লিখেছিলেন বাংলা এনসাইক্লোপিডিয়া, বিস্মৃতির অতলে এই কৃতী বাঙালি

উত্তর কলকাতার বাগবাজার। সময় যেন হঠাৎ করেই থমকে দাঁড়িয়েছে এখানে। বাগবাজারের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে এখনও টের পাওয়া যায় বনেদি কলকাতার গন্ধ,  বাগবাজারের প্রতিটি অলিগলি ঐতিহ্যের কথাই বলে সর্বক্ষণ। তবে বাগবাজারের আদি বাসিন্দারাও হয়তো মনে রাখেননি নগেন্দ্রনাথ বসুর নাম, যিনি সবার অন্তরালেই একপ্রকার বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছিলেন বাংলা সাহিত্যের জগতে। তাঁর বাসস্থানও অবহেলায় পড়ে থাকে এখন।

১৮৬৬ সালের ৬ জুলাই। সেদিন সকাল থেকে আকাশের মুখ ভার। একনাগাড়ে কেঁদে কেঁদেও ক্লান্ত হয় না সে। গঙ্গার পাড়ের গাছগুলো বারংবার মাথা ঝুঁকিয়ে প্রকৃতিকে কুর্নিশ করেও রেহাই পাচ্ছে না। এমনই এক বর্ষণমুখর দিনে বাগবাজারের কাঁটাপুকুর বাই লেন নামক এক গলিতে জন্ম নগেন্দ্রনাথ বসুর, যে গলির নাম এখন বিশ্বকোষ লেন, নগেন্দ্রনাথ বসুর কীর্তির নামানুসারে। নগেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য, একই সঙ্গে ঐতিহাসিকও। ১৯১৯ সাল নাগাদ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত হল নগেন্দ্রনাথ বসুর নাম। তাঁর আবিষ্কৃত বেশ কিছু তথ্যের ওপর ভিত্তি করে শুরু হলো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ।

নগেন্দ্রনাথ বসুর হাতে খড়ি হয় 'ভারত' এবং 'তপস্বিনী' পত্রিকা সম্পাদনার মধ্য দিয়ে। এমনকী, পরবর্তীকালে 'শব্দকল্পদ্রুম' নামক একটি পত্রিকার সম্পাদনাও করেছিলেন তিনি। সময় থেমে থাকে না, সালটা ১৮৮৮। বাগবাজারের গলির সেই ছোট্ট ছেলেটা ততদিনে করে ফেলেছে অসাধ্যসাধন। তার হাত ধরেই আত্মপ্রকাশ করে  'বাংলা এনসাইক্লোপিডিয়া' বা বিশ্বকোষ।

আরও পড়ুন: মৃত্যুপথযাত্রী ট্রাম, ১৪৯ বছর বাঙালির ওঠাপড়া ভাঙাগড়ার সাক্ষী যে যান

১৮৮৭ সাল নাগাদ রঙ্গলাল মুখোপাধ্যায় এবং ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের প্রচেষ্টায় প্রকাশিত হয় ‘বিশ্বকোষ’। ১৮৮৮ সালে এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন নগেন্দ্রনাথ বসু। দীর্ঘ বাইশ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে সংকলিত বাইশটি খণ্ড প্রকাশিত হল ১৯১১ সালে।মোহনবাগান শিল্ড জিতে যখন আওয়াজ তুলেছে, 'ইংরেজ ভারত ছাড়ো', প্রায় একই সময়ে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে নিঃশব্দে বিপ্লব ঘটালেন উত্তর কলকাতার বাগবাজারের নগেন্দ্রনাথ বসু।

১৯৩৩ সালে নগেন্দ্রনাথ বসু আবার শুরু করলেন বিশ্বকোষের পরবর্তী সংস্করণের কাজ। যদিও ১৯৩৮ সাল নাগাদ তাঁর মৃত্যু ঘটলে সেই কাজ অসমাপ্তই থেকে যায়।

না এই কাজের স্বীকৃতি সেভাবে কোনওদিন জোটেনি নগেন্দ্রনাথ বসুর। আত্মবিস্মৃতি রোগে আক্রান্ত বাঙালি নগেন্দ্রনাথ বসুকে ভুলেছে অনেককাল আগেই। নগেন্দ্রনাথ বসুর কল্যাণেই কাঁটাপুকুর বাই লেনের নাম হয় 'বিশ্বকোষ লেন' এবং একই সঙ্গে ইতিহাসের সরণিতে পা রাখেন নগেন্দ্রনাথ বসু, সম্ভবত কোনও বইয়ের নাম অনুযায়ী এই প্রথম কোনও রাস্তার নামকরণ হল। অথচ, ‘প্রাচ্য মহাবিদ্যার্ণব ' এখন বিস্মৃতির অন্তরালে। নগেন্দ্রনাথ বসুর নামফলক এখনও রয়েছে তাঁর বাড়িতে। কিন্তু পথচলতি মানুষের হয়তো চোখেও পড়ে না তা। সেই বাড়ির এখন জীর্ণদশা, সংরক্ষণের কোনও প্রয়াসও নেই এই বাড়িকে ঘিরে। এক স্থানীয় বাসিন্দার কথায়, বিশ্বকোষ লেন নামটা অনেকে জানলেও, এই নামের উৎস সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয় প্রায় কেউই। এভাবেই নিজ এলাকাতেই বিস্মৃত হয়ে রয়েছেন নগেন্দ্রনাথ।

তথ্যসূত্র: কলকাতার সাতকাহন, আনন্দবাজার পত্রিকা

More Articles