বর্গি এল দেশে - মারাঠা ডিচ
‘খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গি এল দেশে
বুলবুলিতে ধান খেল ভাই খাজনা দেব কীসে ? ’
ঘুমপাড়ানি ছড়ার কথা আসলেই এই ছড়ার স্থান প্রথমদিকেই বলা চলে। তবে এই ছড়া নিছকই এক ঘুমপাড়ানি ছড়া নয়, একদিন এরমধ্যে দিয়েই প্রতিফলিত হয়েছিল বর্গি আক্রমণের কথা। হ্যাঁ, সত্যিই এসেছিল বর্গিরা আর এক রক্তাক্ত অভিজ্ঞতার করিয়েছিল বাংলার মানুষদের। ‘মাহারাষ্ট্রা পুরাণ’ এ বর্গি আক্রমণকালের যে বর্ণনা পাওয়া যায় তা হল,
“সমস্ত গ্ৰামবাসী পালাইয়া গেল। ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতেরা তাঁহাদের পুঁথিপত্র লইয়া পালাইলেন, সুবর্ণবণিকেরা তাঁহাদের দাড়িপাল্লা নিয়ে। গন্ধবণিকেরা তাঁহাদের মালপত্র, ব্যাপারিরা তাঁহাদের পণ্য নিয়া পালাইলেন। কামার হাতুড়ি নিয়া পালাইল, কুমার তাহার চাক নিয়ে পালাইল। জেলেরা জাল নিয়া পালাইল। বানিয়ানা পলায়ন করিল। চারিদিকে কত লোক পালাইয়া গেল তাহার কোনও ইয়ত্তা নেই। গ্ৰামে গ্ৰামে যত কায়স্থ এবং বৈদ্য ছিল তাহারা বর্গীর নাম শুনিবামাত্র পলায়ন করিল। ভদ্র রমণীগণ যাঁহারা কদাপি ঘরের বাহিরে গমন করেন নাই তাঁহারাও মাথায় মালপত্র নিয়া পালাইলেন। যেসব রাজপুত্র কৃষিকাজ করিত, বর্গীর নামোল্লেখমাত্র তাহারা তরবারি ফেলিয়া রাখিয়া ছুটিয়া পালাইল। গোঁসাই মোহন্তগণ পাল্কি চড়িয়া পালাইলেন। কৈবর্ত, শেখ, সৈয়দ, মুঘল, পাঠান সকলে পালাইল। গর্ভবতী রমণীগণও ছুটিয়া পালাইলেন। দশ-বিশজন লোক হয়তো রাস্তার ধারে দাঁড়াইয়া আছে। যদি কেহ জিজ্ঞাসা করে তাহারা বর্গীদের দেখিয়াছে কিনা – তাহা হইলে সকলেই সমস্বরে উত্তর করিবে – ‘না।’ সকলে পালাইতেছে তাই তাহারাও পালাইতেছে।”
বাংলার মসনদে তখন নবাব আলিবর্দি খাঁ। তবে কি নবাব বর্গি আক্রমণ ঠেকাতে কিছুই করেননি? না, করেছিলেন তো বটেই। পলাশি থেকে ২৯কিলোমিটার দূরে মানকরা নামক একস্থানে বাংলার নবাব তাঁবু খাটিয়ে অপক্ষা করেছিলেন একজনের। একটু রাত হতেই মিলল সেই ব্যক্তির দেখা। ভাস্কর পণ্ডিত, জাতিতে তিনি ছিলেন একজন মারাঠা। ততদিনে একাধিকবার তাঁর সৈন্যরা বাংলায় আক্রমণ চালিয়ে যথেচ্ছ হত্যালীলা রচনা করেছে । এই ঘটনার মীমাংসার কারণেই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন নবাব আলিবর্দি খাঁ। ভাস্কর পণ্ডিত সেদিন তাঁবুতে প্রবেশ করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু সেই তাঁবু থেকে তাঁর আর বেরানো হয়নি। পর্দার আড়াল থেকে নবাবের সৈন্যরা বেড়িয়ে সেদিন তাঁকে হত্যা করেছিল। আলিবর্দি খাঁ ভেবেছিলেন, এই বুঝি বর্গি আক্রমণের ইতি। কিন্তু বাস্তব দেখায় অন্য চিত্র।
একটু জেনে নেওয়া যাক, কারা ছিল এই বর্গি? কেনই বা বারংবার আক্রমণের স্থল হিসাবে তারা বাংলাকেই বেঁছে নিয়েছিল? সংক্ষেপে বলতে গেলে মারাঠা সৈন্যবাহিনীর একটি ভাগ ছিল এই বর্গিরা। এদের মূল কাজ ছিল ‘চৌথ’ বা খাজনা আদায় করা আর তা না দিতে পারলে তারা চালাত লুঠপাঠ। একসময়ে মালিক অম্বরের নেতৃত্বে তারা যুদ্ধে বেশ পারদর্শী হয়ে ওঠে এবং পরবর্তী সময়ে তাদের দায়িত্ব নেন ভাস্কর পণ্ডিত, যিনি ছিলেন রঘুজি ভোঁসলের প্রধানমন্ত্রী। তাঁরই নেতৃত্বে বাংলায় বারংবার আক্রমণ চালায় বর্গিরা তাই নবাব ভেবেছিলেন দলের মাথাকে হত্যা করতে পারলেই হয়তো বর্গি আক্রমণ থেকে বাংলাকে রক্ষা করা যাবে। এবার আসা যাক, বাংলাই কেন সেই প্রসঙ্গে। সরফরাজ খাঁ’কে ছলনার মাধ্যমে পরাস্ত এবং হত্যা করে মুর্শিদাবাদের মসনদে বসেছিলেন আলিবর্দি খাঁ। এই ঘটনা সরফরাজ খাঁয়ের জামাতা রুস্তম জঙ্গ মেনে নিতে পারেনি। তাই তিনি এবং তাঁর নায়েব মীর হাবিব যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল নবাবের বিরুদ্ধে, নবাবের বিশাল বাহিনীর কাছে তারা পরাস্ত হয় কিন্তু এই যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে বাংলার দরজা খুলে যায় মারাঠাদের কাছে। সেই সুযোগ নিয়েই ভাস্কর পণ্ডিত তাঁর বাহিনী নিয়ে লুঠ চালাতে থাকে বাংলায়। শোনা যায় বর্গিরা একসময় মুর্শিদাবাদেও পৌঁছেছিলেন, নবাব তখন অনুপস্থিত। সেইসময় তারা ব্যাপক লুঠ চালায় এবং সঙ্গে চালায় অত্যাচার। গ্ৰামের পর গ্ৰাম তারা জ্বালিয়ে দিয়েছিল বলেও কথিত রয়েছে। কিন্তু সেইবার বাংলায় বর্ষা নামায় তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়।
এদিকে কলকাতার মানুষ ভীত সন্ত্রস্ত, একইভাবে ভীত কোম্পানির লোকও। তারা মনে করতে থাকে বর্গিরা যদি মুর্শিদাবাদ অবধি পৌঁছে যেতে পারে , তাহলে কলকাতা আসতে আর কতক্ষণ। কোম্পানির ব্যবসার মূল কেন্দ্র তখন কলকাতায়, ফলে বিপুল ধনসম্পদের খোঁজ পেয়ে বর্গিরা নিশ্চয়ই পরেরবার কলকাতাতেই পা রাখবে। একদিকে যেমন কোম্পান পরামর্শ করল উপরওয়ালাদের সঙ্গে, অন্যদিকে কলকাতার মানুষেরা বর্গিদের বিরুদ্ধে একজোট হওয়ার মনস্থির করেন। কলকাতার মানুষ স্থির করে, তারা নিজেদের রক্ষা নিজেরাই করবে। বর্গিদের ঠেকাত এমনকিছু করতে হবে যা তারা কোনমতেই অতিক্রম না করতে পারে। স্থির হল পরিখার মতো করে কলকাতাকে ঘিরে কাটা হবে গভীর খাদ, যেই খাদে বর্গিরা তাদের ঘোড়া নিয়ে তলিয়ে যাবে। কোন নবাবের মুখ চেয়ে তারা আর বসে থাকবে না। আগাম ২৫ হাজার টাকা ধার নেওয়া হল কোম্পানির থেকে, প্রতিশ্রুতি দেওয়া হল , পরে আবার সাধারণ মানুষই সেই টাকা ফিরিয়ে দেবে। অবিরাম ৬ মাস ধরে কোদাল চালানোর পর তৈরি হল ৬ মাইল জুড়ে খাদ। ইতিমধ্যেই খবর আসে নবাব নাকি মারাঠাদের সঙ্গে সন্ধি করেছেন, তিনি উড়িষ্যা ছেড়ে দিয়েছেন মারাঠাদের জন্য। যার ফলে বাংলায় বর্গি আক্রমণ পর্বের ইতি ঘটে। বর্গিও আর এল না, খাল কাটার কাজও আর পূরণ হল না কিন্তু কলকাতার লোক সারা পৃথিবীর কাছে তকমা পেল ‘ডিচার’ হিসাবে। তারপর বহু বছর পর সেই খাদ বুজিয়ে তৈরি করা হল বাগবাজারের মারাঠা ডিচ লেন আর আপার ও লোয়ার সার্কুলার রোড। ভাবতে অবাক লাগে একদিন যে মাটি কুপিয়ে খাদ বানানোর জন্য টাকা ধার করা হয়েছিল, সেই খাদই আবার বুজানো হল মাটি দিয়ে। বলা হয়, উল্টোডাঙার যে খাদ তাও এই মারাঠা ডিচেরই খানিক অংশ।
তথ্যসূত্র –
- ১। শ্রীপান্থ রচিত ‘কলকাতা’
- ২।https://www.prohor.in/history-of-kolkata-and-borgi-attack
- চিত্র - গুগল।