কল্পতরু রামকৃষ্ণের সামনে সেদিন কেঁদে ফেলেছিলেন গিরিশ
যেমন বিষবৃক্ষ হয়, তেমনই কল্পতরুও নাকি হয় ! বঙ্কিমচন্দ্র উপন্যাস লিখেছেন বিষবৃক্ষ নিয়ে, যে-বিষবৃক্ষ নষ্ট করে সংসার, সমাজ, জীবন, শান্তি। যে-বৃক্ষ দান করে যা কিছু চাওয়া যায়, প্রার্থনা করা যায়, করা যায় যাচনা সেই বৃক্ষের কাছে। যেমন কামধেনু, যে গাভী সংসারে ও পরিবারে নিয়ে আসে মঙ্গল, তেমনই কল্পতরু, যে-গাছ দান করে ধন, সম্পত্তি, স্বাস্থ্য, সুখ, মানসম্মান, প্রতিপত্তি ও সামাজিক ও পারিবারিক সমৃদ্ধি। আহা, এমন গাছ আর এমন গরু যদি সত্যি পাওয়া যেত ভুবনে ! কেউ কেউ কল্পতরুকে বলেন দেববৃক্ষ। যেমন দেবতা সাধারণ মানুষের জীবনেও দান করতে পারেন অপ্রত্যাশিত, অকল্পনীয় সমৃদ্ধি ! তাই কল্পতরুকে দেবতরু বা দেববৃক্ষ বলা যেতেই পারে।
কল্পতরুর দেখা পেয়েছি আমরা মানুষের পৌরাণিক কল্পনায়। সম্ভবত পৃথিবীর সমস্ত রূপকথাতেই এসব গাছ আছে, যে-গাছের কাছে মানুষ চায় মঙ্গল, শ্রী, সাংসারিক সুখ, পারিবারিক স্থিতি। মনে পড়ে যাচ্ছে, অস্কার ওয়াইল্ডের গল্পে সেই বরফ ঢাকা, প্রায় প্রাণহীন গোলাপ গাছ, যে-গাছের কাছে এক গরিব প্রেমিক চাইল একটি গোলাপফুল, প্রেমিকাকে দেবে বলে। কিন্তু গোলাপ গাছটিকে গ্রাস করেছে ভয়ংকর শীতের তুষার। তার মধ্যে লুপ্ত হয়েছে প্রাণের চিহ্ন। কেমন করে ফুটবে গোলাপ? একটি পাখি সেই গোলাপ গাছের কাঁটা বুকে ফুটিয়ে গাইল ভালোবাসার গান। আর সেই পাখির প্রাণের রক্ত গাছে ফোটাল রক্তগোলাপ ! প্রেমিকের প্রার্থনায় সাড়া দিল গোলাপ গাছ। হয়ে উঠল কলতরু!
এমন রূপকথার গল্পও কল্পনা করেছে মানুষ, যে-গল্পে কোনও ধনী মানুষ একদিনের জন্য হয়ে উঠলেন কল্পতরু এবং দান করলেন পার্থিব সুখ ও ক্ষমতার সেইসব সম্পদ, যা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে! এমন কল্পতরু– মানুষের অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয় সব দানের রূপকথা আমরা পড়েছি। কিন্তু কল্পতরু মানুষকে কি দেখেছি কোনও দিন? তবু মানুষ ভাবতে ভালোবাসে, আহা, যদি কোনও সাধক, বা বিপুল দাতা বা কোনও জাদুকর, সত্যিই হতে পারে কল্পতরু ! আর দান করতে সক্ষম হয় যা-কিছুই মানুষ প্রার্থনা করবে, সেই সমস্ত আকাঙ্ক্ষার জিনিস!
১৮৮৬–র পয়লা জানুয়ারি। কল্পতরু হলেন এক মহামানব, যিনি গলায় ক্যান্সার নিয়ে পৌঁছেছেন তীব্র যন্ত্রণার শেষ বিন্দুতে, যিনি কথা বলতে পারছেন না, মুখে হাসি নিয়ে অস্পষ্ট কাতর উচ্চারণে বলছেন, অসুখটা তো আমার শরীরের, আমার নয়। আর মাত্র সাত মাস তিনি পৃথিবীতে থাকবেন। ১৮৮৬–র পয়লা জানুয়ারি সকালবেলা উঠে বললেন, আজ বেশ আছি! তিনি নেমে এলেন সকালবেলার আলোয় কাশীপুরের বাগানবাড়ির বাগানে। ১৮৮৫–র ২৩ ডিসেম্বর শ্যামপুকুর স্ট্রিটের বাড়ি ছেড়ে এই মহামানব আশ্রয় নিয়েছেন কাশীপুরের বাগানবাড়িতে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই বাড়িতেই থাকবেন তিনি। তিনি শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস!
ঠাকুর কিছুক্ষণ আগে প্রকাশ করেছেন তাঁর মনের বাসনা। তিনি কল্পতরু হবেন। তাঁর শিষ্যদের মনের সকল বাসনা পূর্ণ করবেন তিনি। যে-যা চাইবেন, তাঁকে তা-ই দেবেন। শিষ্যরা, ভক্তরা ইতিমধ্যে ঠাকুরের দর্শনের জন্য বাগানবাড়ির বাগানে এসে জড়ো হচ্ছেন। তাঁদের মনে ভারি আনন্দ। তাঁদের প্রাণের ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ আজ ভালো আছেন। তাঁর গলার যন্ত্রণা আজ কি তাহলে কমেছে? তাঁর এই হঠাৎ আনন্দের কারণ কী? ঠাকুর তাকালেন চারধারে। তাঁর ভক্তদের মধ্যে উপস্থিত কারা?
শ্রীরামকৃষ্ণের প্রথমেই দৃষ্টি পড়ল কালীপদর উপর। কালীপদ তাঁর মাতাল ভক্ত। সারাক্ষণ মদ খেয়ে আছে। তবু শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে বড় ভালবাসেন ! কালীপদকে কাছে ডাকলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। কী মায়া, মমতা, ভালবাসা সেই ডাকে ! কালীপদ-র বুকে হাত রেখে শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন, কালীপদ, তোর মধ্যে জ্বলে উঠুক আধ্যাত্মিকতার আলো! আর সঙ্গে সঙ্গে এমন কিছু পরিবর্তন এল কালীপদর মধ্যে, এল এমন এক আনন্দের প্লাবন, যা এই মানুষটি আগে কখনও অনুভব করেনি!
এরপর শ্রীরামকৃষ্ণ তাকালেন আবার চারদিকে। ওই তো গিরিশচন্দ্র ঘোষ, আর ওই তো তাঁর দিকে তাকিয়ে রামচন্দ্র দত্ত, যাঁর চোখে-মুখে ঝরে পড়ছে ভক্তি আর প্রেম! শ্রীরামকৃষ্ণ এবার দৃষ্টি রাখলেন অক্ষয়কুমার সেনের উপর। এঁরা সবাই এগিয়ে এসে দাঁড়ালেন অসুস্থ গুরুর সামনে। শ্রীরামকৃষ্ণ কি কিছু বলতে চান? তাই তিনি রোগশয্যা ছেড়ে নেমে এসেছেন বাগানে?
গিরিশ করজোড়ে শ্রীরামকৃষ্ণের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। আর শ্রীরামকৃষ্ণ গিরিশের বুকে হাত রেখে বললেন, গিরিশ, তুমি নাকি প্রচার করে বেড়াচ্ছ আমি স্বয়ং ভগবান? তা কী এমন দেখলে গো আমার মধ্যে, কী গুণাবলির সন্ধান পেলে যে, তোমার মনে হল, আমি ভগবান?
গিরিশ ধীরে ধীরে উপবিষ্ট হলেন শ্রীরামকৃষ্ণের সামনে। তাঁর গাল বেয়ে নামছে কান্নাধারা। গিরিশ বললেন, ঠাকুর, ব্যাস-বাল্মীকি যাঁর বর্ণনা করতে পারেননি, ব্যাখ্যা করতে পারেননি যাঁর গুণাবলি, আমি সামান্য মানুষ হয়ে তাঁকে বর্ণনা করি কী উপায়ে! গিরিশের এই কথায় অপূর্ব আনন্দের এক প্লাবন এল শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যে ! তিনি তাঁর ভক্তদের দিকে তাকিয়ে বললেন, আজ আমার খুব আনন্দের দিন। তোরা যা চাইবি আমার কাছে, আজ আমি তাই দেব। যা খুশি প্রার্থনা কর তোরা। আমি আজ কল্পতরু। তোদের সমস্ত কামনা পূর্ণ করব!
ভক্তরা, শিষ্যরা, গিরিশ, কালীপদ, নিরঞ্জন, রামচন্দ্র, অক্ষয়কুমার- কেউ চাইতে পারলেন না কোনও পার্থিব সম্পদ, কোনও সামাজিক বা পারিবারিক সুখ বা প্রতিপত্তি বা সমৃদ্ধি ! কিছুই চাওয়ার নেই তাঁদের। শ্রীরামকৃষ্ণের সব দৈহিক যন্ত্রণার যেন অবসান হল সেই মুহূর্তে। যেন প্রশমিত হল তাঁর অসুখ।
'কী চাস তোরা?' প্রশ্ন করলেন শ্রীরামকৃষ্ণ।
ভক্তরা বললেন, আপনাকে, আর কিছু না।
শ্রীরামকৃষ্ণ কল্পতরু হয়ে দাঁড়িয়ে। ধ্যানমগ্ন তিনি। দীপশিখার মতো সুন্দর দেখাচ্ছে তাঁকে।
শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন, তোদের সকলের মধ্যে আলো ফুটে উঠুক। সত্যকে চিনতে পারিস যেন। যেন দেখতে পাস অনাবৃত সত্যের মুখ। যেন জানতে পারিস, কী তোদের আসল পরিচয়, যেন তোদের সকলের মধ্যে জ্বলে ওঠে আধ্যাত্মিক অনুভবের বিরল মুহূর্তটি– যার চেয়ে কাঙ্ক্ষিত রত্ন আর নেই!
কল্পতরু শ্রীরামকৃষ্ণের মুখে এই কথা উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সকলের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল এক স্বর্গীয় অপার্থিব অনুভূতি! এমন শান্তি তাঁরা প্রথম পেলেন জীবনে! প্রত্যেকের মনে হল, এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি কারও জীবনে আর হতে পারে না। স্বয়ং ঈশ্বর তাঁদের সামনে দাঁড়িয়ে কল্পতরু হয়ে। ঈশ্বর তাঁদের দিয়ে গেলেন তাঁর শ্রেষ্ঠ দান। আর কিছু চাওয়ার নেই!
রটে গেল এই বার্তা, শ্রীরামকৃষ্ণ আজ কল্পতরু। যে-যা চাইবে তাঁর কাছে, তাই পাবে। ছুটে এলেন আর এক ভক্ত, হারানচন্দ্র। হারানের যে অনেক কিছু চাওয়ার আছে। শ্রীরামকৃষ্ণ যেন ঘোরের মধ্যে। তাকালেন হারানের দিকে। কী চাইলেন হারান? চাইলেন, শ্রীরামকৃষ্ণের আশীর্বাদ! হারানের মাথা পা দিয়ে স্পর্শ করলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। আর হারানের কিছুই চাওয়ার রইল না। তাঁর সমস্ত জীবনের উপর যেন পা রেখেছেন স্বয়ং ঈশ্বর, মনে হল হারানচন্দ্রর। এর থেকে বেশি কী-ই বা পাওয়ার আছে?
অক্ষয় সেন বড় ভালবাসেন শ্রীরামকৃষ্ণকে। নিজেকে সমর্পণ করেছেন শ্রীরামকৃষ্ণের চরণে। কিন্তু আজও পাননি চরণস্পর্শের অধিকার ! ঠাকুর কি ডাকবেন না? অক্ষয় দু’টি চাঁপাফুল এনে ঠাকুরের চরণে রাখলেন। কল্পতরু ঠাকুর অমনি অক্ষয়কে কাছে টেনে তাঁর বুকে রাখলেন নিজের হাতটা। ঘটে গেল এক অবাক অভ্যুদয়! অক্ষয়ের মনে হল, স্বয়ং ভগবান তাঁকে দিলেন জীবনের মন্ত্র। অক্ষয় বুঝতে পারলেন, কে তিনি, অনুভব করলেন অস্তিত্বের অর্থ। অক্ষয়ের কল্পতরু শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে চাওয়ার মতো কিছু অবশিষ্ট রইল না! তিনি উপলব্ধি করলেন, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্য থেকে এক বিপুল শক্তি তাঁর মধ্যে সঞ্চারিত হচ্ছে। সেই শক্তিই একদিন অক্ষয়কে দিয়ে লিখিয়ে নেবে ‘শ্রীরামকৃষ্ণ পুঁথি’। অক্ষয় কিন্তু তখন, ১৮৮৬–র পয়লা জানুয়ারি, তা বুঝতে পারেননি। বুঝতে পারেননি, শ্রীরামকৃষ্ণের দৈবশক্তি প্রবিষ্ট হল তাঁর মধ্যে। এর থেকে বেশি কী চাই মানবের?
ভক্ত নবগোপাল ঘোষকে ডাকলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। বললেন, তোর কী চাই? নবগোপাল চুপ। ঠাকুর বললেন, তোর কাছে আমার কিছু চাওয়ার আছে। দিনান্তে ঈশ্বরের নাম জপ করবি, বুঝলি? নবগোপালের ভারি সাহসী ও সৎ উত্তর– ঈশ্বরের নাম জপ ! বলছ কি ঠাকুর ! আমার বিষয়-সম্পত্তি, বাণিজ্য, এসব রক্ষে করতে সমস্ত সময় ব্যয় করি আমি। ঈশ্বরের নাম জপ করার সময় নেই আমার। ওসব পারব না। নবগোপালের মুখে একথা শুনে সামান্য হাসলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। খুশি হলেন, নবগোপাল সত্যি কথা বলেছেন বলে। তারপর মৃদু কৌতুকে বললেন, শোন নবগোপাল, তুই তো আমাকে খুব ভালবাসিস। আমার নামটি শুধু একটিবার জপ করতে পারবি সারাদিনে?
নবগোপাল উত্তর দেয়, 'তা পারব। কিন্তু তাতে হবে কী?'
‘একবার জপ করে দ্যাখ, সব কিছু ভুলে শুধু একটিবার বল্, শ্রীরামকৃষ্ণ।' নবগোপাল তাই করলেন। সঙ্গে সঙ্গে আলোর সমুদ্রে ভেসে যান নবগোপাল। বলেন, ‘ঠাকুর আমি আর কিছু চাই না। ধন-সম্পত্তি-বাণিজ্য-অর্থসুখ- কিচ্ছু না। এখন আলোক সমুদ্রে ভাসতে চাই, সারা জীবন!'
গিরিশ ততক্ষণে এক কাণ্ড করেছেন। রান্নাঘর থেকে রান্নার ঠাকুরকে ডেকে এনে শ্রীরামকৃষ্ণকে বলেছেন, আপনি আজ এঁরও কল্পতরু হোন। ঠাকুর তাই করেন। গিরিশের প্রার্থনা রাখেন ঠাকুর। রান্নাঘরের ঠাকুরের সারা শরীর-মন জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে শুধু শান্তি। সেই শান্তি ও সুখ কেউ কেড়ে নিতে পারে না তার কাছ থেকে বাকি জীবন!
‘আর তোর কী চাই উপেন?'
উপেন মুখার্জিকে জিজ্ঞেস করেন শ্রীরামকৃষ্ণ। শ্রীরামকৃষ্ণ যেন জানেন, কী চাইবেন উপেন।
উপেন বলেন, আমি চাই শুধু অর্থ। অর্থ ছাড়া আর কিছুই চাই না আমি। অর্থই সব।
‘উপেন, একটু ভেবে বল,’ বলেন শ্রীরামকৃষ্ণ।
উপেন বলেন, ‘ভেবেই বলছি। আপনি আমাকে অর্থ দিন।'
শ্রীরামকৃষ্ণ উপেনের মাথায় হাত রেখে বলেন, ‘তবে তাই হোক উপেন। তুই যখন জ্বালা-যন্ত্রণা-অশান্তিই চাস, তাই পাবি। অনেক অর্থ হবে তোর।'
উপেন মুখোপাধ্যায় অর্থের সমুদ্রে ভাসলেন একদিন। আর ক্রমাগত রক্তাক্ত হলেন হাঙরের কামড়ে। এমন যন্ত্রণার জীবন হতে পারে! ক্রমশ মনে হতে লাগল উপেন্দ্রর।
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস তখন ইহলোকে নেই।