যে 'ভৌতিক' কবরস্থানের খোঁজ পাওয়া যায় না আর...

একবার এক আত্মীয়াকে  শ্মশান থেকে ফিরে এসে বলতে শুনেছিলাম, সকাল বেলা একসঙ্গে চা খেলাম জানিস, হেসে গল্প করলো, এখন আর নেই। মানুষটা কোথায় চলে গেল বল। স্বভাবতই এটা কোনও প্রশ্ন ছিল না, তাই উত্তর দেওয়ারও কিছু ছিল না। কিন্তু অনেকক্ষণ চুপ করে ছিলাম এটা শুনে। সত্যিই তো একটা প্রাণ, হাসছে, খেলছে , ঘুরছে, ভালোবাসছে,আঘাতে আঘাতে শেষ করে দিচ্ছে, হঠাৎ দুম করে নেই হয়ে যায়। কোথাও নেই। আর কোনওদিন চায়ের দোকানে, পুজোর মণ্ডপে, গঙ্গার ঘাটে কোথাও কোথাও দেখা যাবে না। কোনওদিন না। কক্ষনও না। এই সত্যি যত না বেশি কঠোর তার চেয়ে বেশি শিহরিত করে। মৃত্যু কী? এর উত্তর ডাক্তারি পরিভাষায় বেশ সন্তোষজনক ভাবে পাওয়া গেলেও, মৃত্যুর পরে কী হয়, এই উত্তরে  বিজ্ঞানের জবাব, বেশিরভাগ মানুষের কাছেই খুব গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেনি। আসলে প্রকৃতির শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি যদি মনুষ্যপ্রজাতিকে ধরা হয় (যদিও, এই দাবি মানুষেরই স্বঘোষিত অহংবোধ) তার একটা কারণ হল, মানুষের চিন্তা করার ক্ষমতা আছে।

মানুষ রহস্য পছন্দ করে না। কোনও কিছু তাদের সীমিত জ্ঞানের বাইরে ঘটছে, এ যেন মেনে নিতে তাদের বড় কষ্ট। সুতরাং যেভাবেই হোক, পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া সব ঘটনারই এক রকমের তত্ত্ব তারা খাড়া করতে চায়। আদিমযুগে মানুষ যখন হঠাৎ করে আকাশ থেকে জল কেন পড়ছে, কিংবা হঠাৎ বিদ্যুৎ কেন চমকাচ্ছে, আগুনে বনের পর বন কেন পুড়ে যাচ্ছে, এই প্রশ্ন নিয়ে মাথা কুটে মরতো, তারপর থেকেই একটা দেবদেবীর কনসেপ্ট ঠিক করে এবং তাদের কোপেই এরকম দুর্যোগ হয় এই প্রবোধবাক্য দিয়ে মনকে সান্ত্বনা দেয়। যতদিন পর্যন্ত সঠিক কারণ তারা খুঁজে বের করতে না পারে, দেবদেবীর প্রকোপেই যে এসব হচ্ছে, এই বিশ্বাসে তারা অটল ছিল। ঠিক সেভাবেই মৃত্যুর পরে কী হয়, এই নিয়ে মানুষের মনে কৌতূহলের শেষ নেই. "নাহি ক্ষয় ,নাহি শেষ ,নাহি নাহি দৈন্যলেশ..." কবির এই কথা যেমন এক অসীমের মধ্যে পূর্ণতার প্রাপ্তি দেয়, তেমনি এই 'অসীম' মহাশূন্যে বিলীন হয়ে যাওয়া- খুব তলিয়ে ভাবলে এক মুহূর্ত যেন গা'টা শিরশির করে ওঠে। সেই ভয়, সেই কৌতূহল থেকেই মানুষের মৃত্যুর পরে আদৌ কিছু হয় কি না সেই খোঁজের পর্ব শুরু।

বড় বড় কবরস্থানকে 'নেক্রোপোলিস' বলা হয়। এই 'নেক্রোপোলিস' শব্দটা মূলত এসেছে প্রাচীন গ্রিক শব্দ থেকে। 'নেক্র' শব্দের মানে মৃত আর 'পলিস' শব্দের মানে শহর। সাহিত্যের ক্ষেত্রে এই নেক্রোপোলিস শব্দটি  'সিটি অব ডেড' নামে বহুল প্রচারিত।একটা মানুষ, যার আর প্রাণ নেই, সে সেই মুহূর্তে  জড়পদার্থ ছাড়া আর কী ? কিন্তু প্রাচীন সভ্যতা তা আমাদের দেখায় না। মৃত্যুর পরেও সেই আত্মার অন্য বাসস্থান হয়, সেই বিশ্বাসেই মিশরে মৃতদেহকে মমি করে রাখা হতো। আবার তার সঙ্গেই সেই ব্যক্তির পছন্দের সমস্ত জিনিস এমনকি পছন্দের খাবার দাবারও তার মধ্যে দিয়ে দেওয়া হতো। এই এক অনন্তের পথে যাত্রাকেই যেন বারবার মানুষ মনে প্রাণে বিশ্বাস করে শান্তি পেতে চেয়েছে। এমিলি ডিকিনসন কি এই বিশ্বাস থেকেই লিখেছিলেন "আই ফার্স্ট সারমাইসড দ্য হর্সেস হেডস ওয়ার টোয়ার্ড ইটার্নিটি"? কে জানে।

এই দেহটার বাইরে আদৌ কিছু আছে কি না এই প্রশ্নের উত্তর সেই অতীত কাল থেকে মানুষ এখনও মরিয়া হয়ে খোঁজে।  প্রাচীন রহস্যময় কবরস্থান খুঁজে বের করাই নেশা ছিল এক আমেরিকান ভদ্রলোকের।  নেশা ছিল, সেই কবরস্থানগুলির নেপথ্যের ঐতিহাসিক কারণ এবং রহস্যের অনুসন্ধানও।  এরকম খোঁজ চালাতে চালাতেই তিনি একবার ওয়াশিংটনে 'কিংস্টন পায়োনিয়ার সেমিট্রি'  নামে এক প্রাচীন কবরস্থান-এর সন্ধান পান। এই কবরস্থানে আঠারোশো নব্বই সালে প্রথম সমাধিস্থ করা হয় কর্নাড গর্ডনকে। এই কর্নাড গর্ডনের প্রপিতামহ হলেন বিখ্যাত মহাকাশযাত্রী রিচার্ড গর্ডন!

তিনি এক আর্টিক্যাল থেকে এ কথাও জানতে পারেন, সেখানে নাকি কোনও নারীর অশরীরী আত্মা ঘোরাফেরা করে। তারপরই তিনি এই কবরস্থান খুঁজতে বেরিয়ে পড়েন। এটি খুঁজতে গিয়ে তিনি দেখেন তার ম্যাপ তাঁকে দুটো লোকেশনের খোঁজ দিচ্ছে এবং সেই স্থান গুগল সার্চ করেও তিনি খুঁজে পাননি। এরকম ভাবে তিনদিন ধরে টানা খোঁজার পর অবশেষে তিনি এর খোঁজ পান এবং সেই কবরস্থানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন বলে ঠিকও করেন।  ওখানকার গির্জা রক্ষণাবেক্ষণকারী দের থেকে সাহায্য নিয়ে অবশেষে তিনি তার বহু আকাঙ্ক্ষিত কবরস্থান-এর সন্ধান পান। কিন্তু পৌঁছে তিনি যা দেখেন তা তাঁর উৎসাহে জল ঢেলে দেয় । সেই স্থানে অশরীরী আত্মা  তো দূরস্থান, কোনও সমাধিস্তম্ভ পর্যন্ত ছিল না। ঝোপঝাড়ের মধ্যে দুটো ছোট স্মৃতিস্তম্ভের পেডেস্টাল দেখতে পান শুধু।

এই আমেরিকান ভদ্রলোকের মতোই এরকম বহু মানুষই এই অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছেন এখনও। কেউ কেউ দাবি করেন তাঁরা কিছু উত্তর পেয়েছেন, যদিও তা যথেষ্ট তর্কসাপেক্ষ আবার  কেউ কেউ একেবারেই নিরাশ হয়ে ফেরেন। কিন্তু এতে কোনও পক্ষেরই উৎসাহের কোনও ঘাটতি থাকে না। অনুসন্ধান চলতে থাকে। কিন্তু, এই কবরস্থানগুলো থেকে এই মানুষগুলি যা পেতে চান, তা কি কখনও সত্যিই খুঁজে পাওয়া যাবে আর? এর সঠিক উত্তর একমাত্র সময়ই দিতে পারে।

তথ্যসূত্রঃ

https://m.facebook.com/groups/2339336082983283/permalink/2937537799829772/?sfnsn=wiwspwa

https://en.wikipedia.org/wiki/Necropolis

More Articles