকাশ করায় সঠিক সংখ্যা ঠিকভাবে বলা যায় না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই রোগ আবারও একবার ফিরে এসেছিল।
Mother And Baby In Gas Masks
এই ছবিটি তোলা হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন। একজন সদ্যজাত শিশুকে কোলে নিয়ে বিছানায় বসে আছেন তাঁর মা। উভয়ের মুখেই গ্যাস মাস্ক। মহিলাটি বোঝাচ্ছেন কীভাবে গ্যাস মাস্কের বেলোগুলিকে পাম্প করে শিশুর কাছে বাতাস পৌঁছে দেওয়া হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি এবং ব্রিটেনসহ আরো বিভিন্ন দেশ রাসায়নিক যুদ্ধ রীতি অবলম্বন করেছিল। সৈনিকরা এইসময় সেলে আবদ্ধ ক্লোরিন, ফসজেন এবং মাসটার্ড গ্যাসের ব্যবহারও করে। কিন্তু ১৯৩৪ সালে ব্রিটিশ গভর্মেন্ট আশঙ্কা করে নাত্সি জার্মানি হয়তো এই গ্যাস সাধারণ মানুষদের আক্রান্ত করার জন্য প্রয়োগ করবে তাই সেইসময় স্বল্প মূল্যে একধরনের গ্যাস মাস্ক তৈরি করার কথা ভাবেন এবং তৈরি করা হয় ‘সিভিলিয়ন রেস্পিরেটর’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেনে বসবাসকারী প্রত্যেকটি মানুষের জন্য একটি করে মাস্ক তৈরি করা হয় এবং কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আঞ্চলিক কেন্দ্রগুলি থেকে ৩৮ মিলিয়ন গ্যাস মাস্ক বিতরণ করা হয়। বয়স্ক মানুষদের জন্য মুখোশ ছিল কালো রঙের এবং ছোটদের জন্য এই মাস্ক ছিল লাল রঙের। এছাড়াও শিশুদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিল একধরনের গ্যাস হেলমেট, যা পাম্পের মাধ্যমে কার্যকরী হবে। এই ছবিতে ফুটে উঠেছে সেই দৃশ্যই।
তথ্যসূত্র –
১। https://spartacus-educational.com/spartacus-blogURL124.htm
২।https://www.iwm.org.uk/history/voices-of-the-first-world-war-shell-shock
৩। https://www.smithsonianmag.com/history/the-shock-of-war-55376701/
৪।https://stptrans.com/fastelavn-the-nordic-tradition-youve-probably-never-heard-of/
৫।https://www.scandinaviastandard.com/fastelavn-traditions-in-scandinavia/
চিত্র – গুগল।