ইংল্যান্ডের জাতীয় কংগ্রেসের পতাকা উড়িয়ে ব্রিটিশ সরকারকে রক্তচক্ষু দেখিয়েছিলেন এই হারিয়ে যাওয়া বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামী

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বাঙালিদের অবদান সবথেকে বেশি বললে হয়তো খুব একটা ভুল বলা হবে না। সবথেকে বেশি স্বাধীনতা সংগ্রামী তৈরি করা থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি ভারতবাসির মনে স্বাধীনতার বীজ বপনের অঙ্গীকার করেছিল বাঙালি। বাঙ্গালীদের আত্মমর্যাদায় রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে রয়েছেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল সহ আরো অনেকেই। রজনীকান্ত থেকে শুরু করে, মোহিনী চৌধুরী, আবার বিনয়-বাদল-দীনেশ থেকে শুরু করে যতীন দাস সকলেই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নিজের ছোট্ট অবদান রেখেছিলেন।

ভারতকে স্বাধীন করার যে প্রচেষ্টা তারা করেছিলেন তার জন্য অবশ্যই তাদেরকে কুর্নিশ। কিন্তু বহু স্বাধীনতা সংগ্রামী এমন রয়েছেন, যাদের হয়তো আমরা ইতিহাসের বইতে পড়ি না, হয়তো তাদের অবদান আমরা ততটা মনে রাখিনা, কিন্তু তারা রয়েছেন। ভারতের ঘটনাবহুল ইতিহাসে কোথাও না কোথাও তাদের ছোট্ট অবদান রয়ে গিয়েছে। তাদেরকে হয়তো আমরা কখনো মনে রাখি না, কিন্তু ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের অবদানও একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো নয়।

এরকমই একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, তথা স্বাধীনতা সংগ্রামী হলেন ডক্টর নলিনাক্ষ সান্যাল। বর্তমান প্রজন্মের কাছে তিনি হয়তো হারিয়ে যাওয়া একটি নাম। কিন্তু, ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, বিদেশে গিয়ে ভারতের ইতিহাসকে গৌরবান্বিত করার পিছনে তার একটা বড় অবদান ছিল। আজকে তারই জীবনকথা নিয়ে আলোচনা।

সালটা ১৮৯৮। নদীয়া জেলার জলঙ্গি নদী তখন একটা বৃহৎ বড় নদী। কলকাতা থেকে ফৌজ নিয়ে গঙ্গা জলঙ্গি হয়ে বড় বড় নৌকা এবং স্টিমার পদ্মা নদী পার করে বিভিন্ন জায়গায় যেত। সেই জলঙ্গী নদীর তীরে অবস্থিত ঘোড়াদহ বহু প্রাচীন একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম ছিল সেই সময়। সেই গ্রামের অবস্থা এখন অত্যন্ত খারাপ হয়ে গেলেও, এই গ্রামের সাথে জড়িয়ে রয়েছে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ২ জন কৃতি সংগ্রামীর ইতিহাস। একজন হলেন অনাদি কান্ত সান্যাল। এবং অপরজন হলেন তারই মেজো ভাই, আজকে যার বিষয়ে প্রধান আলোচনা, অর্থাৎ নলিনাক্ষ সান্যাল।

১৮৯৮ এর ২২ নভেম্বর এই গ্রামের একটি জমিদার বংশে নলিনাক্ষ সান্যাল এর জন্ম। তিনি ছিলেন বাংলার একজন কৃতি সন্তান, দেশপ্রেমিক, স্বাধীনতা সংগ্রামী, রাজনীতিবিদ, সফল ব্যবসায়ী, স্পোর্টসম্যান এবং অর্থনীতিবীদ। পিতা রজনীকান্ত সান্যাল ইংরেজ আমলে বহরমপুর আদালতের একজন আইনজীবী ছিলেন। তার তিন পুত্র - অনাদি কান্ত সান্যাল, নলিনাক্ষ সান্যাল এবং শক্তিপদ সান্যাল। শক্তিপদ বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন।

অন্যদিকে, অনাদি কান্ত সান্যাল ছিলেন বিপ্লবী বারীন ঘোষ এর অনুশীলন সমিতির সক্রিয় সদস্য। স্বদেশী ডাকাতি মামলার দায় অনাদিকান্তকে ইংরেজ পুলিশ একটা সময় গ্রেপ্তার করেছিল। যদিও তার মুখ থেকে কোন কথা বার করতে পারেনি তারা। অবশেষে তাকে বেশ কিছুদিন অন্তরীণ করে রাখা হলে ১৯১০ সালে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে রেখে তিনি মারা যান।

আর মেজ পুত্র নলিনাক্ষ সান্যাল প্রথম থেকেই ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। পেশা সূত্রে রজনীকান্ত সান্যাল পড়শী জেলার সদর টাউন বহরমপুরে একটি বাড়ি তৈরি করেছিলেন, যেটি বর্তমানে সান্যাল বাড়ি হিসেবে বেশি পরিচিত। নলিনাক্ষ বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ এবং প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশোনা করেছেন। তারপরে স্কলারশিপ পেয়ে বিলেতে গিয়ে লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্সে পড়াশোনা করেন তিনি। সেখানে অর্থনীতির অন্যতম শিক্ষক পন্ডিত হ্যারল্ড লাস্কির অধীনে তিনি গবেষণা করতে পেরেছিলেন। লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্স থেকে ১৯২৮ সালে তিনি অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন।

কিন্তু লন্ডনে থাকাকালীন সময় থেকেই তার মনে দেশাত্মবোধ এবং জাতীয়তাবাদের একটা বীজ বপন হয়ে গিয়েছিল। লন্ডনে থাকাকালীন সময়ে তিনি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং লন্ডনের একটি সরকারি ভবনে কংগ্রেসের পতাকা ওড়ান। যদিও তার এই কৃতকর্মের জন্য তাকে কারাবাস ভোগ করতে হয়েছিল। শুধু তাই নয়, সাইমন কমিশনের বয়কট এর জন্যও তার কারাবাস হয়েছিল। যদিও, কারা জীবনে থাকাকালীন সময়েও তিনি নিজের গবেষণা চালিয়ে যান। নিজের থিসিস পেপারের বেশ কিছু অংশ লেখেন তিনি ওই সময়ে। এছাড়াও, তিনি নিজের গবেষণার বেশকিছু আঙ্গিক তুলে ধরেন ওই সময়ে কারাবাসে থাকাকালীন।

দেশে ফিরে এসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। কিন্তু নলিনাক্ষ সান্যাল প্রথম থেকেই স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েন। ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে একাধিক কার্যকলাপে জড়িয়ে থাকার কারণে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে বরখাস্ত করে তৎকালীন বৃটিশ সরকার। তারপরে নিউ ইন্ডিয়া ইন্সুরেন্স কম্পানি, দ্য মেট্রোপলিটন ইনসিওরেন্স কম্পানি, হিন্দুস্তান কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের কোম্পানিতে দীর্ঘ বেশ কয়েক বছর কাজ করে নলিনাক্ষ সান্যাল। শোনা যায় বাংলার বাঘ আশুতোষ মুখার্জির সঙ্গেও তার যোগাযোগ ছিল অত্যন্ত নিবিড়।

যদিও, তাকে স্বাধীনতা আন্দোলনের সমস্ত পাঠ পড়িয়েছিলেন যতীন দাস ওরফে বিপ্লবী বাঘা যতীন। তার যুগান্তর দলে থাকাকালীন সময়ে ব্রিটিশ সরকারের ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে একাধিক কর্মসূচিতে যোগদান করেছিলেন নলিনাক্ষ সান্যাল। তারপরে তার পরিচয় হয় চিত্তরঞ্জন দাশের সাথে। তার হাত ধরেই তিনি জাতীয় কংগ্রেসের সদস্য পদ গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে কংগ্রেসের একজন প্রথম সারির নেতা হিসেবে পরিচিত হয়ে যান নলিনাক্ষ সান্যাল। তার অসাধারন বাগ্মিতা এবং তার বক্তৃতার আঁচ এতটাই তীব্র ছিল যে, বহু স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং তৎকালীন সময়কার কংগ্রেসের বহু নেতা তার অনুগামী হয়ে ওঠেন। ১৯৩৭ থেকে টানা দশ বছর পর্যন্ত বঙ্গীয় আইনসভার একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন নলিনাক্ষ সান্যাল।

শুধু তাই নয়, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের সঙ্গে তার একটা আত্মিক যোগাযোগ ছিল। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ১৯২৩ সালে যখন জেল থেকে ছাড়া পান, সেই সময় তাকে সর্বপ্রথম সংবর্ধনা দিয়ে বরণ করে নিয়েছিলেন তার অত্যন্ত কাছের বন্ধু এই নলিনাক্ষ সান্যাল। বহরমপুর এর জেল গেট থেকে শোভাযাত্রা করে তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। ১৯৪৩ সালের ভয়াবহ মন্বন্তর এবং ১৯৪৬ সালের কলকাতার দাঙ্গার সময় তিনি নিজেও সামনে থেকে দাঁড়িয়ে এই সমস্ত সমস্যার মোকাবিলা করেছিলেন। ব্রিটিশবিরোধী ভূমিকা পালন করার জন্য তাকে মোট সাতবার কারাবরণ করতে হয়েছিল বলেও জানা যায়।

দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি নিয়ে অধ্যাপনা চালিয়ে গিয়েছেন তিনি। আধুনিক চিন্তাভাবনার মানুষ ছিলেন ডঃ নলিনাক্ষ সান্যাল। তিনি কুসংস্কার এবং সংকীর্ণ জাতপাতের ধার ধারতেন না। তার বিবাহের সময়ও তিনি ধর্মীয় রীতিনীতি এবং কুসংস্কারকে দূরে ঠেলে দিয়ে বিবাহ করেছিলেন। শোনা যায়, নিজের বিবাহ অনুষ্ঠানে নাকি তিনি কোনরকম ধর্মীয় সংস্কার এবং গোঁড়ামিকে প্রশ্রয় দেননি। বরং তৎকালীন হিন্দু সমাজ পতিদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে শালগ্রাম শিলা এবং পংক্তি ভোজনের প্রথাকে বাতিল করে তিনি বিবাহ করেন। এই বিবাহে তিনি আমন্ত্রন করেছিলেন তার বন্ধু কাজী নজরুল ইসলামকে। যদিও সেই বিষয়টি নিয়ে উত্তাল হয়ে উঠেছিল বিয়ের মঞ্চ।

নলিনাক্ষ সান্যাল এর বিবাহের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। পাশাপাশি তিনি তার বিয়ের অনুষ্ঠানে বরযাত্রী গিয়েছিলেন। সেখানে অন্য বরযাত্রীদের থেকে অনেকটা দূরত্ব রেখে নজরুল ইসলামকে খেতে দেওয়া হয়েছিল বলে রীতিমতো দাঙ্গা বেঁধে গিয়েছিল সেই জায়গায়। পরবর্তীতে, নজরুল সকলকে বুঝিয়ে শান্ত করেন এবং সেই রাতেই জাতি ধর্ম নিয়ে তিনি একটি বিস্ফোরক কবিতা রচনা করেন যা আজকেও সমানভাবেই প্রাসঙ্গিক। 'জাতের নামে বজ্জাতি সব' শীর্ষক কবিতায় তিনি তৎকালীন সময়ের ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং জাতপাতের নোংরা রাজনীতির স্বরূপ তুলে ধরেছিলেন।

পরেরদিন সকালেই, সেই বাড়ির মালিক শরৎ চন্দ্র ভট্টাচার্য দেখতে পান বাড়ির কালী মন্দিরে বসে চোখ বন্ধ করে কাজী নজরুল ইসলাম শ্যামা সংগীত গাইছেন আর তার চোখ থেকে জল ঝরছে। তৎকালীন সময়কার সংকীর্ণ জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে একটা সংগ্রাম গড়ে তুলেছিলেন নলিনাক্ষ সান্যাল। জাতপাতের ঊর্ধ্বে উঠে সমাজব্যবস্থাকে আবারও নতুন করে গড়ে তুলতে কে ছিলেন ডঃ নলিনাক্ষ সান্যাল। কবি বন্ধু যতীন্দ্রমোহন বাগচীর ডাকে সাড়া দিয়ে নলিনাক্ষ সান্যাল জলতল আন্দোলনে যোগদান করেছিলেন এবং সেখান এই আন্দোলনকে সফল করার জন্য সব রকম প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। নলিনাক্ষ সান্যাল এবং যতীন্দ্রমোহন বাগচী ছিলেন প্রথম যারা নমঃশূদ্র পরিবার থেকে জল পান করেছিলেন এবং সেই যুগের জাতিভেদ এবং অস্পৃশ্যতার কুসংস্কারের দেওয়াল ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন।

ভারতের স্বাধীনতার পরেও করিমপুর এবং নদিয়া মুর্শিদাবাদ এর বৃহৎ অংশে ভারত পাকিস্তানের মধ্যে সমস্যা শুরু হয়েছিল।  যেহেতু নদীয়া জেলাটি কিছুটা হলেও সীমানার কাছে অবস্থিত, তাই সেই সময় সেখানকার অঞ্চল ভারত থেকে পাকিস্তানে নিয়ে যাবার জন্য সাম্প্রদায়িক গোলযোগ শুরু হয়েছিল সেই এলাকায়। নদীয়া এবং মুর্শিদাবাদের বেশকিছু মানুষ সেই সময় ভারত পাকিস্তানের মধ্যে এই সংঘর্ষের মুখে পড়েছিলেন। ভারত এবং পাকিস্তান উভয় দিকের উচ্চপদস্থ মৌলবাদীদের একাধিক দাবির বশবর্তি হয়ে এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামা শুরু করেছিল পাকিস্তানের মানুষজন। এমনকি শিকারপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৫ ও ১৬ আগস্ট পরপর দু'দিন পাকিস্তানের পতাকা শোভা পেয়েছিল। সেই সময় দুই গোষ্ঠীর মধ্যে ছোটখাটো সংঘর্ষ হয়েছিল।

পাকিস্তানের তরফ থেকে স্লোগান উঠেছিল, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান। অন্যদিকে, ভারতের পক্ষ থেকে স্লোগান উঠেছিল, 'মানবের তরে মাটির পৃথিবী/ দানবের তরে নয়।' সেই আন্দোলনে ভারতীয়দের পক্ষ থেকে অত্যন্ত সদর্থক ভূমিকা পালন করেছিলেন নলিনাক্ষ সান্যাল। ভারতের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য এলাকার শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ দের নিয়ে তিনি সামনে থেকে এই লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। অবশেষে ধোড়াদহ, শিকারপুর এবং করিমপুর অঞ্চলের নদীয়া জেলার অন্তর্ভুক্ত করে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন ডক্টর নলিনাক্ষ সান্যাল। এই কারণেই, নদীয়া এবং মুর্শিদাবাদের বেশ কিছু অঞ্চলে কিন্তু স্বাধীনতা দিবস ১৫ আগস্ট নয় বরং পালিত হয় ১৭ আগস্ট।

স্বাধীনতার পরেও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের একজন একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে কাজ করেছেন ডক্টর নলিনাক্ষ সান্যাল। কিন্তু তারপর ১৯৬৭ সালে অজয় মুখোপাধ্যায় এর সঙ্গে কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে আলাদা বাংলা কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। আবারো মনোমালিন্য হওয়ায়, ১৯৬৯ সালে দল পরিত্যাগ করে প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ এর পিডিএফ মন্ত্রী সভায় যোগদান করেছিলেন। তারপরে আবার করিমপুর বিধানসভা থেকে নির্বাচিত হন। নিজের এলাকায় তিনি বিদ্যালয় এবং কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছাত্র-ছাত্রীদের সঠিক শিক্ষা দেওয়ার জন্য তিনি নিজের প্রচেষ্টায় গড়ে তুলেছিলেন স্কুল এবং কলেজ।

শিক্ষানুরাগীদের নিয়ে ১৯৬৮ সালে পান্নাদেবী কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি যা বর্তমানে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ। তবে শুধুমাত্র যেস্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছেন তাই নয়, তিনি যে শিক্ষানুরাগী হওয়ায় বেশ কিছু বই এবং প্রবন্ধ লিখেছেন তিনি। তার রচিত ব্যবসায়-বাণিজ্য শিরোনামের একটি বইয়ে তিনি আর্থিক বিষয় এর বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। বাংলার অর্থনীতি, বাংলার অর্থ সামাজিক ব্যবস্থা, গোলটেবিল বৈঠক, রিজার্ভ ব্যাংকের প্রস্তাব, পাট রপ্তানি শুল্কের সালতামামি, সহ আরো বেশ কিছু বিষয় নিয়ে তিনি এই বইয়ে আলোচনা করেছেন।

এছাড়াও, ১৯৩০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার লেখা ভারতীয় রেলওয়ের উন্নতি এবং অগ্রগতি নিয়ে একটি বই প্রকাশিত হয়েছিল। উল্লেখ্য, ডক্টর নলিনাক্ষ সান্যাল ভারতীয় রেলওয়ের একটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ পদে বেশ কিছুদিনের জন্য চাকরি করেছিলেন। সেই সুবাদে, ভারতীয় রেলের অগ্রগতির বিষয়ে তিনি বেশ ওয়াকিবহাল ছিলেন। ডক্টর নলিনাক্ষ সান্যাল একজন সমাজকর্মী হিসেবেও বেশ পরিচিত। ব্রতচারীর প্রবক্তা বন্ধু গুরুসদয় দত্তের সঙ্গে একটি যৌথ উদ্যোগ নিয়ে নকশাল আন্দোলনে যুক্ত যুবকদের জীবনের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছিলেন ডক্টর নলিনাক্ষ সান্যাল। ১৯৮৭ সালের ২৯ অক্টোবর কলকাতার হিন্দুস্তান রোডের বাড়িতে এই প্রতিভাবান মানুষটির মৃত্যু হয়। নদীয়ার সেই সমস্ত গ্রামে আজও ডক্টর নলিনাক্ষ সান্যাল অত্যন্ত পূজনীয় একজন ব্যক্তি। নদীয়া এবং মুর্শিদাবাদের বিস্তীর্ণ অঞ্চল যেখানে পাকিস্তানি সেনার হামলা হয়েছিল, সেখানের স্বাধীনতার লড়াইয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নলিনাক্ষ সান্যাল। কিন্তু তবুও, ইতিহাসের পাতায় এই বর্ণময় ব্যক্তিটি কোথাও যেন হারিয়ে গেলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামী, এবং অর্থনীতিবিদদের তালিকায় যেখানে উপরের দিকে নাম থাকার কথা ছিল নলিনাক্ষ সান্যালের সেই তালিকায় ঠাঁই হলো না তার। ধীরে ধীরে কালের প্রগতিতে নব প্রজন্ম ভুলেই গেল বাঙালি এই স্বাধীনতা সংগ্রামীকে, যিনি ইংল্যান্ডে কংগ্রেসের পতাকা উড়িয়ে ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থাকে নিজের রক্তচক্ষু দেখিয়েছিলেন।

More Articles