কমলালেবু বিক্রেতার হাতে পদ্মশ্রী

ছবিতে যাদের দেখছেন তাদের মধ্যে একজন হলেন ভারতের বর্তমান রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোভিন্দ, যাকে মোটামুটি সব্বাই চেনেন। কিন্তু অন্যজন কে? উনি একজন ফল বিক্রেতা। যার হাতে ভারতের রাষ্ট্রপতি তুলে দিচ্ছেন পদ্মশ্রী পুরস্কার। কি চমকে উঠলেন? একজন ফল বিক্রেতার হাতে পদ্মশ্রী পুরস্কার!? যে পুরস্কার আচ্ছা আচ্ছা গুণী মানুষেরা পাওয়ার কথা স্বপ্নেও ভাবেন না, সেই পুরস্কার হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এক সামান্য ফল বিক্রেতা? কেন? কীভাবে? 
গল্পটা জানতে গেলে পাতা উল্টে পিছিয়ে যেতে হবে পুরানো দিনে। 

ছবিতে যিনি পদ্মশ্রী পুরস্কার হাতে দাঁড়িয়ে আছেন সেই ফল বিক্রেতার নাম হলো হরেকলা হাজব্বা। কর্ণাটকের ম্যাঙ্গালোরের অধিবাসী। সারাটা জীবন তার কেটেছে ম্যাঙ্গালোরের একটি বাস ডিপোতে কমলালেবু বিক্রি করতে করতে। সেই ১৯৭৭ সাল থেকে তিনি কমলালেবু বিক্রি করেন। শৈশব কেটেছে বড়ই অভাব অনটনে, পড়াশোনা করার সৌভাগ্যটুকু হয়নি তার। শিক্ষা সবার অধিকার হলেও, জোটে আর ক'জনের কপালে? হরেকলা হাজব্বার কপালেও জোটেনি। ১৯৭৮ সালের এক শীতের সকালে তার ফলের দোকানে আসেন এক বিদেশি ট্যুরিস্ট। তিনি ফলের দাম ইংরেজিতে জানতে চাইলে হরেকলা কিছুই বুঝতে পারেন না তাঁর ভাষা। ভাষা বুঝতে না পারলেও হরেকলা সেদিন এটা বোঝেন প্রথাগত এবং পুঁথিগত শিক্ষা জীবনে ঠিক কতটা প্রয়োজনীয়। তার তৎক্ষণাৎ মনে পড়ে নিজের গ্রামের ছোট ছোট বাচ্চাগুলোর কথা, যাদের কাছে শিক্ষার আলো পৌঁছায়নি তখনও। কারণ তার গ্রাম নিউপাডাপুতে ছিলো না কোনও স্কুল। ফলত গ্রামের সমস্ত শিশু ছিল অশিক্ষার সুবিস্তৃত আঁধারের চাদরে ঢাকা। 

শুরু হয় এক যুদ্ধ। দৈনিক ১৫০টাকা আয় করা ফল বিক্রেতা হরেকলা হাজব্বা সিদ্ধান্ত নেন তিনি তার জীবনের সমস্ত সঞ্চয় দিয়ে তার গ্রামে তৈরি করবেন একটি স্কুল। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনি নিজের গ্রামে কিনে নেন ১ একর জমি। তারপির বছরের পর বছর ধরে ধীরে ধীরে গড়তে থাকেন স্কুলবাড়ির ইঁট চুন সুরকি রড। আস্তে আস্তে তার স্বপ্ন পরিণত হয় বাস্তবে। বর্তমানে তার স্কুলে ছাত্রের সংখ্যা ১৭৫। তার তৈরি করা স্কুলে দশম শ্রেণী অবধি শিক্ষা প্রদান করা হয়। কিন্তু কেন এই স্কুল তৈরির স্বপ্ন? কেন এক সামান্য ফল বিক্রেতা নিজের জীবনের সমস্ত সঞ্চয়, উপার্জন খরচ করলেন গ্রামের শিশুদের শিক্ষার পিছনে? তার জুবানি ইংরেজি অনুবাদ করলে যা দাঁড়ায় তা হলো, 'I never had the opportunity to access education, and I didn't want the children in the village to suffer the pain'

হরেকলার স্কুল প্রচারের আলোয় আসার পর হরেকলাকে কর্ণাটকের বিভিন্ন সংস্থা থেকে পুরস্কৃত করা হয়, সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা থেকে পুরস্কারের যেটুকু অর্থ তিনি যখন যখন পেয়েছেন, তখন তখন তা তুলে দিয়েছেন নিজের স্কুলের তহবিলে। হরেকলার এই মহান কার্য্যকলাপের খবর দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ার পর, তাকে পদ্মশ্রী পুরস্কারে পুরস্কৃত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আজ থেকে ৪ দিন আগে তিনি যখন মাননীয় রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পদ্মশ্রী তুলে নিচ্ছিলেন তখন তার জন্য হাততালি দিচ্ছিলেন এই দেশের তাবড় তাবড় সম্মানীয় ব্যক্তিরা। এক ফল বিক্রেতা তার জীবদ্দশায় আবার প্রমাণ করে দিলেন, মানুষ সম্মানীয় হয় তার কাজের মাধ্যমে। 

'স্কুল তো হলো, কিন্তু এরপর কী?'
হরেকলাকে এই প্রশ্ন করলে উত্তর আসে, 'আমি আমার গ্রামে আরও স্কুল কলেজ খুলতে চাই। এই প্রাইজমানি দিয়ে আমি জমি কিনবো। আমি দেশের প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করতে চাই আমাদের গ্রামে একটা উচ্চমাধ্যমিক স্তরের স্কুল খুলে দেওয়ার জন্য'

More Articles