১৮ বছর ধরে বাস বিমানবন্দরেই! বাস্তবের 'টার্মিনাল' ম্যানের মৃত্যু অবাক করছে বিশ্বকে

The Terminal Man: ২০০৬ সালের দিকে নাসেরি খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তখন তাঁকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। দীর্ঘ ১৮ বছরে সেই প্রথম নাসেরি এয়ারপোর্টের বাইরের জীবনে পা রাখেন।

‘দ্য টার্মিনাল’। হলিউড সিনেপ্রেমীদের কাছে নামটি নিশ্চয়ই চেনা চেনা ঠেকছে? ঠিকই ধরেছেন, ২০০৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত স্টিভেন স্পিলবার্গ পরিচালিত আমেরিকান কমেডি-ড্রামার কথাই বলছি, যেখানে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন শক্তিশালী অভিনেতা টম হ্যাঙ্কস। এই সিনেমার কাহিনি আবর্তিত হয়েছিল এক ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে, যিনি নিউইয়র্কের জন এফ কেনেডি এয়ারপোর্টে আটকা পড়ে যান, কারণ তাঁকে কিছুতেই যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশাধিকার দেওয়া হচ্ছিল না। আর সামরিক অভ্যুত্থান চলতে থাকায় তিনি তাঁর নিজের দেশেও ফিরে যেতে পারছিলেন না। যারা ভেবেছিলেন এ সিনেমার কাহিনি নিছকই লেখক-পরিচালকের মস্তিষ্কপ্রসূত এবং কাল্পনিক, তাঁরা একদমই ঠিক ভাবেননি। এই ছবি নির্মিত হয়েছিল একটি সত্য ঘটনাকে কেন্দ্র করেই। আর টম হ্যাঙ্কস যেই চরিত্রটিতে অভিনয় করেছিলেন, সেই চরিত্রটি সরাসরি অনুপ্রাণিত মেহরান করিমী নাসেরি নামের এক ইরানি ব্যক্তির দ্বারা। তাঁকে টার্মিনাল ম্যান নামেই ডাকা হয়। বিমানবন্দরেই শেষ নিঃশ্বাসও ত্যাগ করেছেন এই অবাক করা মানুষটি।

নাসেরির জন্ম ১৯৪২ সালে, ইরানের সুলেমানে। ১৯৭৩ সালে তিনি যুগোস্লাভ স্টাডিজ বিষয়ে পড়াশোনার জন্য ইউনিভার্সিটি অফ ব্র্যাডফোর্ডে ভর্তি হন এবং তিন বছর যুক্তরাজ্যে বাস করেন। পড়াশোনা শেষে ফের নিজের দেশ ইরানে ফিরে আসেন। সেই সময় ইরানে শাহদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চলছিল। নাসেরিও সেই আন্দোলনে যোগদান করেন। এর ফলে ইরান সরকার তাঁকে নির্বাসন দণ্ড দেয়। অগত্যা দেশচ্যুত হয়ে তিনি বেশ কিছু অন্য দেশে আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেন। অধিকাংশ দেশের সরকারই তাঁকে প্রত্যাখ্যাত করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি বেলজিয়ামের ‘ইউনাইটেড নেশনস হাই কমিশনার ফর রিফিউজিস’-এর শরণার্থীর মর্যাদা লাভ করেন এবং বেশ কিছু ইউরোপীয় রাষ্ট্রে বসবাসের যোগ্যতা অর্জন করেন। যুক্তরাজ্যে বসবাসের জন্য মনস্থির করে ১৯৮৮ সালে লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন নাসেরি।

কিন্তু প্লেন থেকে নেমে বিমাবন্দরে যাওয়ার পথে তিনি তাঁর কাগজপত্র হারিয়ে ফেলেন, সঙ্গে থাকা একমাত্র ব্রিফকেসটিও চুরি হয়ে যায়। কিন্তু সেই দাবির সপক্ষে জোরালো কোনও তথ্য প্রমাণ দিতে তিনি ব্যর্থ হন। অগত্যা পুলিশের হাতে তিনি গ্রেপ্তার হন। যদিও তিনি বৈধভাবেই সেদেশে প্রবেশ করেছিলেন কিন্তু তারপর কোনও বৈধ কাগজপত্র তাঁর কাছে ছিল না, নিজের দেশে ফিরে যাবারও কোনও রাস্তা খোলা ছিল না। তাই তাঁর থাকার মতো স্রেফ একটি জায়গাই অবশিষ্ট রইল। সেটি হল টার্মিনাল-১ এর ডিপার্চার লাউঞ্জ! ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ফরাসি আদালত এই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে খুবই একরোখা অবস্থান বজায় রাখে। নাসেরিকে এয়ারপোর্ট থেকে বিতাড়িত করা যাবে না, কেননা তিনি সেখানে বৈধভাবেই প্রবেশ করেছিলেন। আবার তাঁকে ফ্রান্সের অভ্যন্তরেও প্রবেশ করতে দেওয়া যাবে না কারণ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তাঁর কাছে নেই।

আরও পড়ুন- ধ্বংসস্তূপ হয়ে যাওয়া দেশ আজ উন্নতির চূড়ায়! কীভাবে ঘুরে দাঁড়াল দক্ষিণ কোরিয়া

এরই মাঝে, ফরাসি মানবাধিকার বিষয়ক আইনজীবী ক্রিস্টিয়ান ব্যুরগেট নাসেরির ব্রিফকেসটি খুঁজে পান এবং সেটি নাসেরির কাছে হস্তান্তর করেন। কিন্তু তাঁর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সেখানে ছিল না। নাসেরি কয়েকবার চেষ্টাও চালিয়েছিলেন বেলজিয়ামে গিয়ে কাগজপত্র নিয়ে আসার। কিন্তু তার জন্য নাসেরিকে সশরীরে বেলজিয়ামে হাজিরা দিতে হত। তা নাসেরির পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাছাড়া বেলজিয়ামের শরণার্থী আইন অনুযায়ী, কোনও শরণার্থী যদি একবার স্বেচ্ছায় সে দেশ ত্যাগ করে, তবে পুনরায় সে আর ফিরে আসতে পারবে না। কিন্তু কেবলমাত্র নাসেরির জন্য বেলজিয়ান আধিকারিকরা ১৯৯৫ সালে সে আইনে রদবদল করেন, যাতে তাঁরা নাসেরিকে তাঁদের দেশে ফিরে আসার অনুমতি দিতে পারেন। তবে পাশাপাশি তাঁরা একটি শর্তও জুড়ে দেন। নাসেরি তখনই বেলজিয়ামে ফিরে আসতে পারবেন যদি তিনি একজন সমাজকর্মীর তত্ত্বাবধানে স্থায়ীভাবে সেখানে বাস করতে শুরু করেন। নাসেরির এই প্রস্তাব মনঃপূত হয়নি। কারণ তখনও তিনি নিজের জীবনের ব্যাপারে প্রচণ্ড রকমের উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। তিনি তখনও স্বপ্ন দেখতেন একদিন সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে, আর তিনি স্বাধীনভাবে যুক্তরাজ্যে ফিরে নিজের নতুন জীবন শুরু করতে পারবেন। সেজন্য তিনি ফ্রান্সের এয়ারপোর্টে থেকে যাওয়াকেই উপযুক্ত সিদ্ধান্ত বলে মনে করেন।

এয়ারপোর্ট থাকাকালীন কিন্তু নাসেরি সময় নষ্ট করেননি। তিনি প্রতিদিন টার্মিনালের দরজার পাশে নিজের লাগেজ নিয়ে বসে থাকতেন এবং সময় কাটাতেন বই কিংবা সংবাদপত্র পড়ে। অর্থনীতি বিষয়ে পড়াশোনা করে, ডায়েরি লিখে বা এয়ারপোর্টের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়েই সময় গড়িয়ে যেত। এই বন্ধুরাই তাঁকে খাবারাদাবার দিয়ে যেতেন। সব মিলিয়ে নাসেরি ছিলেন খোশ মেজাজেই।

২০০৬ সালের দিকে নাসেরি খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তখন তাঁকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। দীর্ঘ ১৮ বছরে সেই প্রথম নাসেরি এয়ারপোর্টের বাইরের জীবনে পা রাখেন। এরপর ২০০৭ সালে তিনি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলে ফরাসি রেডক্রস তাঁর দেখভালের দায়িত্ব নেয়। কয়েক মাস পর তাঁকে প্যারিসের একটি দাতব্য কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। ২০০৮ সাল থেকে নাসেরি প্যারিসেই একটি আশ্রয়কেন্দ্রে বসবাস করে আসছেন।

আরও পড়ুন- ক্রাইম থ্রিলারে ‘অনুপ্রাণিত’ হয়েই প্রেমিকাকে ৩৫ টুকরো! কী আছে এই ওয়েব সিরিজে

ফরাসি মানবাধিকার আইনজীবী এবং নাসেরি

ক্রিশ্চিয়ান বোরগেট নামে একজন ফরাসি মানবাধিকার আইনজীবী নাসেরির মামলা স্থানীয় আদালতে নিয়ে যান। ১৯৯২ সালে একটি ফরাসি আদালত রায় দেয় যে তিনি বৈধভাবে ফ্রান্সে প্রবেশ করেছেন এবং সেই কারণে তাঁকে প্রত্যাখ্যান করা যাবে না। যাইহোক, আদালত নাসেরিকে ফ্রান্সে প্রবেশের অনুমতি দেয়নি হয় কাগজপত্রের অভাবে অথবা দেশে প্রবেশের বৈধ কারণ না থাকায়। এরপরে তাঁর আইনজীবী বেলজিয়াম থেকে জারি করা ভ্রমণ নথি পাওয়ার চেষ্টা করেন। তবে এর জন্য, নাসেরিকে ব্রাসেলসে ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত থাকতে হত। তাঁর আইনজীবী ১৯৯৫ সালে একজন সমাজকর্মীর তত্ত্বাবধানে বেলজিয়ামে নাসেরির বসবাসের অনুমতি পেতে সক্ষম হন। তবে, তিনি ব্রিটেনে থাকতে চেয়েছিলেন। অন্য কোনও দেশে না থাকতে চাওয়ায় তিনি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। পরবর্তী সময়ে ফ্রান্স নাসেরিকে থাকতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় কিন্তু তিনি এই প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি জানান, তাঁর দেশ হিসাবে ইরানের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে কিন্তু তিনি ব্রিটিশ হতে চেয়েছিলেন এবং ‘স্যার আলফ্রেড’ নামে পরিচিত হতে চেয়েছিলেন।

বিমানবন্দরে ১৮ বছর

বিমানবন্দরে তাঁর ১৮ বছরের জীবনকালে, নাসেরি বিমানবন্দরের কর্মীদের দেওয়া খাবার এবং জামা কাপড় পরেই বেঁচেছিলেন। নাসেরির এই অসাধারণ জীবনকাহিনি জানতে পেরে ড্রিমওয়ার্কস নামক প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং তাঁর জীবন অবলম্বনে সিনেমা নির্মাণের অনুমতি নেয়। তাঁদের কাছে নিজের জীবনকাহিনির স্বত্ত্ব নাসেরি বিক্রি করেন আড়াই লক্ষ মার্কিন ডলারের বিনিময়ে! পরবর্তীতে এই কাহিনি অবলম্বনেই স্পিলবার্গ পরিচালনা করেন ‘দ্য টার্মিনাল’ ছবিটি এবং ২০০৪ সালে তা বিশ্বব্যাপী মুক্তি পায়। ‘দ্য টার্মিনাল’ সিনেমা থেকে সালে পাওয়া ২ লাখ ৫০ হাজার ডলার পুঁজি নিয়ে একটি হোটেলে থাকতেন তিনি। চার সপ্তাহ আগে আবারও বিমানবন্দরে ফিরে আসেন তিনি, যেখানে তার ১৮টি বছর কেটেছে। সম্প্রতি ১২ নভেম্বর ২০২২, প্যারিসের সেই বিমানবন্দরেই নাসেরি তাঁর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।

 

More Articles