শ্রুতিতে ও দৃষ্টিতে মহালয়া

“ওঁ যেহবান্ধবা বান্ধবা বা যেহন্য জন্মনিবান্ধবাঃ । তে তৃপ্তিমখিলাং যাস্তু যে চাস্মত্তোয়কাঙ্ক্ষিণঃ। ওঁ আব্রহ্মস্তন্তপর্য্যন্তং জগত্তৃপ্যতু।”
অর্থাৎ, বান্ধব-অবান্ধব তথা জন্মান্তরের বান্ধব ও সেইসঙ্গে নির্বান্ধব-বংশধরহীন পিতৃকুলের সমস্ত আত্মা সহ পরম ব্রহ্ম থেকে জগতের ক্ষুদ্রতম কীটাণুকীটের পর্যন্ত জলের আকাঙ্ক্ষা প্রদত্ত এই জলে তৃপ্ত হোক। উচ্চারিত এই শ্লোকের সাধনে পিতৃপক্ষের অবসান ও দেবীপক্ষের সূচনার সন্ধিলগ্ন হিসাবে সূচিত মহালয়ার ভোরে পিতৃকুলের উদ্দেশে তিল ও জল দান করার তর্পণরীতি (‘তৃপ’ + ‘অনট’ প্রত্যয় যোগে ‘তর্পণ’ অর্থে ‘তৃপ্তিসাধন’ ঘটানো) মহালয়া তিথির সঙ্গে আজন্মকাল লীন হয়ে আছে। পুরাণ, শাস্ত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, এই তিথিতে প্রয়াত আত্মারা পিতৃলোক ছেড়ে ইহলোকে ফিরে আসেন উত্তরপুরুষের নিবেদিত জলের প্রত্যাশায়। মহৎ (মহা) আত্মাদের সমাবেশ (আলয়)-এর এই তিথিকে দেবীপক্ষের সূচনার কারণে ‘মহালয়’-এর স্ত্রীবাচক অর্থে ‘মহালয়া’ বলা হয়।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে দেখি, মোক্ষকারক যে ক্ষণে জীর্ণ আত্মার, পরমব্রহ্মে লয় প্রাপ্তি ঘটে, তাকেই ‘মহালয়’ বলা হয়। আবার মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে মহাত্মা ভীষ্ম যখন অর্জুন নির্মিত শরশয্যায় শুয়েছিলেন, তখন ইচ্ছা-মৃত্যুবরণের জন্য যমলোকের দ্বার বন্ধের কাল অর্থাৎ সূর্যের উত্তরায়ণের এই নির্দিষ্ট পুণ্যতিথিটির জন্য তিনি অপেক্ষা করছিলেন- “রবির উত্তরায়ণ হইবে যখন/ জানিহ তখন আমি ত্যজিব জীবন।”। আবার কৌন্তেয় দাতা কর্ণ তাঁর মৃত্যুর পর স্বর্গলাভের আগে আশ্বিনের অমাবস্যা তিথিতে পিতৃপুরুষদের অন্ন-জলদান করার জন্য পৃথিবীতে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন এই তিথিতেই। অন্যদিকে কৃত্তিবাসী রামায়ণ অনুযায়ী, আবার মহালয়ার সন্ধিক্ষণের এই প্রতিপদ কল্পারম্ভার সময়কালেই শ্রীরামচন্দ্র রাবণবধের জন্য দেবী দুর্গার অকাল্-বোধন করেছিলেন। এই মহালয়াতেই “মহ্যন্তে পূজ্যন্তে দেবাদয়োহস্নিন্নিতি” অর্থাৎ দেবপূজায় মহাদেবীর আরাধনার বার্তাবাহী শরতে প্রাচীন গৃহস্থের বাড়ি, দেবী মন্দিরে চণ্ডীপাঠ, শাস্ত্রপাঠ, ভজন পূজনের মাধ্যমে সূচিত হয় দেবীপক্ষ।
পুরাণ, শাস্ত্র কিংবা মহাকাব্যগুলিতে যা ছিল এক নিয়মরক্ষার রীতি, তার সঙ্গে সুর-তাল-লয় মিশিয়ে কলকাতার বেতারজগৎ ১৯৩২ সালের পরবর্তীতে এমন এক অনুষ্ঠানের জন্ম দিল, যা কালক্রমে মহালয়ার সমার্থক হয়ে উঠল প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে – “মহিষাসুরমর্দিনী”। শঙ্খধ্বনি দিয়ে শুরু হয়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গলায় চণ্ডীপাঠের পরে যখন ঘরে ঘরে একইসঙ্গে ধরা দেয় “আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জীর; ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা; প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমন বার্তা”, কলকাতার বুকে সেই পরম সন্ধিক্ষণই মহালয়ার পুণ্যতিথি।
১৯৩২ সালে দুর্গাপুজোর মহাষষ্ঠীর ভোরে প্রথম সম্প্রচারিত ‘প্রত্যুষ প্রোগ্রাম’, যা পরবর্তীকালে ‘প্রভাতী অনুষ্ঠান’ বা ‘মহিষাসুর বধ’ নামে সম্প্রচারিত হলেও, ১৯৩৭ সাল থেকে স্থায়ীভাবে অনুষ্ঠানটির নাম হয় ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। ঠিক হয় মহাষষ্ঠীর ভোরে নয়, বরং মহালয়ার ভোরেই অনুষ্ঠানটি সম্প্রচারিত হবে। অনুষ্ঠানটির রচয়িতা ছিলেন বাণীকুমার এবং সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্বে থাকতেন রাইচাঁদ বড়াল ও পঙ্কজকুমার মল্লিক। অধিকাংশ গানে সুর দিয়েছিলেন পঙ্কজ মল্লিক নিজেই। এছাড়াও ছিলেন পণ্ডিত হরিশচন্দ্র বালী (‘বিমানে বিমানে আলোকের গানে’), উস্তাদ সাগির খাঁ (‘শান্তি দিলে ভরি’) প্রমুখেরা। ১৯৪৫-৪৬ সাল নাগাদ একবার হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সমগ্র অনুষ্ঠানটির সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব নেন। যদিও সেবছরের অনুষ্ঠানটি শ্রোতাদের বিশেষ পছন্দ হয়নি। জানা যায়, ১৯৩২ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠানটি লাইভ সম্প্রচারই হত। পুরোধা বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র স্টুডিয়োতেই স্নান সেরে গরদের ধুতি-চাদর পরে শঙ্খধ্বনির মাধ্যমে অনুষ্ঠানটি শুরু করতেন। তাঁর সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করতেন সুপ্রীতি ঘোষ, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, শিপ্রা বসু, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, উৎপলা সেন, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। মোটামুটি দেড় ঘণ্টার এই অনুষ্ঠানটি ১৯৭২ সালে স্থায়ীভাবে রেকর্ড করা হয়, যার সম্প্রচারই আপামর বঙ্গবাসীর মহালয়ার ভোরকে আজও এমন মায়াবী করে রেখেছে।
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গলায় চণ্ডীপাঠ সহ মহালয়ার এই অনুষ্ঠান শ্রোতাদের মনে এমনই বিশেষ জায়গা করে নিয়েছিল যে, তাঁর পরিবর্তে মহানায়ক উত্তমকুমারও তাঁর জায়গায় ভাষ্যপাঠক হিসাবে শ্রোতাদের কাছে আদৃত হননি। ১৯৭৬ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বরের ভোরে বাণীকুমারের লেখা চিরাচরিত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র পরিবর্তে আকাশবাণীর প্রচার তরঙ্গে বেজে উঠেছিল ধ্যানেশনারায়ণ চক্রবর্তীর ‘দেবীং দুর্গতিহারিণীম’, যার প্রধান ভাষ্যকার ছিলেন উত্তমকুমার। কিন্তু কিছু বিষয়ে যে ঐতিহ্যের প্রতি একান্ত সমর্পণই কাম্য, তারই উদাহরণ ছিল সেদিনের ঘটনাটি। আকাশবাণী প্রকৃত অর্থেই সেদিন জনরোষের মুখে পড়েছিল।
অথচ আকাশবাণীর ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ অনুষ্ঠানটির জন্ম হয়েছিল এক ঘরোয়া আড্ডায়। সকলের পরিচিত বুড়োদা ওরফে ‘বেতার জগৎ’ পত্রিকার সম্পাদক প্রেমাঙ্কুর আতর্থী একদিন কথাচ্ছলে বলেছিলেন- “ওই তো বাণী রয়েছে- সংস্কৃতের আদ্যশ্রাদ্ধ করেছে- ওই কতকগুলো বৈদিক শ্লোক জোগাড় করে ফেলুক আর গান লিখুক, রাই সুর দিক, বীরেন শ্লোক আওড়াক- ভোরবেলা লাগিয়ে দাও, লোকের ভালো লাগবে।” সেই ভালো লাগার বিস্ময় যে মানুষের মনে এমন চিরস্থায়ী ছাপ ফেলে দেবে, তা হয়তো তাঁদের কল্পনার অতীত ছিল।
শ্রী শ্রী মার্কণ্ডেয়চণ্ডীর ভিত্তিতে লেখা ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র ঝংকৃত বাণীরূপ শুধুমাত্র তৎসম শব্দমালার অভিনব বিন্যাসই নয়। অনুষ্ঠানটির গীতিকাব্যছন্দে সুরের প্রাণময় দোলা আপামর বাঙালির মনে যে আলোকিত হৃদয়ের উদ্ভাসকে ফুটিয়ে তোলে, তাতে শোনা যায় বাঙালি গৃহস্থের প্রবাসী মেয়েটির ঘরে ফেরার পদধ্বনি। আলোর বেণু বাজে আর মেতে ওঠা ভুবনের দ্বারপ্রান্তে দেখা দেয় আকাশের আর কাশের বাহার। বুড়ো বরকে ছেড়ে হিমালয়কন্যকা দুগগি আমাদের ঘরে ফেরে, শিউলি মালায় সেজে। বাকি বছরভোর তার সেই মুখ আঁকা হয়ে থাকে আমাদের হৃদয়পটে।
আর দুর্গাপ্রতিমা বললেই যার মুখ বাঙালির চোখে ভাসে, তিনি সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতা দূরদর্শন ১৯৯৪ সালে ডান্স থিয়েটার হিসাবে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র উপস্থাপনার জন্য গুরু গোবিন্দন কুট্টির ছাত্রী সংযুক্তাকে বেছে নেয়। টানা মাস দুয়েক কঠিন পরিশ্রম ও ওয়ার্কশপের পর ডিরেক্টর প্রোডিউসার শর্মিষ্ঠা দাশগুপ্তের তত্ত্বাবধানে তপন সিনহার সহযোগী পরিচালনা ও সনৎ মোহান্তের নির্দেশনায় তৈরি হয় ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী ও পরবর্তীতে হীরেন চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ভাষ্যরচয়িতা। পরবর্তীতে নির্দেশনার কাজে হাত লাগিয়েছিলেন কল্যাণ ঘোষ। সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে অন্যান্য চরিত্রে ছিলেন নীলকান্ত সেনগুপ্ত, রাহুল বর্মণ, কৌশিক চক্রবর্তী, নিবেদিতা বসু প্রমুখেরা। সংযুক্তা এক সাক্ষাৎকারে জানান, বাকি আটটা মাটির হাত দড়ি দিয়ে পিঠে বেঁধে তাঁকে অভিনয় করতে হত। টানা শ্যুটিং করতে গিয়ে গায়ে রীতিমতো কালশিটে পড়ে যেত তাঁর। দেবতাদের দুর্গাকে অস্ত্র দান করার দৃশ্যটি সম্পাদনা করতে গিয়ে বহু সমস্যার সম্মুখীন হতেন তৎকালীন ক্রিয়েটিভ এডিটররা। তবু আজও ‘দশপ্রহরণধারিণী’ মানেই সংযুক্তার মুখশ্রী ভাসে আমাদের মনে। এর আগে দূরদর্শনে প্রথমবার ১৯৮৫ সালে মহালয়ার বিশেষ প্রভাতী অনুষ্ঠান ‘যা দেবী সর্বভূতেষু’তে দুর্গার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন শ্রীমতি মালবিকা মিত্র ও বর্ণালী মিত্র। এছাড়াও সংযুক্তার পরেও দেবশ্রী, হেমামালিনী, অপরাজিতা আঢ্য এমনকি হালের কোয়েল মল্লিক থেকে শ্রাবন্তী, সবাই প্রায় দুর্গার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। তবু ইউটিউবের পুরোনো ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র ভিডিওর কমেন্টবক্সে গেলেই বোঝা যায়, কত মানুষ এখনও কীভাবে কানাডার টরোন্টোনিবাসী সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আরেকবার নতুনভাবে দুর্গারূপে দেখবেন বলে অপেক্ষায় আছেন।
তাই নীলকণ্ঠ পাখির ডানার নীল রং মেখে আকাশ সেজে উঠেছে আবার। মহামারীর আবহও কাশের বনকে মাথা দোলানো থেকে বিরত করতে পারেনি। শিউলির ডালে থোকা ভর্তি কুঁড়ি আর বাতাসে হিমের আমেজ বুঝিয়ে দিচ্ছে তিনি আসছেন, এসে পড়ছেন । আর মাত্র কয়েকটা দিন, জাগরণের ভোরে প্রথম আলো হিমালয়ের চূড়া স্পর্শ করার আগেই আবার ঘরে ঘরে বেজে উঠবে- “মহিষাসুরনির্ণাশি ভক্তনাং সুখদে নমঃ। / রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি।।” মহালয়া শুনে বাঙালির ছুটি শুরু হবে, ঘরে আসবে পুজো।

More Articles