জুড়াইতে চাই

ঊনবিংশ শতাব্দীতে অসংখ্য কালোত্তীর্ণ নাটকের রচয়িতা গিরিশচন্দ্র ঘোষের 'বুদ্ধচরিত' নাটকের সেই বিখ্যাত গান আজও আমাদের ভাবুক করে তোলে........


"জুড়াইতে চাই, কোথায় জুড়াই ....
কোথা হতে আসি, কোথা ভেসে যাই |"


হিন্দু ধর্মাবলম্বী-দের বিশ্বাস অনুযায়ী বুদ্ধদেব ভগবান বিষ্ণুর দশ অবতারের মধ্যে এক অবতার। আজ থেকে প্রায় ২৫৬৪ বছর আগে ভগবান বুদ্ধের আবির্ভাব হয়েছিল। তিনি ছিলেন 'তথা' অর্থাৎ ঈশ্বরলোক থেকে আগত, তাই তাঁর নাম "তথাগত"। এই তথাগতের কাছে এসে উপস্থিত হয়ে বিশ্বের মানুষ প্রাণ জুড়াতে পেরেছিল। তাঁর প্রেম,করুনা, মৈত্রী ও অহিংসার বাণী শুনে জগতের মানুষ শান্তি পেয়েছিল। তাই পৃথিবীর অশান্ত পরিবেশ দেখে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন...... "বুক ভরা প্রেম ও করুনা নিয়ে শত শত বুদ্ধের আবির্ভাব প্রয়োজন"।

মানব সমাজের যাবতীয় দুঃখ কষ্ট ও বেদনার উৎপত্তি কোথায় এবং তার প্রতিকার কী এই প্রশ্ন সেই শাক্যবংশ-জাত করুণাময় ব্যক্তির হৃদয়কে উদ্বেলিত করেছিল। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে তিনি সর্বত্যাগী হয়ে কঠোর তপস্যা করেছিলেন,নিরঞ্জনা নদীর তীরে বোধি বৃক্ষের নিচে। সাধনা করতে করতে তাঁর তপঃক্লিষ্ট দেহ জীর্ণ,শীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। হবেই তো..... তিনি তপস্যার শুরুতেই ঘোষণা করেছিলেন "ইহাসনে শূষ্যতু মে শরীরম্".......অর্থাৎ এই আসনে তপস্যায় নিরত আমার দেহ শুষ্ক হয়ে যাক।বিশ্ববাসীর সকল আর্তি হরণের জন্য যেমন তীব্র সংকল্প, তেমনই সাংঘাতিক ছিল সেই প্রতিজ্ঞা। স্নেহময়ী সুজাতা ঠিক সময় এসে সেই জীর্ণ দেহ বুদ্ধদেবকে পায়েস না খাওয়ালে সেই দেব-দুর্লভ দেহ বোধহয় ধ্বংস হয়ে যেত।তাঁর কাছে সেই তপস্যায় সিদ্ধিলাভ ছিল বস্তুত পক্ষে জীবন ও জগতের চিরন্তন সত্য সম্মন্ধে সঠিক বোধে উপনীত হওয়া | সেই বোধে তিনি উপনীত হয়েছিলেন | তাই তিনি বুদ্ধ | সাধনার মধ্যে দিয়ে তাঁর মধ্যে যে বোধ জেগেছিল, তারই কথা তিনি বিশ্ববাসীর কাছে সহজবোধ্য ভাষায় প্রচার করেছিলেন।

তিনি ছিলেন প্রকৃত পক্ষে একজন মহান দার্শনিক এবং মহান শিক্ষক।তবে তাঁর দার্শনিকতা ও শিক্ষা মোটেই গতানুগতিক ছিলনা। তিনি শিক্ষা দিলেন.....।জগতের সকল দুঃখের কারণ হলো ভোগের তৃষ্ণা, আসক্তি এবং স্বার্থপরতা।এই আসক্তির হাত থেকে মুক্তি লাভের জন্য বুদ্ধদেব আটটি নিয়ম নির্দেশ শেখালেন........ সম্যক দৃষ্টি (অর্থাৎ সঠিক জীবনবোধ), সম্যক সংকল্প, সম্যক বাক্য, সম্যক জীবিকা, সম্যক স্মৃতি (জাগতিক স্পৃহার বেড়াজাল থেকে মুক্তি), সম্যক প্রচেষ্টা, সম্যক কর্ম এবং সম্যক সমাধি (পরিপূর্ণ আত্মউপলব্ধি) |

ধর্মশিক্ষা দানকালে বুদ্ধদেব Classical Language (সংস্কৃত ভিত্তিক ভাষা) ব্যবহার করতেন | জীব কল্যাণের জন্য বুদ্ধদেব শেখালেন যে অ-ক্রোধের দ্বারা ক্রোধ ত্যাগ করতে হবে।মানুষের দ্বারা মানুষের লাঞ্ছনা এবং অমর্যাদা তাঁকে ভীষণ ভাবে ব্যথিত করেছিল | তিনি স্বয়ং সমাজের উচ্চবর্ণের মানুষদের দ্বারা নিম্ন বর্ণের মানুষদের লাঞ্ছনা প্রত্যক্ষ করেছিলেন এবং ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তাই স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন -------- "Unrivalled Sympathy Towards Mankind " এটাই ছিল বুদ্ধদেবের ভাবনার সারকথা |

তাঁর করুনা এবং শিক্ষাদান প্রকাশিত হতো বিচিত্র পথে | যেমন রাজা বিম্বিসার ছিলেন বুদ্ধদেবের শরণাগত | সেই রাজা বিম্বিসারের পত্নী ক্ষেমা বুদ্ধের কাছ থেকে তাঁর স্বামীকে সরিয়ে নিতে এসেছিলেন | বুদ্ধদেব ক্ষেমাকে নদী থেকে পানীয় জল আনতে বললেন | জল আনতে গিয়ে ক্ষেমা নিজেকে জলে কঙ্কাল রূপে প্রবিম্বিত দেখলেন | তাই দেখে ক্ষেমার বোধোদয় হলো যে মানুষের জীবন ও যৌবন ক্ষণস্থায়ী | তার মনোভাব বদল হলো এবং তিনি বুদ্ধে শরণ নিলেন |

আম্রপালী (নগরণটি ও নর্তকী) বুদ্ধদেবকে স্বগৃহে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন | বুদ্ধদেব সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলেন | তিনি বুঝেছিলেন যে আম্রপালীর মানসিক উন্নতি হয়েছে | এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে বুদ্ধদেবের সোমদর্শিতা প্রকট হয় |

এক ফুল বিক্রেতা নগরে ফুল বিক্রি করতে এসেছিল | সেই ফুলগুলি কেনার জন্য বিভিন্ন লোক বিভিন্ন মূল্য দিতে আগ্রহী ছিল | ফুল বিক্রেতার মনে হলো যে ফুলগুলি আরও বেশী মূল্য পাওয়ার যোগ্য, যে মূল্য ইচ্ছুক ক্রেতারা দিতে অপারক | ফুল বিক্রেতা খবর পেয়েছিল যে এই নগরে স্বয়ং বুদ্ধদেব আছেন | সে ভাবলো যে একমাত্র বুদ্ধদেবই তার ফুলের উচিত মূল্য দিতে পারবেন | তাই সে বুদ্ধদেবের কাছে তার বিক্রয় - সামগ্রী (অর্থাৎ ফুল) নিয়ে গেল | বুদ্ধদেব তার ফুলের মূল্য জানতে চাইলেন | বুদ্ধদেবকে দর্শন করে সে এটি অভিভূত হলো যে ফুলের বিনিময় মূল্য চাইতে পারলো না। সে বুদ্ধদেবের চরণধূলি প্রার্থনা করল | এই রকম বহু ঘটনার মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে যে শুধুমাত্র বুদ্ধদেবের নীরব উপস্থিতি বহু মানুষের বোধের উদয় ঘটিয়েছে |


এক বৃদ্ধা ভিখারি সারাদিনের চেষ্টায় একটি মাত্র রুটি ভিক্ষা জোগাড় করতে পেরেছিলেন | তিনি কিন্তু বুদ্ধদেবকে অন্তর থেকে ভালবাসতেন | তিনি এসে বুদ্ধদেবকে সেই ভিক্ষালব্ধ রুটিটি অর্পণ করলেন | বুদ্ধদেব সেই ভিখারিনীর ভিক্ষালব্ধ রুটিটি সানন্দে গ্রহণ করলেন এবং তাকে আশীর্বাদধন্য করলেন |

বুদ্ধদেব গৃহস্থ ব্যক্তিদের মধ্যে প্রথম দীক্ষাদান করলেন এক নাপিতকে | তিনি নির্বিচারে দীক্ষাদান করেছেন |

তিনি শিক্ষা দিয়েছেন যে জীব যখন জগৎ কল্যাণের জন্য সর্ব্বস্ব ত্যাগ করতে পারে, তখনই তার উন্নতি হয় | মহাপরিনির্বাণ লাভ হয় |

বুদ্ধদেব ভগবানের কর্তৃত্ব স্বীকার করতেন না | তিনি বলতেন........"তুমি নিজেই তোমর প্রভু, আর কেহ নয়" | তিনি আত্মা-পরমাত্মায় বিশ্বাস করতেন না | তিনি বেদ বিরোধী ছিলেন | অথচ বেদ ভারতের আধ্যাত্বিকতার ভিত্তি | স্বামী বিবেকাননন্দ তাই বলতেন যে বুদ্ধদেব ছিলেন সনাতন ধর্মের বিদ্রোহী সন্তান |

তিনি যাদের সন্ন্যাস দীক্ষা দিয়েছিলেন, তাদের জন্যে ত্যাগ-বৈরাগ্যে ভরপুর অনেক কঠিন অনুশাসন ব্রত নির্দেশ দিয়েছিলেন | তবে তাঁর অনেক সন্ন্যাসী ভক্ত সেই কঠিন অনুশাসন মানেননি | তাঁর দেহাবসানের পর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে তন্ত্র সাধনার প্রবেশ হয়েছিল | সেই কারণে বৌদ্ধ ধর্মের পতন হয়েছিল |

 

তথ্য সূত্র : লেখকের নিজস্ব সংগ্রহ

More Articles