নেহরুর নয়, ভিন্ন পথে হেঁটেই দলের গভীর সংকট ডেকে এনেছিলেন প্রিয়দর্শিনী
সাক্ষর সেনগুপ্ত: পরপর দুটি লোকসভা নির্বাচনে দুই অঙ্কের আসন পেয়েছে স্বাধীনতার পর থেকে সাত দশক দেশ চালিয়ে আসা কংগ্রেস। আপাতত তারা অস্তিত্বের সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে। কিন্তু দল হিসাবে কংগ্রেসের অভ্যন্তরীন সংকটের জেরে বারবার সমস্যার মুখে পড়েছে দলের সংগঠন। আর এই প্রত্যেকটি সংকটের কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেছে নেহরু-গান্ধী পরিবার। অবশ্য বিশিষ্ট রাজনৈতিক সংবাদদাতা মিহির গঙ্গোপাধ্যায়ের মত ব্যক্তিত্বরা মনে করেন দলের ভিতরের মতবিরোধের বিষয়ে জওহরলাল নেহরু এবং ইন্দিরা গান্ধীর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। মতপার্থক্য হলে নেহরুও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কিন্তু কখনই দলটাকেই ভেঙে দেওয়ার পথে হাঁটেননি। গিরি বনাম রেড্ডির রাষ্ট্রপতি পদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবহে যে চরম পদক্ষেপ নিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী।
দেশের স্বাধীনতা ও মহাত্মা গান্ধীর হত্যার পরে কংগ্রেসে নানা দফায় গভীর সংকট তৈরি হয়েছিল। নিজের রাজনৈতিক নীতি ও আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করতে বা আরও ভালভাবে বোঝাতে দলের মধ্যে নিজের জায়গা অটুট রাখতে জওহরলাল নেহরুকে লড়তে হয়েছিল পুরুষোত্তম দাস ট্যান্ডন, কে এম মুন্সি এবং নারহার বিষ্ণু গ্যাডগিলের মত কংগ্রেস নেতাদের বিরুদ্ধে। অবস্থা এতই ঘোরালো হয়ে উঠেছিল যে ১৯৫০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ট্যান্ডন ঘোষণা করেছিলেন তিনি কংগ্রেস সভাপতি পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। স্বাধীন ভারতে এই পদের জন্য সেই ছিল প্রথম প্রকাশ্য নির্বাচন। অন্য় প্রতিদ্বন্দ্বীরা ছিলেন জেবি কৃপালনি এবং শঙ্কররাও দেও। ট্যান্ডন কৃপালনির চেয়ে ১০০০-এর বেশি ভোট পান। এ ঘটনায় নেহরু এতটাই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন যে তিনি ট্য়ান্ডনের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য হতে অস্বীকার করেন।
ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের মৃত্যুর পর ফের একবার সামনে আসে মতবিরোধ। সে সময়ে ওয়ার্কিং কমিটিতে রফি আহমেদ কিদওয়াইকে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে নেহরুর ইচ্ছার বিরুদ্ধে দাঁড়ান দলের শীর্ষ নেতৃত্বের একটা অংশ। কিদওয়াই কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করেন এবং কৃপালনির সঙ্গে হাত মেলান। কৃপালনি তার আগেই কিষাণ মজদুর পার্টি গঠন করে ফেলেছেন। ১৯৫১ সালের জুলাই মাসে যখন নেহরু কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন তখন ফের সংকট তৈরি হয়। সাধারণ নির্বাচনের এক বছর বাকি থাকতে ট্যান্ডন শেষপর্যন্ত পদত্যাগ করেন এবং অক্টোবর মাসে দিল্লিতে এআইসিসি-র অধিবেশনে কংগ্রেস সভাপতি পদে নির্বাচিত হন নেহরু। এভাবেই ১৯৫০ সাল থেকে ১৯৬৭সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি পদে কংগ্রেস প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে একবার ছাড়া প্রত্যেক বার পার্লামেন্টারি বোর্ডে ভোটাভুটির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জওহরলালের প্রার্থী সংখ্যাগুরুর সমর্থন পাননি। কিন্তু এতদসত্ত্বেও তিনি দল দুটুকরো করার কথা ভাবেননি।
পরের দফায় আরও বড় সংকটের মুখে পড়ে কংগ্রেস। এবার সংকট ছিল অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বিষয়ক। মোহন কুমারমঙ্গলম এবং পি এন হাসকারের তৈরি করা অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ব্যাঙ্ক ও ভারী শিল্প জাতীয়করণের দিকে ঝোঁকেন। উল্টোদিকে মোরারজি দেশাই ছিলেন মিশ্র অর্থনৈতিক মডেলের পক্ষে, যে মডেল নেহরুর সময়ে পার্টির অভ্যন্তরে সমাজবাদী ও পুঁজিবাদী ধারার মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বজায় ছিল। ১৯৬৯ সালের জুলাই মাসে এআইসিসির অধিবেশনে দলের অর্থনৈতিক নীতি ও কর্মসূচি বিষয়ক একটি নোট বিতরণ করা হয়। ওই নোটে দৃষ্টিভঙ্গির বদলের অর্থাৎ নতুন অর্থনৈতিক দর্শনের রূপরেখা আলোচনা করা হয়। -এই পদক্ষেপের তীব্র প্রতিক্রিয়া এসেছিল মোরারজি দেশাইয়ের কাছ থেকে, যার পরিণতিতে শেষ পর্যন্ত ইন্দিরা বনাম সিন্ডিকেটের দ্বন্দ্ব চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়।
এই পরিস্থিতির মধ্যে ষাটের দশকের শেষে এল রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। দলের তরফে কংগ্রেস সভাপতি পদে নীলম সঞ্জীব রেড্ডির নাম ঘোষণা করা হয়। ইন্দিরা, কবি যার নাম রেখেছিলেন প্রিয়দর্শিনী মনে করেন এর ফলে তাঁর কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করা হল। তিনি সে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে ভিভি গিরির প্রতি সমর্থন জানান। ওই সিদ্ধান্ত জেনেই কংগ্রেস সভাপতি এস নিজলিঙ্গাপ্পা প্রবল আপত্তি তোলেন। আর ইন্দিরা তাঁকে পদ থেকে সরাতে চান। অবশ্য নির্বাচনে গিরির সঙ্গে রেড্ডি প্রায় সমানে সমানে টক্কর দিয়ে ইন্দিরাকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন । রেড্ডির থেকে মাত্র ১( +) শতাংশ ভোট বেশি পেয়ে গিরি রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রবেশ করেছিলেন।
কিভাবে হয় এই নির্বাচন? রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেন না। তাদের হয়ে বিধায়ক এবং সাংসদরা ভোট দেন। ভোটপত্রে পছন্দের প্রার্থীদের ঘরে 1, 2, 3 এইভাবে পছন্দ অনুযায়ী সংখ্যা বসিয়ে ভোট দেওয়া যায় । যতজন প্রার্থী থাকেন ততগুলি ভোট দেওয়া চলে। ভোটপত্রে সংখ্যার বদলে × টিক বসালে ভোট বাতিল হয়ে যায় । যে প্রার্থী সব চেয়ে বেশি ভোট পান তিনি জিতে যান তা নয়। যিনি ৫০✝︎১ =৫১% ভোট পান তিনি জয়ী হন। প্রথম গণনায় কোন প্রার্থী ৫১ শতাংশ ভোট না পেলে জয়- পরাজয় নির্দ্ধারিত হয় না। তার জন্য দ্বিতীয় গণনা দরকার হয়। দ্বিতীয় গণনা প্রথম ও দ্বিতীয় প্রার্থীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে । বাকি প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে ছিটকে যান। তৃতীয় প্রার্থীর ভোটগুলি প্রথম ও দ্বিতীয় প্রার্থীর মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। তাতে কেউ ৫১ শতাংশ পেলেই তিনি জিতে যান। এই পদ্ধতিকে একক হস্তান্তরযোগ্য পছন্দসূচক ভোট ( Single transferable preferential vote ) বলা হয়।
দলের মনোনীত প্রার্থী পরাজিত হয়েছে। অথচ কংগ্রেস তখনও কেন্দ্রে তো বটেই অধিকাংশ রাজ্যেও ক্ষমতাসীন। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে বৈঠকে বসতেই হত কংগ্রেস নেতৃত্বকে। ১৯৬৯ সালের ২৫ আগস্ট তারিখে ৭ নম্বর যন্তর মন্তর রোডে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির কার্যালয়ের বৈঠকে কিন্তু ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে কোনও চরম ব্যবস্থার সিদ্ধান্ত নেননি অতুল্য ঘোষ-কামরাজ- নিজলিঙ্গাপ্পারা। সেদিনের বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চ্যবন। কিন্তু তাতেও সমস্যা মিটল না। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সমান্তরাল ভাবে ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, একটি কংগ্রেস সদর দফতের, অন্যটি প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে। কয়েকদিন পর কংগ্রেস সভাপতি নিজলিঙ্গাপ্পা ওয়র্কিং কমিটির সিদ্ধান্ত মেনে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে কংগ্রেস থেকে বহিষ্কার করেন। দল ভেঙে য়ায়।
ইন্দিরা অবশেষে গাই-বাছুরের নতুন প্রতীক নেন। ডিসেম্বর মাসে দু পক্ষই আলাদা আলাদা ভাবে এআইসিসির অধিবেশন আয়োজন করে। ২৮ ও ২৯ ডিসেম্বর বম্বে অধিবেশনে ইন্দিরা কংগ্রেস জগজীবন রামকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করে। সিন্ডিকেটের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস (ও) ইন্দিরা সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনে কিন্তু সে প্রস্তাব পরাজিত হয়। ১৯৭১ সালে নির্বাচনে ইন্দিরা কংগ্রেস দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতা দখল করেন। কিন্তু ভাঙনের সেই ক্ষত দশকের পর দশকে আরও গভীর অসুখে পরিণত হয়েছে, যার ফল আজকের পরিস্থিতি, মনে করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক পার্থ রায়চৌধুরীর মত বি্শেষজ্ঞরা।
তথ্যসূত্র - ইন্দিরা একাদশী -বরুণ সেনগুপ্ত, রাজনীতির পথ - মিহির গঙ্গোপাধ্যায়
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য প্রতিবেদকের নেওয়া