করোনার অভিশপ্ত দিনে ফিরে দেখা স্বামীজির সেবাকাজ

দৃশ্য ১

জার্মানির কোলন শহরের একটি সমাধিস্থান। মাঝ বয়সি এক ভদ্রমহিলা অঝোরে কাঁদছেন, মাঝে মাঝে সে কান্নার রোল এমনভাবে উঠছে যে সমাধিস্থানের প্রবেশ দ্বার থেকেও কান্না শোনা যাচ্ছে।

ভদ্রমহিলার একমাত্র সন্তান কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। ছেলেটি যখন পাঁচ বছরের তখন ভদ্রমহিলার সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে যায়। পতিদেবতাটি আবার বিয়ে করলেও মহিলাটি করেননি। ছেলেকে ঘিরেই ছিল তাঁর জীবন, তাঁর স্বপ্ন। আজ সবই ইতিহাস। একটু পরেই শববাহী গাড়ি ছেলেটির নিথর দেহটি নিয়ে আসবে তার অন্তিম সংস্কারের উদ্দেশ্যে। ইতস্তত কয়েকজন ঘুরে বেড়াচ্ছে, ভদ্রমহিলা এদের চেনেন না কিন্তু আন্দাজ করতে পারেন এরা ওর ছেলেকে চিনত।

কালো বড় একটা গাড়িতে মারকুসের নিথর দেহ এসেছে। যারা ঘুরে বেড়াচ্ছিল কোথা থেকে তারা কয়েকটা ফুল নিয়ে এল। তারপর দূর থেকে ফুলগুলোকে ছুঁড়ে দিল কফিনের ওপর। ব্যাস এই পর্যন্তই, আর পিছনে ফিরে তাকাল না। মার কাছে এসে একবারের জন্য দাঁড়ালও না। হনহন করে হেঁটে বেরিয়ে গেল সমাধিস্থলের চৌহদ্দি থেকে।

মা একা দাঁড়িয়ে আছেন। কত কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। মনে পড়ছে এই তো বিশ বছর আগে ছোট্ট সোনাকে নার্সিং হোম থেকে নিয়ে এসেছিলাম। যখন মন উচাটন, কত ঝড়ঝাপটা গেছে তখন ছোট্ট ছেলে মাকে বলত আমিই তো আছি তোমার পাশে।

হুশ ফিরল শববাহী গাড়ির ড্রাইভারের ডাকে, 'আমরা এবার ওকে সমাহিত করব, আপনি মাটি দিন'। সব শেষ হয়ে গেল।

দৃশ্য ২

কলকাতার শিরিডি অঞ্চলের বাসিন্দারা রাস্তা অবরোধ করে ঘোষণা করলেন, আর কোনও কোভিডে মৃত ব্যক্তিকে এই শ্মশানে দাহ করা যাবে না। পুরসভার আধিকারিকরা এলেন, পুলিশের কর্তারা এলেন প্রায় মুচলেকা দিয়ে তুলতে হল অবরোধ। বক্তব্য একটাই কোভিডের মৃতদেহ থেকে রোগ ছড়াবে অতএব সতর্কতা নেওয়া প্রয়োজন। ডাক্তারবাবুরা টেলিভিশনের পর্দায় প্রায় রোজ দেখাচ্ছেন মৃতদেহ থেকে কোভিড ছড়ায় না, আপনারা অযথা ভয় পাবেন না। কিন্তু কে কার কথা শোনে। মৃত্যুভয় বড় দায়। যে আত্মীয় বা বন্ধুর সঙ্গে সাতদিন আগেও কথা হয়েছে তার মৃত্যুতেও তার পরিবারের পাশে দাঁড়ানো গেল না।

জার্মানি বা কলকাতা শুধু নয় সর্বত্রই এক ছবি। একটি অতিমারি শেখাল কোভিডে মারা গিয়ে যেন মৃতেরা চুরির দায়ে ধরা পড়েছেন। কেউ তাদের ছুঁতে চাইল না, সৎকার করতে চাইল না। আর তার ওপর ইংরেজি ভাষায় যুক্ত হল একটি নতুন শব্দ Social distancing। একটি মানুষ যদি আর একটি মানুষের থেকে দূরে চলে যায় সেদিন থেকেই শুরু হয় সভ্যতার সংকট। হওয়া উচিত ছিল Physical distancing – অর্থাৎ আমরা সামাজিক ভাবে নিকটে কিন্তু অতিমারির কারণে শারীরিক ভাবে দূরত্ব রাখছি যাতে রোগটি না ছড়ায়। যেহেতু বিত্তবান দেশগুলো Social distancing বলল, আমরাও তাই বলতে লাগলাম, একবারের জন্যও ভাবলাম না সমাজের কি বিরাট ক্ষতি এই একটি শব্দ করে দিল। অতিমারি তৈরি করল এক ছুৎমার্গীয় দলকে। ছুঁয়ো না, আমায় ছুঁয়ো না। মাথায় ক্যাপ, হাতে গ্লাভস, মুখে মাস্ক – ডাক্তারবাবু রোগী দেখছেন ; ক্লাসে কোনও ছাত্র নেই, মাস্টারমশাই ওয়েবের মাধ্যমে পড়াচ্ছেন। নতুন সভ্যতা যেখানে সব কিছু ঠিকঠাক চলছে, শুধু হৃদয়ের কোনও স্পর্শ নেই। বহু হাউসিং কমপ্লেক্সে বাইরের মানুষের ঢোকা নিষিদ্ধ হল। কিন্তু তাও অতিমারির ঢেউ আটকানো গেল না। আবার তা আছড়ে পড়ল সমাজের ওপর। মাঝের থেকে হারিয়ে গেল মনুষ্যত্ববোধ।

দৃশ্য ৩

১৮৯৯ সালের বাগবাজার অঞ্চল। একটি রোয়াকে বসে আছেন সিস্টার নিবেদিতা সাথে স্বামী শিবানন্দ, স্বামী সদানন্দ ও স্বামী নিত্যানন্দ। নিবেদিতা খুব মন দিয়ে কি যেন লিখছেন। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে। ডঃ রাধাগোবিন্দ কর তার চেম্বার থেকে এই রাস্তা দিয়ে তাঁর বাড়ি যাচ্ছিলেন। নিবেদিতাকে দেখে ডাক্তারবাবু জিজ্ঞেস করলেন আপনার খাওয়া হয়েছে। নিবেদিতা উত্তর দিলেন, 'না, এখনও হয়নি। বেলুড় মঠে একটা রিপোর্ট পাঠিয়েই আমরা গিয়ে মধ্যাহ্নভোজ সারব।' ডঃ কর অবাকই হলেন। কোথায় আয়ারল্যান্ড আর কোথায় কলকাতা। মেমসাহেব ভারতবর্ষকেই তার দেশ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। নিজের জীবনকে বাজি রেখে মানবসেবা, না দেখলে বিশ্বাস করতেন না ডঃ কর।

প্লেগ দেখা দিল উত্তর কলকাতার বাগবাজার এলাকাতে যেখানে মধ্যবিত্তের বাস। সাথে কয়েকটি বস্তিও আছে। যারা ধনী তারা পাড়া ছেড়ে অন্যত্র চলে গেলেন। পড়ে রইলেন দরিদ্র মানুষজন যাদের যাবার কোনও জায়গা নেই। নিবেদিতার সাথে বহু রাজকর্মচারীর বন্ধুত্ব ছিল তারা সিস্টারকে বলল, বোসপাড়া লেন ছেড়ে ধর্মতলার কাছে কোনও বাড়ি ভাড়া করতে কারণ প্লেগ সাহেব পাড়াতে পৌঁছতে পারবে না। নিবেদিতা সবিনয়ে তাদের উপদেশ গ্রহণ করলেন না। এবং উত্তর কলকাতাতে থেকে সেবাকাজের সূচনা করলেন।

স্বামীজি একটি অসাধারণ প্যামফ্লেট লিখলেন স্থানীয় বাসিন্দাদের স্বাস্থ্য সচেতন করার জন্য। ঘর-দোর পরিষ্কার রাখা, বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার রাখা, এগুলো যেমন ছিল তেমনি আবেদন ছিল টিকা গ্রহণের এবং ভয় না পাবার। একদিন স্বামী অখণ্ডানন্দজী হ্যারিসন রোডে প্যামফ্লেট বিলি করতে গিয়ে জনরোষের মুখে পড়লেন। জনতা তাঁর কলার ধরে একটি ঘরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে এই অবস্থাতেও অখণ্ডানন্দজী তাদের বোঝাচ্ছেন প্লেগের টিকা নেওয়া একান্ত জরুরি। জনতার বক্তব্য টিকাকরণের মধ্যে দিয়ে ইংরেজরা ধর্মান্তকরণের চেষ্টা চালাচ্ছে। সেইদিন কোনরকমে প্রাণে বেঁচেছিলেন অখণ্ডানন্দজী। স্বামীজি ওই প্যামফ্লেটে লিখলেন, আমরা গরিব আর গরিবের যন্ত্রণা বুঝতে পারি। যদি হাতে পায়ে কোনও সেবার প্রয়োজন হয় তবে তারা যেন বেলুড় মঠে যোগাযোগ করে, সেবার কোনও অভাব হবে না।

ওদিকে নিবেদিতা সেবাকাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন। বস্তির মধ্যে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চুনকাম করা, যাদের জ্বর হয়েছে তাদের সেবা করা চলতে লাগল। একটি শিশুকে নিবেদিতা খুব ভালোবাসতেন। শিশুটির প্লেগ হল, সিস্টার প্রাণ দিয়ে তার সেবা করতে লাগলেন কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ করে শিশুটি মারা গেল নিবেদিতার কোলে। মারা যাবার আগে সে নিবেদিতাকে মা বলে ডেকে উঠেছিল। মৃত শিশুটির দেহ নিয়ে অঝোরে কেঁদেছিলেন নিবেদিতা। সেবার পাশে চলতে লাগল অবিরাম লেখার কাজ। স্বামীজির লেখা প্যামফ্লেটটির অনুবাদ করলেন নিবেদিতা এবং The Statesman কাগজে চিঠি লিখলেন কলকাতা পুরসভার দৃষ্টি আকর্ষণের উদ্দেশ্যে। কাজ হয়েছিল নিবেদিতার চিঠিতে এবং কলকাতা পুরসভা এগিয়ে এসেছিল উত্তর কলকাতার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে রাস্তাঘাট পরিষ্কার করতে এবং পুরসভার ডাক্তারেরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে রোগী দেখতে শুরু করেছিলেন। ১৮৯৯ এর বর্ষার পর কলকাতার প্লেগ কমে গেল কিন্তু সেবাকাজের ইতিহাসে অনন্য হয়ে রইল স্বামীজি এবং তাঁর গুরুভাইদের নিঃস্বার্থ সেবা।

স্বামীজি বিশ্বাস করতেন, সেবাকাজের মধ্যে দিয়ে একটি মানুষ তার জীবনে পূর্ণতা অর্জন করতে পারে। জীবন আনন্দে ভরা কিন্তু তা উপলব্ধি করতে চাই মানুষের সেবা, মানুষের জীবনের সাথে নিজের জীবনকে মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করে দেওয়া। অতিমারি আমাদের সেই সুযোগ দেয় যাতে আমরা ক্ষুদ্রতার ওপরে উঠে নিজেদের জীবনকে একটি বড় আঙ্গিকে দেখতে পারি।

স্বামীজির চেয়ে একধাপ এগিয়ে স্বামী অখণ্ডানন্দজী যুবকদের ডাক দিয়েছিলেন আর্তের সেবায় নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতে। তাঁর মতে, ‘বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে ভগবান তাঁর বৈধ সন্তানদের চিনে নিতে চান। যারা বৈধ সন্তান তারা ছটফট করে কীভাবে দুর্ভাগ্য তাড়িত, যন্ত্রণাক্লিষ্ট মানুষকে একটু স্বস্তি দেওয়া যায়। আর এই বিপদের দিনেও যারা স্বার্থপরের মতো হাস্যরোলে দিন কাটায় তারা ভগবানের বৈধ সন্তান নয় শয়তানের বাচ্চা’।   

More Articles