আলভিদা কে কে! লক্ষ মানুষের মনের কোণে এখনও বেজে চলেছে তাঁর গান

একটা সময়ের কণ্ঠস্বর তিনি, নয়ের দশকে গড়ে ওঠা প্রজন্মের কাছে তো বটেই, আসমুদ্রহিমাচল বহু মানুষের কাছেই কে কে সময়ের চিহ্ন।

কিছু মানুষের জন্য হাহাকারের এতখানি রাখা থাকে, শব্দের গাছপাথরও তার কূল পায় না। কিছু মানুষের শূন্যতায় রাতের অন্ধকার হয়ে ওঠে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর। ভোর সেই রাতের ঘোর কাটাতে পারে না। এখন এই উপমহাদেশের প্রতিটি ঘরে প্রতিটি যুবক-যুবতী সেই ঘোরে রয়েছেন হয়তো বা। তাঁদের সবারই যে প্রিয় গায়ক কে কে— এমনটা কিন্তু নয়। কিন্তু কে কে এমনই এক গায়ক যার শূন্যতা ভক্ত না হয়েও অনুভব করা যায়, যাবেও চিরকাল। একটা সময়ের কণ্ঠস্বর তিনি, নয়ের দশকে গড়ে ওঠা প্রজন্মের কাছে তো বটেই, আসমুদ্রহিমাচল বহু মানুষের কাছেই কে কে সময়ের চিহ্ন।

 

তখন ঘরে ঘরে ইন্টারনেট ছিল না। থাকার মধ্যে টিভিতে একটু পরের দিকে জুম বা নাইনএক্স বা এমটিভি। তাই হয়তো কে কে-র সঙ্গে পরিচয় একটু দেরিতে। বয়ঃসন্ধি-মাখা কোনও বিকেলে হয়তো বন্ধুর কম্পিউটার থেকে কয়েকটা ভিডিও বা গান সিডিতে রাইট করে অনেকে শুনতে শুরু করেছিলেন তাঁর গান। তখন নেরোর যুগ। রাইট করতে বেশ সময় লাগত। গরম সিডি রাইটার থেকে বের করে ওপরে মার্কার দিয়ে লিখে দেওয়া হতো নাম। 'পল' নামের কোনও সিডি চালিয়ে হয়তো বা দেখা গিয়েছিল, লাল, নীল, সবুজ জামা পরে একটা লোক গান গাইছে। বন্ধুত্বের গান, প্রেমের গান। ‘ইয়ারোঁ, দোস্তি, বড়ি হি হাসিন হ্যায় / ইয়ে না হো তো ক্যায়া ফির বোলো ইয়ে জিন্দেগি হ্যায়'— সমস্ত কৈশোর তার অস্তিত্ব নিয়ে যেন মুচড়ে উঠত। এতখানি সারল্য নিয়ে এত জটিল একটা সময়ের কথা বলা যায়?

 

কেউ একটা বয়সকে যখন বুঝছে না, তখন এই গায়ক যেন বটগাছ। হাওয়াতে জুড়োলো চোখ, তিনি হয়ে গেলেন 'দোস্ত'। প্রেমের নেপথ্যে অমন এক সর্বজ্ঞ গায়কের ভূমিকায় তাঁর সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতে এক মুহূর্ত সময় লাগল না। গান উঠে এল একটা প্রজন্মের মুখে মুখে। এক বিরাট ফাঁকা বাড়ি বুকের ভেতর ছাপিয়ে গেল। শূন্যতার মাঝে সেই বিখ্যাত নীল জ্যাকেট, কেকে গাইছেন, ‘হম রহে ইয়া না রহে কল, কল ইয়াদ আয়েঙ্গে ইয়ে পল’, কলমে বিখ্যাত মেহবুব। একটা ধূসর ফ্রেম থেকে শুরু হয় ভিডিওটা। পাওয়া না-পাওয়ার সেই আবেগ ধীরে ধীরে রঙ ফোটাতে শুরু করে নির্জ্ঞানে, নির্জ্ঞান থেকে ফের টিভির পর্দায়। পছন্দ ছড়ায় গোপনে। চারিয়ে যায় কোশের থেকে কোশে। তখন পাড়ায়-মফস্‌সলে, গ্রামের সিডির দোকানে নকলের যুগ। সোনির আসল ক্যাসেট বা সিডি আসত না তেমন। এক একটা এমপিথ্রি, অমুক স্পেশাল, তমুক হিটস্‌, তাতে দেড়শো-দুশো গান। প্রথম প্রথম কে কে আসত বাকিদের সঙ্গে মিলেমিশে। আর যে বন্ধুদের বয়সে বেশ খানিকটা বড় দাদা বা দিদি থাকত, তাদের কাছ থেকে জোগাড় করা যেত ভিডিও গান।

 

আরও পড়ুন: স্মৃতি উসকে ফিরছে বাঙালির ভরসা অ্যাম্বাসাডর, ঘুম কাড়বে নতুন লুক!

 

এইসব টুকিটাকি আমার-আপনার খুব চেনা। একটা গোটা কৈশোর, যৌবনের অনেক যত্নে তিলে তিলে গড়ে তোলা চাক ভেঙে চলে গিয়েছে কেউ। সেই হাজার ছেঁড়া মুখে মধুর স্মৃতির ক্ষরণ আটকায়, সাধ্য কার। ৩১ মে রাতে কে কে চলে গেলেন। গেলেন রাজকীয়ভাবেই। কিন্তু চিরতরে চলে যাওয়ার ঘটনা মেনে নিতে পারছে না কেউই। আন্তর্জালে বারবার ফুটে উঠছে “সত্যি চলে গেলেন?” এ যেন স্বয়ং গায়ককেই প্রশ্ন করছেন ভক্তরা। অস্বাভাবিক কি? মাত্র ৫৩ বছর বয়স হয়ছিল কে কে-র। কাল রাতেও নজরুল মঞ্চে উল্টোডাঙার গুরুদাস মহবিদ্যালয়ের ফেস্টে লাইভ অনুষ্ঠান করেছেন। গেয়েছেন একের পর এক প্রিয় কৈশোরের গান। সেই কৈশোর অনাহূত বলেই হয়তো এতখানি প্রিয়। অনুষ্ঠানের মঞ্চেই নাকি কে কে একাধিকবার জানিয়েছিলেন যে, অসুস্থ বোধ করছেন। স্পটলাইট অফ করতেও বলেছিলেন। অনুষ্ঠান শেষ করে পৌনে ন'টা নাগাদ ফিরে আসেন হোটেলে। গ্র্যান্ডেই উঠেছিলেন গায়ক। সেখানে অবস্থার আরও অবনতি হওয়ায় তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় ডায়মন্ডহারবার রোডের পাশে একটি বেসরকারি হাসপাতালে। হাসপাতালে তখনই জানানো হয়, অবস্থার বেশ অবনতি হয়েছে। এরপরই তাঁকে 'মৃত' বলে ঘোষণা করে হাসপাতাল। আজ, ১ জুন তাঁর দেহের ময়নাতদন্ত হওয়ার কথা। স্ত্রী এবং পুত্র আজই কলকাতায় আসবেন। প্রশাসনিক প্রধান থেকে প্রবীণ চিকিৎসক, পৌঁছেছেন সবাই। শোক জ্ঞাপন করেছে সমস্ত দেশ।

 

১৯৬৮ সালের ২৩ আগস্ট দিল্লিতে জন্ম কৃষ্ণকুমার কুন্নাথের। কিরোরি মল কলেজ থেকে কমার্সে গ্র্যাজুয়েট। এরপরই প্রথম অ্যালবাম ‘পল’। যদিও ১৯৯৭-এ প্লে-ব্যাক সিঙ্গার হিসেবে সরাসরি এ. আর. রহমানের সঙ্গে কাজ করছেন। গাইছেন ‘কল্লুরি শালে’ এবং ‘হ্যালো ডক্টর’। বলিউডের প্রথম হিন্দি গান ‘তড়প তড়প কে ইস দিল’, সঞ্জয় লীলা বনশালির ‘হাম দিল দে চুকে সনম’ সিনেমা। যদিও এসবের আগে ১৯৯৬-এ ‘মাচিস’-এ গাইছেন ‘ছোড় আয়ে হাম’-এর একটি অংশ। কিন্তু সেটি সোলো গান ছিল না। সেই ভিডিও এখনও ইউটিউবে পাওয়া যায়। গুলজার কাচের এপাশে বসে রয়েছেন। ওপাশে এক নবীন গায়ক গেয়ে চলেছেন মন, প্রাণ- সবটুকু দিয়ে। একের পর এক হিট। সোশ্যাল মিডিয়া ভরে গিয়েছে সেই সব নস্টালজিক গানে। দীর্ঘদিন কে কে-র প্লে-লিস্ট আলাদা জায়গা করে রেখেছে মানুষের মনে। ‘ম্যায় খুদা’ গানটি গাইছেন অনুরাগ কাশ্যপের ‘পাঁচ’ সিনেমায়। যদিও অফিসিয়ালি রিলিজ করেনি সেই গান, কারণ ছবিটিই মুক্তি পায়নি। সেখানে তাঁর গলার রেঞ্জ দেখলে চমকিত হতে হয়। রয়েছে ‘বস এক পল’-এর মতো গান, ‘দিল কিঁউ ইয়ে মেরা’, 'লাইফ ইন এ মেট্রো'-তে ‘ও মেরি জান’, আলভিদা’-র মতো অসংখ্যা হিট গান।

 

সেই দুনিয়ার সবটুকু নিয়ে চলে গেলেন কে কে। ফেসবুক, ট্যুইটার– সমস্ত সামাজিক মাধ্যমে নস্টালজিয়ায় শোক বুনছেন শ্রোতারা। বহুদিনের পরিচয় হঠাৎ থমকে গেলে মাঝের সময়টুকুর বোধ হারিয়ে যায়। মনে হয় এই তো কালকেই দেখা হল সবে! “আভি আভি তো মিলেথে, আভি না করো ছুটনে কি বাত... আভি আভি জিন্দেগি শুরু হ্যায়, আভি আভি থম জানে কি বাত”। হারিয়ে এই না পাওয়ার বোধ মানুষের চিরন্তন। আর সেই বোধ কে কে-র গানে বারবার স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

 

‘দিল ইবাদত কর রাহা হ্যায়, ধড়কনে মেরি শুন'- কাল রাত থেকে চলছে অসংখ্য মানুষের ফোনে, ল্যাপটপে। আবারও বেজে উঠবে ‘ম্যায় তেরি ম্যায় তেরি কদমো পে রাখ দুঁ ইয়ে জহাঁ, মেরি ইস্ক দিওয়ানগি’, বুকটা মোচড় দিয়ে উঠবে প্রত্যেকটি যুবক-যুবতীর। যাঁরা কে কে-র সঙ্গে বেঁচেছেন এক-একখানি জীবন। শুধুমাত্র এই একটি গানের জন্যই ‘জন্নত’ থেকে যায় স্মৃতিতে। এই গান শুনলে ইচ্ছে হয়, যেটুকু আছে, উজার করে দিতে। প্রেম কি কেবল একমাত্রিক? যে গায়ক গাইছেন, তাঁর সঙ্গে কি প্রেমে জড়িয়ে পড়ে না শ্রোতারা? কাল রাত থেকে হাজার হাজার মানুষ কি চাননি একবারও, যাতে মিথ্যে হয় এই খবর, জীবনে ফিরে আসুন তিনি? কিন্তু সবটুকু নিবেদন মৃত্যুর দরজায় ব্যর্থ। তা পেরিয়ে নস্টালজিক জগতে পৌঁছে গিয়েছেন কে কে। আর যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতেও তাঁর গান শুনে যাচ্ছেন শ্রোতারা, একের পর এক। এর থেকে বড় প্রাপ্তি এর কী হতে পারে?

 

চলে যাওয়ার তাঁর বয়স ছিল না। ছিল আরও অনেক কাজের সম্ভাবনা। কিন্তু গিয়েছেন রাজার মতোই। গাইতে গাইতে। লক্ষ লক্ষ মানুষের ব্যক্তিগততম কোণটিতে বেজে চলেছে তাঁর একের পর এক গান। কখনও যে কণ্ঠের সুর থেমে যাবে না। পৃথিবীর কোনও না কোনও এক প্রান্তে কোনও যুবক বা যুবতীর শ্রুতিতে ওই স্বর জীবন্ত হয়ে থাকবে। বুকের অতল থেকে যে স্বর গেয়ে ফেরে, “সোনিয়ে, ও সোনিয়ে, তুঝে দেখতা হুঁ তো শোচতা হুঁ বাস ইয়েহি”। সেই স্বর কখনও আমার, কখনও আপনার একান্ত নিজস্ব। স্পিকার থেকে কানে, কান থেকে মাথার ভেতরে, সেখান থেকে ঠোঁটে, ঠোঁট থেকে ফের স্পিকারে– এই তার চক্রবৎ ঘুরে চলা। প্রতিবার নতুন। বিদায় কে কে। আলভিদা। আলভিদা।

More Articles