তাজমহল- পাষাণে গড়া এক কবিতা

"যেটা অবর্ণনীয় সেটা আমি বর্ণনা করতে যাব না | কোন শব্দ, কোন লেখনীই কোনওমতেই পাঠকের কল্পনাপ্রবণ মনকে তাজমহলের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য্য এবং তার স্রষ্টার পবিত্র কল্পনার সম্মন্ধে সঠিক রূপ দিতে পারবে না |" তাজমহল সম্মন্ধে এমনটাই লিখে গেছেন লর্ড বরাট তাঁর 'Fortyone Years in India' গ্রন্থে |

বিখ্যাত পর্যটক অস্কার ব্রাউনিং তাজমহল দেখার পর তাঁর মুগ্ধতার অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন এই ভাষায় - "তাজমহল ভারত তথা বিশ্বের এক অতুলনীয় সৌধ  তাজ দেখুন  এটি আপনাকে এত মোহিত করবে যে আপনি আপনার অনুভূতি প্রকাশের ভাষা খুঁজে পাবেন না | এবং এই অপ্রকাশিত অনুভূতি মৃত্যুর দিন পর্যন্ত সজীব থাকবে আপনার অন্তরে|"

যাঁর স্মৃতিতে গড়া এই সৌধের চরম উৎকর্ষ নিয়ে পৃথিবীর জ্ঞানী-গুণী মানুষ ও শিল্পরসিকেরা এমন উচ্চসিত ভাবে মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন, তিনি ছিলেন ভারত ইতিহাসের অন্যতম খ্যাতিমান মুঘল সম্রাট শাহজাহানের প্রিয়তমা পত্নী আর্জুমান্দ বানো বেগম, যিনি, মমতাজ মহল নামেই প্রসিদ্ধ ছিলেন | আর্জুমান্দ নিজে অসামান্য স্নিগ্ধ রূপের অধিকারিণী ছিলেন, তাই সম্রাট তাঁর প্রিয়তমা নামকরণ করেছিলেন ঐভাবে | মমতাজের জন্ম হয়েছিল ১৫৯২ সালে, বাবার নাম ছিল আসফ খান | শাহজাহানের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয় ১৬১২ সালে | দুৰ্ভাগ্যবশত, মাত্র ৩৯ বছর বয়সে ১৬৩১ সালে মমতাজ পরলোকগমন করেন দক্ষিণ ভারতের বারহানপুরে | তাঁকে সমাধিস্থ করা হয় তাপ্তী নদীর তীরে জেনাবাদ নামক স্থানে | তবে সেটি ছিল প্রথম সমাধি |

শোনা যায় পরম প্রিয় পত্নীর মৃত্যুতে সম্রাট শাহজাহান শোকে দুঃখে একেবারে ভেঙ্গে পড়েছিলেন | কয়েক মাসের মধ্যেই তার সমস্ত চুল - দাড়ি পেকে সাদা হয়ে গেছিল | তিনি রাজপোশাক পরা এবং রাজদরবারে যাওয়া ত্যাগ করেছিলেন | এইভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর শাহজাহান শোক সামলে নিলেন | পরলোকগতা পত্নীর স্মৃতিকে আঁকড়ে তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং স্ত্রীর করলেন যে একটি অপূর্ব সুন্দর সৌধ নির্মাণ করিয়ে মমতাজ এবং তার স্মৃতিকে চিরস্মরণীয় করে রাখবেন | শান্ত অবিচলতায় সম্রাট ধীরে ধীরে শুরু করলেন সেই সঙ্কল্প রূপানয়নের কাজ | শোকের এমন কাব্যিক প্রকাশ জগতে দুর্লব |

মমতাজের মৃত্যুর ছয়মাস পরে তাঁর মৃতদেহ জেনাবাদ থেকে তুলে এনে পুনরায় আগ্রায় সমাধিস্থ করা হলো জয়পুরের রাজা মানসিংহের বাগানে | শাহজাহান এই কাজ সুষ্ঠভাবে সমাপন করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন যুবরাজ সুজাকে | তারপর সম্রাট সমাধিসৌধ নির্মাণের কাজে অগ্রসর হলেন | তাঁর পরিকল্পনার কথা জানিয়ে আমন্ত্রণ করলেন ভারত তথা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত স্থপতি ও শিল্পীদের | বিভিন্ন স্থপতি স্মৃতিসৌধের বিভিন্ন রূপের পরিকল্পনা অর্থাৎ Civil Engineering Plan -এর প্রস্তাব রাখলেন | কোন স্থপতির প্রস্তাবিত পরিকল্পনা সম্রাটের শিল্প - সৌন্দর্যবোধ, সুরুচি আর ভাবাবেগকে উৎকৃষ্ট রূপদান করতে পারবে, তাই নিয়ে কিছুদিন চলল চুলচেরা বিচার | অবশেষে তুরুস্কের স্থপিত উস্তাদ ঈশা খান ইফেন্দি -র বানানো পরিকল্পনা স্বীকৃত হলো | ঈশা খান নির্মিত সমাধি-সৌধের জন্য প্রস্তাবিত একটি ক্ষুদ্র প্রতিকৃতি দেখে শাহজাহান সন্তুষ্ট হলেন, সবুজ সঙ্কেত দিলেন | তিনি জানালেন যে সৌধটির নাম হবে তাজমহল |

মমতাজের মৃত্যুর একবছর পরে শুরু হল তাজমহল নির্মাণের কাজ | তাজমহল নির্মাণের জন্য ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রধানদের সহযোগিতায় সংগ্রহ করা হয়েছিল নানা প্রকারের মূল্যবান কাঠ, পাথর, সোনা, রূপ ও সৌধ - নির্মাণ সামগ্রী | এই নির্মাণ কাজে নিযুক্ত হয়েছিল আনুমানিক টো হাজার শিল্পী, কারিগর ও শ্রমিক | ঈশা খানের নেতৃত্বে তারা ১২ বছর ৬ মাসের অক্লান্ত পরিশ্রম ও আন্তরিক প্রচেষ্টার বলে সফল হয়েছিল সম্রাট শাহজাহানের স্বপ্নের তাজমহল নির্মাণ করতে | অর্থাৎ মূল স্থাপত্যটি নির্মাণ শেষ হয়েছিল ১৬৪৪ - ১৬৪৫ সালে | পার্শবর্তী অন্যান্য সৌধ, গৃহ তোরণ, প্রবেশদ্বার, উদ্যান, প্রাচীর ইত্যাদি নির্মাণ কাজ নিয়ে সমস্ত কাজ শেষ হতে আরও আট - নয় বছর লেগেছিল |

ইতিহাসবিদরা জানিয়েছেন যে সম্রাট শাহজাহান ছিলেন অত্যন্ত সহানুভূতিসম্পন্ন, রুচিবান ও দয়ালু ব্যক্তি| নির্মাণ কাজে নিযুক্ত ২০ হাজার শিল্পী, কারিগর ও শ্রমিকদের একজনের উপরেও কখনও জোর-জবরদস্তি, দমন-পীড়ন করা হয়নি| কোনও শিল্পী - কারিগর তার প্রাপ্যের চেয়ে কম মজুরি পাননি| শিল্পী-কারিগরদের প্রত্যেকে যাতে সন্তুষ্ট চিত্তে কাজ করতে পারেন তা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা সম্রাট করিয়ে রেখেছিলেন| নির্মাণকাজে মোট কত ব্যয় হয়েছিল তা নিয়ে মতভেদ আছে| কোনও কোনও ইতিহাসবিদের মতে এই কাজে সর্বমোট ব্যয় হয়েছিল প্রায় চার কোটি টাকা| সম্রাট শাহজাহান তাজমহলকে এমন অবস্থান রেখে বানিয়েছিলেন, যাতে তিনি আগ্রা দুর্গ থেকে গবাক্ষ পথে যখন খুশী তাজমহলের দর্শন পেতে পারেন|

মমতাজের সমাধি ক্ষেত্রের উপরে তাজমহলের যে মূল সৌধ সেটি সম্পূর্ণ শ্বেত মার্বেল পাথরে নির্মিত | তার শান্ত স্নিগ্ধ অতুলনীয় রূপ যে কোনও দর্শককে বিমুগ্ধ করে| দেখে মনে হয় যেন শ্বেতপাথরে রচিত এক কবিতা | বস্তুতঃ তাজমহল হলো পৃথিবীর এক অত্যাশ্চর্য্য শিল্পসৃষ্টি| ভারতীয় স্থাপত্যরীতি এবং পারসিক স্থাপত্য কৌশলের এক সুসম্বদ্ধ শৈল্পিক রূপ প্রকাশ পেয়েছে এই সৌধে| সমগ্র মোঘল সম্রাজ্যের অধীশ্বর হওয়া সত্ত্বেও শাহজাহান তাঁর প্রিয়তমা বাঁচিয়ে রাখতে পারেননি ঠিকই, তবে তাঁর প্রেমকে স্বরণীয় করে রাখতে পেরেছেন সৌন্দর্য্য সূক্ষ্ম শিল্পকলা আর অসাধারণত্বের এই নিদর্শন সৃষ্টি করে | সম্রাট শাহজাহানের সুরুচি এবং উন্নত শিল্পভাবনার সার্থক প্রকাশ হয়েছে তাজমহল|

মমতাজ ছাড়া আর যাঁরা শাহজাহানের উদার ভালবাসায় ধন্য হয়েছিলেন, তাঁদের সমাধিও আছে এই সৌধ চত্বরে | তাজমহলের প্রধান প্রবেশ দ্বার, যেটি পশ্চিম দিকে অবস্থিত, সেই দ্বারের বাইরে লাল বেলে পাথরে নির্মিত হয়েছে ফতেপুরী মসজিদ | ফতেপুরী বেগম ছিলেন শাহজাহানের অন্যতম পত্নী তাঁর স্মৃতিরক্ষার্থে সম্রাট এটি নির্মাণ করান| প্রধান প্রবেশদ্বারের বাঁদিকে রয়েছে শ্বেত পাথরে নির্মিত সতুলন্নিসার খাদানের সমাধি| খাদান ছিলেন নিঃসন্তান | তবে তিনি মমতাজ বেগম এবং সম্রাট কন্যা জাহান-আরা বেগমের অত্যন্ত প্রিয় সঙ্গিনী ছিলেন| ১৬৪৭ সালে সতুলন্নিসার জীবনবাসনা হয় লাহোরে| সেখানে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়| কিন্তু ১৬৪৯ সালে শাহজাহান তাঁর মরদেহ লাহোর থেকে আগ্রায় এনে তাজমহল চত্বরে পুনরায় সমাধিস্থ করান| 

পশ্চিমের প্রধান প্রবেশদ্বার ছাড়া পূর্বে ও দক্ষিণে রয়েছে আরও দুটি প্রবেশদ্বার| পূর্বদ্বারের কাছে আছে শাহজাহানের আর এক পত্নী শিরহিদ্দি বেগমের সমাধি | দক্ষিণ দ্বারের ডান পাশে আছে লাল বেলে পাথরে নির্মিত মমতাজের আর এক প্রিয়সঙ্গিনীর সমাধি|

তাজমহলের উপরে ওঠার সিঁড়ি রয়েছে দু'পাশে| সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসতে হয় বিশাল সৌধ চত্বরে| তার চারকোণে দাঁড়িয়ে আছে ১৪০ ফুট উঁচু চারটি গোলাকার মিনার | সম্পূর্ণ কোরানটাই উৎকীর্ণ রয়েছে তাজের দেওয়ালে| তাজের গায়ে রয়েছে অতুলনীয় রঙ্গীন পাথরের কারুকার্য, যাতে ব্যবহৃত হয়েছে দেশ-বিদেশের ৩৫ রকমের মূল্যবান পাথর|

তাজমহলের ভিতরে মধ্যিখানে রয়েছে মমতাজের সমাধি ক্ষেত্র| সমাধি ক্ষেত্রের শান্তিরক্ষার জন্য নীচের মূল সমাধিক্ষেত্রের উপরের তলায় রয়েছে অনুরূপ একটি সমাধি | শাহজাহানের মৃত্যুর পর প্রিয়তমা পত্নীর সমাধির পাশেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয় |

শুধু সৌধ নয়, তাজ চত্বরে রয়েছে সুবিস্তৃত সাজানো বাগান | মোঘল বাদশাদের রুচিই ছিল আলাদা | তাঁরাযেখানেই কোন সৌধ নির্মাণ করেছিলেন সেখানেই সামনে বানিয়েছিলেন সুন্দর বাগান | বাগানের মধ্যে ঝর্ণা এত অবিরাম জলের ধারার ব্যবস্থা করেছিলেন তাঁরা | তাজের পিছনে যমুনা নদী আর সামনের সাজানো বাগান পূর্ণিমার চাঁদনী রাতে তাজের আল মায়াময় রূপ সৃষ্টি করে |

তথ্যসূত্র:

https://www.google.co.in/url?sa=i&url=https%3A%2F%2Fwww.history.com%2Ftopics%2Findia%2Ftaj-mahal&psig=AOvVaw2XDgFqhwIzC uUyAapYEG&ust=1631983127542000&source=images&cd=vfe&ved=0CAgQjRxqFwoTCPjdu6W7hvMCFQAAAAAdAAAAABAD

 

More Articles