কলকাতার এক নম্বর হানাবাড়ি! আঁধার নামতেই কী ঘটত গার্স্টিন প্লেসের এই বাড়িতে?

ইডেন গার্ডেনের পাশেই ছিমছাম দোতলা বাড়ি। মাথার উপর পেল্লায় সব অ্যান্টেনা। দাঁড়িয়ে আছে অল ইন্ডিয়া রেডিওর আপিস, বাঙালির দিন গুজরানের ইতিহাসকে বুকে করে। রেডিও কে না শোনে? বাসে, ট্রামে, হাটে বাজারে অনর্গল ধারাবিবরণী। ১৯২৭ এর ২৬ অগাস্ট ১ নং গার্স্টিন প্লেসে প্রতিষ্ঠিত হলো ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি, বা আইবিসির মূল কর্মকেন্দ্র। প্রথম পরিচালক সি সি ওয়ালিক নামক এক সাহেব এবং প্রযোজনার দায়িত্ব পেলে মহামতী নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদার। কালে কালে এ ইমারত হয়ে উঠলো নামীদামি ব্যক্তিত্বদের তীর্থক্ষেত্র। নৃপেনবাবুর সহকারী হিসেবে নির্বাচিত হলেন প্রখ্যাত সংগীতকার রাইচাঁদ বড়াল, এছাড়াও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর নেতৃত্বে চলতে লাগল দ্বিপ্রাহরিক 'বীরুপাক্ষের আসর'।

১৯৩৭ সালে ভিক্টোরিয় ধাঁচে নির্মিত এ বাড়ি থেকেই অনুষ্ঠিত হয় প্রথম 'মহিষাসুরমর্দিনী'। এরপরেই ছন্দপতন, ১৯৬১ সালে গার্স্টিন প্লেস থেকে অল ইন্ডিয়া রেডিওর সকল বন্দোবস্ত উঠে এল নবগঠিত আকাশবাণীভবনে। বাসাবদলের সকল স্মৃতিই খুব সুখকর হয় না। বিশ শতকের পাঁচের দশকের গোড়ার দিকে স্টেটসম্যান পত্রিকায় একটি খবর প্রকাশিত হয়, তার শিরোনাম ছিল, 'A.I.R spook frightens employees'। অন্ধকার ঘনিয়ে এলেই গার্স্টিন প্লেসের রেডিও অফিসে নাকি শুরু হয় অশরীরীদের উৎপাত। জাতে এরা সকলেই সাহেব, দেখা দিয়েছে নানান রেডিও কর্মচারীদের। সাহেব ভূতের হাতে প্রথম আক্রান্ত হয় রেডিও বাড়ির কেয়ারটেকার জগমোহন, এখান থেকেই গল্পের সূত্রপাত।

জগমোহনের বাড়ি বিহার, কর্মসূত্রে কলকাতায়  রয়েছেন, একাই অফিস পাহারা দেয়, বুকে প্রবল বল। গার্স্টিন প্লেসের অফিস বিল্ডিংয়ের কুখ্যাতি আগে থেকেই ছিল। তাতে নাকি জিন পরীদের স্থায়ী বসবাস। জগমোহনের দেশোয়ালী বন্ধুরাও তাকে এ বিষয়ে সাবধান করে, কিন্তু আত্মবিশ্বাসী জগমোহন হাতের গুলিতে চাপড় ঠুকে জানিয়ে দেন "রাম লক্ষ্মণ বুকে আছে, করবে আমার কী? ", কিন্তু এই স্পর্ধা বেশিদিন রইল না, শিগগিরিই তাঁকে তাঁর উচ্চপদস্থ ওয়ালিক সাহেবের দ্বারে এসে হাউমাউ করে পড়তে হয়েছিল।

দিনটা ছিল আর পাঁচটা দিনের মতো। রাত বাড়তে সমস্ত ঘরে চাবি তালা দিয়ে জগমোহন সবে এসে শুয়েছেন। সারাদিনের খাটাখাটনির ফলে গভীর ঘুমে নেমে এসেছে তাঁর চোখে। হঠাৎ করে বুটের শব্দ, কাঠের সিঁড়ির উপর। প্রথমে জগমোহন ভাবে বুঝি চোর। ঘরভর্তি হরেক রকমের যন্ত্রপাতি, চোর আসা আশ্চর্যের বিষয় নয়। লাঠি ঠুকতে ঠুকতে ভয়ে ভয়ে সে দোতলায় উঠলেন বুটের শব্দ তখন স্তিমিত কিন্তু বাঁধা পড়ল নীচে নামতে গিয়ে। জগমোহন স্পষ্ট দেখলেন তাঁর চৌপায়ীটা আর স্বস্থানে নেই, শূন্যে উঠে দোল খাচ্ছে. তার উপর যিনি শুয়ে রয়েছেন তিনি ঠিক দেহধারী নন, অবয়ব আবছা। ভয়ে জগমোহনের গলা বুজে এল। কোনো রকমে দরজা ফাঁক করে দালান অবধি আসার পর কী ঘটেছিল আর তার মনে নেই। জগমোহনের গল্পখানা রেডিওর প্রোগাম ইনচার্জ মি. ব্যানার্জি গাঁজাখোরের প্রলাপ বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন বটে, কিন্তু ওয়ালিক সাহেব তাঁকে তোপে বাতিল করতে পারেননি। তিনি জানতেন, যে এলাকার উপর গার্স্টিন প্লেসের বাড়িটা গড়ে উঠেছিল সেটা এককালে ছিল সাহেবদের কবরস্থান।

আরও পড়ুন-বিমান আবিষ্কারের আগে জন্ম, সব স্মৃতি এখনও সজাগ, বিশ্বের বিস্ময় ১১৯ বছরের এই ‘তরুণী’

দ্বিতীয় ঘটনা ঘটেছিল স্বয়ং মি.ব্যানার্জির সঙ্গে। জগমোহনকে ঠাট্টা করে উড়িয়ে দেওয়া যে উচিত হয়নি তা অবিলম্বে তিনি টের পেয়েছিলেন হাড়ে মজ্জায়। ১৯৪৫ সাল। ঠান্ডায় হাত পা হিম হয়ে যাচ্ছে। কাজ সেরে সবে ব্যানার্জি সাহেব একটা সিগার ধরিয়ে ইতি উতি পায়চারি করছেন, এমন সময়ে লক্ষ করলেন পার্শ্ববর্তী সেন্ট জর্জ চার্চের বাগিচায় এক ছায়ামূর্তি হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে। ব্যাপারটা সবে একটু বুঝতে যাবেন, এমন সময় লাউঞ্জে অবস্থিত একটা চেয়ার নিজে থেকেই সিঁড়ি গড়িয়ে এসে নীচে পড়ল। 'এবার বাপু পালাও কোথা?' ব্যানার্জি তখন দে দৌড়।

এমনই সব ঘটতে লাগল। নাগরিক সমাজের কানে রেডিও স্টেশনে ভূতের জলসার খবর পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিল সংবাদ পত্রিকাগুলি। শেষ ঘটনাটি ঘটেছিল একজন বিদেশ ঘোষিকার সঙ্গে। নিজের কিউবিকলসের ওপারে তিনি নাকি এক জলজ্যান্ত কোট প্যান্ট পরিহিত সাহেবকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলেন, দু'চোখে তার মণি নেই,  কেবলই কৃষ্ণগহ্বর। এতকিছুর পর কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয় আর নয়, 'যথেষ্ট হইয়াছে।' অতঃপর, বর্তমানের বিবিদী বাগে অবস্থিত আকাশবাণী ভবনে সমস্ত সরঞ্জামপত্র নিয়ে তারা উঠে আসে। এরপরেও গাস্টিন প্লেসের সেই বাড়ি স্মৃতির পাথর আগলে দাঁড়িয়ে ছিল বহুদিন। অবশেষে ১৯৯৭ সালে বাড়িখানা ভেঙে ফেলা হয়।

More Articles