ভয়াবহ গর্জন, তবু পৃথিবীর নিঃসঙ্গতম প্রাণী এই ৫২ হার্টজ!

The loneliest Whale: বাণিজ্যিক সমস্ত জাহাজের আওয়াজ সমুদ্রে থাকা অসংখ্য তিমিদের আওয়াজকে প্রায় নিষ্প্রভ করে দিচ্ছে

একবার ভেবে দেখুন তো, এই বিশ্বসংসারে আপনার অস্তিত্ব বলে কি কিছু থাকত যদি আপনার গলার আওয়াজ অন্য কেউ শুনতেই না পেত? কীভাবে বেঁচে থাকতেন আপনি? নিজের অস্তিত্ব সংক্রান্ত ঠিক এই প্রশ্নগুলোই বোধ হয় মানুষের মতোন চিন্তা ভাবনা করতে পারা তিমির মাথাতেও আসে! যার গলার ডাকের কম্পাঙ্ক নাকি ৫২ hertz! সামুদ্রিক প্রাণী সংক্রান্ত বিজ্ঞানীদের কাছে এই তিমি "ফিফটি টু হার্টজ" নামেই পরিচিত। ১৯৯২ সালে U.S Navy-এর একটি গোপন কর্মসূচির মাধ্যমে এই তিমির অদ্ভুত ৫২ hertz এর কম্পাঙ্ক চেনা যায়। তারপর থেকেই বিশ্ব জুড়ে গবেষক ও বিজ্ঞানীদের দল মুগ্ধ এবং কৌতুহলী হয়ে আছেন এই কম্পাঙ্কের উৎস জানবার জন্য। পৃথিবী গ্রহের অন্তহীন সমুদ্রে ভাসতে থাকা সবচেয়ে নিঃসঙ্গ প্রাণী বোধহয় ৫২ hertz-এর সেই তিমি।

আমাদের অনেকের কাছেই সমুদ্রগর্ভ মানেই হলো তুলনামূলক ভাবে শান্ত এবং শব্দহীন একটি জায়গা। কিন্তু আসলে এটি ভুল ধারণা। সমুদ্রের নিচের পৃথিবীতে আসলে কর্তৃত্ব করে শব্দ বা শব্দের কম্পাঙ্ক এবং আজকের দিনে ঘরে বসে তিমির ডাকের কম্পাঙ্ক শোনা কোনও কঠিন বিষয়ই নয় ! গুগলে সার্চ করে তিমির মাছের ডাক শুনলেই আপনি বুঝতে পারবেন যে সাধারণ তিমির ডাক ১৫-২৫ hertz এর বেশি কখনই হয় না । কিন্তু, এই বিশেষ ৫২ hertz তিমি হলো একমাত্র তিমি যার ডাকের কম্পাঙ্ক সাধারণ তিমির ডাকের কম্পাঙ্কের দ্বিগুণ, যা কিনা ভাবনাচিন্তার অতীত! এই তিমির ডাক এতটাই অতুলনীয় এবং অদ্ভুত যে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এই তিমির ডাক অন্য তিমিরা শুনতেই পায় না। ৫২ hertz কে নিয়ে সাধারণ মানুষ অত্যন্ত মুগ্ধ হলেও খুব কম লোকই এই তিমির আসল রহস্যের কথা জানেন। আসুন, জেনে নেওয়া যাক ৫২ hertz এর সেই রহস্যজনক গল্প।

আরও পড়ুন- রয়েল বেঙ্গল নয়, সুন্দরবনের এই প্রাণীটির ওপরেই এখন নজর পশুপ্রেমীদের

৫২ hertz-এর খোঁজ কীভাবে পাওয়া গেল তা জানতে গেলে ফিরে যেতে হবে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মাঝে হওয়া 'কোল্ড ওয়ার' এর সময়টায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাবমেরিন জাহাজ গুলির শব্দ শনাক্ত করার জন্য তখন ইউ এস মিলিটারিরা হাইড্রোফোন নামক এক যন্ত্রের ব্যবহার করত। আমেরিকা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যেকার এই যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর হাইড্রফোনগুলিকে মেরিন লাইফের গবেষণার উদ্দেশ্যে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

গবেষণা চলাকালীন হঠাৎই সেই যন্ত্রে একদিন ধরা পড়ল কিছু তিমির অদ্ভুত আওয়াজ। উডস হোল ওশেন গ্রাফিক ইনস্টিটিউটের উইলিয়াম ওয়াটকিনস নামের একজন বিখ্যাত গবেষক অনেক তিমির ডাকের মধ্যেও একটি বিরল আওয়াজ শনাক্ত করেন। এই অপ্রত্যাশিত আওয়াজের কম্পাঙ্ক তাঁকে ধন্ধে ফেলে দেয়। শুরুতে তিনি মনে করেছিলেন যে, এই আওয়াজ নির্ঘাত কোনও যুদ্ধ ঘোষণাকারী সাবমেরিনের হতে পারে। কিন্তু যে সময়কার এই কথা, সেই সময় দুই দেশের মাঝের ঠান্ডা যুদ্ধ শেষ হয়েগেছে। তাঁর মতে, সেই আওয়াজটির সঙ্গে নীল তিমি বা অন্যান্য তিমিদের ডাকেরও কোনওরকম মিল ছিল না, অথচ সেই আওয়াজটি তিমিদের গতিপথ অনুসরণ করেই পাওয়া যাচ্ছিল। এই অদ্ভুত শব্দের খোঁজ করতে গিয়েই  ৫২ hertz-এর তিমি মাছের অনুসন্ধান শুরু হয়।

বিরল এই তিমি আজ মানুষের কাছে আকর্ষণীয় একটি বিষয়। এমনকী বিখ্যাত কোরিয়ান মিউজিক ব্যান্ড BTS ২০১৫ সালে Whalien 52 বলে একটি গান তৈরি করে। এখানেই শেষ নয়, চলতি বছরে মুক্তি পেয়েছে The Loneliest Whale : The Search for 52 নামক একটি তথ্যচিত্র যার সম্পাদনা মূলক প্রযোজকদের মধ্যে একজন হলেন স্বয়ং লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও. পৃথিবীর নিঃসঙ্গতম তিমি মাছকে নিয়ে যখন এত শোরগোল, তখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, এই ৫২ hertz তিমি মাছটির এই একাকীত্বের জন্য কি আমরাই দায়ী?

আরও পড়ুন- মানুষ এক ছোবলেই ছবি! তবে কোন রহস্যে সাপের তীব্র বিষেও বেঁচে যায় বন্য প্রাণীরা?

মানবজাতির কিছু মূর্খামিই আজ তবে বাধ্য করেছে এই তিমিকে একা থাকতে? বিশ্ববাসীর এটা বুঝতে আর বাকি নেই যে কার্গো জাহাজ, লঞ্চ, স্টিমার চলাচলের দরুণ তিমিদের বেঁচে থাকা অত্যন্ত দুষ্কর হয়ে উঠেছে। বাণিজ্যিক এই সমস্ত জাহাজের আওয়াজ সমুদ্রে থাকা অসংখ্য তিমিদের আওয়াজকে প্রায় নিষ্প্রভ করে দিচ্ছে। নিজেদের কম্পাঙ্কের মাধ্যমে যে আদান-প্রদান তিমিরা করে থাকে, তা ক্রমশ শক্ত হয়ে উঠছে পৃথিবীর সবথেকে বড় প্রাণীটির পক্ষে। যদিও, এখনও ৫২ hertz-এর সেই তিমিটি সত্যি একা নাকি একাধিক তিমি আছে সেই দলে, এ বিষয়ে এখনও কোনও সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। এমনটাও হতে পারে যে ৫২ hertz তিমিটির অন্যান্য তিমিদের সঙ্গে জৈবিক সাদৃশ্য আছে, কিন্তু এর কম্পাঙ্ক সম্পূর্ণ আলাদা। এতটাই আলাদা যে এর আওয়াজ হয়তো অন্য তিমিরা শুনতে পায়, কিন্তু সে আসলে কী বলার চেষ্টা করছে সেটা তারা আর বুঝে উঠতে পারে না। বিজ্ঞানীদের একাংশের ধারণা অনুযায়ী এই তিমিটি নীল তিমি এবং অন্যান্য তিমির সংকরায়ণে তৈরি একটি বিরল প্রজাতির তিমি।

বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী, উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরই হলো বর্তমানে ৫২ hertz তিমির আসল বাসস্থান। এই খবরটি পড়াকালীন আপনি যদি ক্যালিফোর্নিয়ার উপকূলবর্তী এলাকায় থেকে থাকেন, তবে এই অদ্ভুত সৃষ্টি হয়তো বা আপনার চোখে পড়ার কথা। আপনার দায়িত্ব হলো, ৫২ hertz কে দেখা মাত্রই একটি ছবি তোলা এবং এর অস্তিত্ব চিরকালের জন্য এই পৃথিবীর ইতিহাসে অমর করে রাখা।

Sources: Wikipedia, The loneliest Whale: The search for 52, www.seaworld.com 

More Articles