হরেক রকম ভূতের মেলা
কিছুদিন আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি কার্টুন চোখে পড়লো। একটা বাচ্চা ভূত বেচারা ঢুকতে গেছে সাহেবদের হ্যালোইনে কিন্তু এই পরিস্থিতি দেখে তার মা, কানটি ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে তাকে নিয়ে যাচ্ছে আর বলছে ‘আমার ভূত চতুর্দশী আছে, চল, বাড়ি চল’। দেখতে দেখতে আজ সেই ‘ভূত চতুর্দশী’ এসেই গেল। আমাদের বাঙালিদের হ্যালোইন। তবে ভূত চতুর্দশী আর বিদেশের হ্যালোইনের মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। প্রথমে সেই নিয়ে কিছু তথ্য দেব আপনাদের। হ্যালোইন হল প্রাচীন আর্যদের উত্সব। মূলত ইউরোপ এবং আমেরিকায় ফসল কাটার শেষদিনে পালন করা হয় হ্যালোইন। কিন্তু বর্তমানে এশিয়ার দেশগুলিও এই উত্সবকে আপন করে নিয়েছে। বিগত বেশকিছু বছর ধরে ভারতেরও অনেক জায়গাতেই হ্যালোইন পালন করা হচ্ছে। ৩১শে অক্টোবর রাত এবং ১লা নভেম্বরের ভোরের মধ্যবর্তী সময়ে বিশ্বজুড়ে উদযাপিত হয় হ্যালোইন। এই বিশেষ দিনটি দু-হাজারেরও বেশি বছর ধরে পালিত হয়ে আসছে। বেশিরভাগ পশ্চিমী খ্রিস্টান এবং খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা এই পরব পালন করে থাকেন। হ্যালোইনের অর্থ হল ‘পবিত্র সন্ধ্যা’। এই দিন মৃত কোন মহাপুরুষ কিংবা শহীদদের স্মরণ করা হয় এবং বিদেহী আত্মা, এখনো যারা স্বর্গে পৌঁছায়নি, তাঁদের জন্য প্রার্থনা করা হয়ে থাকে। আজ থেকে প্রায় দু’হাজার বছর আগে আয়ারল্যান্ড, ইংল্যান্ড এবং উত্তর ফ্রান্সের কেল্টিক জাতিরা নাকি এই পয়লা নভেম্বর দিনটিকে বছরের প্রথমদিন হিসাবে পালন করার রীতি ছিল। ইউরোপিয়ান দেশগুলিতে শীত অত্যন্ত বেদনাদায়ক আর নভেম্বরের শুরু মানেই শীতের আগমণ। তাই সেখানকার মানুষেরা মনে করেন অক্টোবরের শেষ রাতটি অত্যন্ত খারাপ, আবার অনেকে মনে করেন এই রাতে সমস্ত অতৃপ্ত আত্মারা নেমে আসে মর্ত্যলোকে, উড়ন্ত ঝাঁড়ু নিয়ে হ্যালোইন বুড়ি চরকির মতো ঘুরে বেড়ায় আকাশ পথে। এই ডাইনির সঙ্গে সাক্ষাৎ মানেই নিজের জীবনে দুঃখকে ডেকে আনা। তাই সবাই নিজের পরিচয় গোপন রাখার কারণে ভূতের মতো নানান মুখোশ এবং কাপড় পরে ঘুরে বেড়ান।
এবার আসা যাক আমাদের বাংলা হ্যালোইনের কথায়, মানে ভূত চতুর্দশীর কথায়। বাঙালিরা কার্তিক মাসের অমাবস্যার কালীপূজার আগেরদিন উদযাপন করে এই দিনটিকে। ভূত চতুর্দশীতে চোদ্দো শাক খাওয়া এবং দুয়ারে কিংবা ঘরের কোণে চোদ্দো প্রদীপ দেওয়ার রীতি রয়েছে। এই চোদ্দো সংখ্যাটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে চোদ্দো পুরুষ ব্যাপারটি। অনেকে মনে করেন, ঘরের কোণে প্রদীপ জ্বালানো হয় অশুভ শক্তির বিতারণের জন্য । তবে এই তথ্যটি সম্পূর্ণ সঠিক নয়। মনে করা হয়, আজকের দিনে চোদ্দো পুরুষের সবাই আমাদের কাছাকাছি কোথাও অবস্থান করেন এবং তাঁদের শ্রদ্ধা জানাবার উদ্দেশ্যেই এই চোদ্দো শাক এবং চোদ্দো প্রদীপ দেওয়া হয়ে থাকে। এই ভূত চতুর্দশী নিয়ে আবার বিষ্ণু পুরাণে বলা হয়েছে, দানবরাজা বলি ছিলেন ত্রিভুবনের অধিশ্বর। একসময় তিনি নিজের অহংকারে সমস্ত সীমা অতিক্রম করে দেবতাদের প্রচণ্ড উত্যক্ত করে তুলেছিলেন। এই সময় যথারীতি দেবতারা বিধান চাইতে দ্বারস্থ হন বিষ্ণুর নিকটে। বিষ্ণু এই সমস্যা সমাধানের উদ্দ্যশ্যে এক ভিক্ষুক বামনরূপে হাজির হন বলির কাছে। বলি আসলে বিষ্ণুকে চিনতে পারলেও তা প্রকাশ করেননি। অন্যদিকে বিষ্ণু তাঁর নিকট তিন পা জমি ভিক্ষা করেন। বলি তা দিতে রাজিও হন। এই ঘটনার সুযোগ নিয়ে বিষ্ণু তাঁর একটি পা রাখেন স্বর্গে, অন্য পা’টি রাখেন মর্ত্যে। বিষ্ণুর নাভির থেকে তৃতীয় পা বেরিয়ে আসলে বলি ঘটনা বুঝে নিজের মাথা পেতে সেই পা নিজের উপর নেন এবং তিনি পাতালে চলে যান। মৃত্যু অনিবার্য জেনেও বলির এ হেন আচরণে বিষ্ণু প্রসন্ন হন এবং নরকাসুর রূপে মর্ত্যে তাঁর পূজার প্রচলন ঘটান। কথিত আছে, আজ এই নরকাসুর মর্ত্যে আসেন এবং সঙ্গে আসে তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা। কিছু সময়ের জন্য স্বর্গ এবং পাতালের দরজা আজ খুলে যায় এবং সেই সময়েই মর্ত্যে আসেন অসংখ্য বিদেহী আত্মারা।
এইদিনকে আবার ‘যম চতুর্দশী’ও বলা হয়ে থাকে। এই যম চতুর্দশীর সঙ্গে আবার জড়িয়ে আছে ১৪জন যমের পৌরাণিক কাহিনি। পদ্মপুরাণে বলা হয়েছে, এই যম চতুর্দশীর দিনে। কেউ যদি গঙ্গাস্নান করেন তাহলে তাঁর কোনভাবেই নরক দর্শন ঘটবে না। আবার আজকের দিনের সাথেই জড়িয়ে আছে ‘পঞ্চভূত’ প্রসঙ্গও। হিন্দুধর্মে বলা হয়, মৃত ব্যক্তির আত্মা মিশে থাকে ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুত্ এবং ব্যোমে। যে চোদ্দো শাক খাওয়ার রীতি আছে, তারমধ্যেও আবার কিছু বিশেষ শাকের উল্লেখ রয়েছে। ওল, কেও, বেতো কলকাসুন্দা, নিম, সরিষা, শাঞ্চে, জয়ন্তী, গুলঞ্চ, পটুক পত্র, ঘেঁটু বা ভাঁট, হিলমোচিকা বা হিঞ্চে, শুষুনী, শেলু বা শুলকা ইত্যাদি শাকের উল্লেখ থাকে কিন্তু আজকের দিনে এরমধ্যে অনেক শাকই বাজারে প্রায় পাওয়া যায় না বললেই চলে। তাই নিয়ম রক্ষার্থে যেকোন ধরনের চোদ্দো রকমের শাকই রান্না হয়ে থাকে বেশিরভাগ ঘরে। আসলে এই শাকগুলো তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার কারণ হিসাবে রয়েছে শাকগুলির আয়ুর্বেদিক গুণ। শীতকালের শুরুতে অনেকেই বিভিন্ন রোগের সম্মুখীন হয়ে থাকেন, এইসময় তাই এই শাক খাওয়ার নিয়মটি অন্তত কৌশলের সঙ্গেই প্রস্তুত করা হয়েছে বলেই ধারণা করা যেতে পারে।
বাংলাদেশের ফরিদপুর অঞ্চলে ‘চৌর চতুর্দশী’ নামে দিনটি পালিত হয়, এইদিন কিছু না কিছু চুরি করার রীতির প্রচলন রয়েছে বাংলাদেশের হিন্দুদের মধ্যে। দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু, কর্ণাটকে দিনটি পালিত হয় ‘নরক চতুর্দশী’ নামে। মালদা এবং মেদিনীপুরের কিছু অঞ্চলে আবার ভূত পুজোর নিয়ম রয়েছে। ফল, মিষ্টি সহযোগে পূজা দেওয়া হয়ে থাকে ভূতেদের। এভাবেই বাঙালিরা আপন করে নেয় দেবতা থেকে ভূত সবাইকেই, সবাই যেন ঘরেরই ছেলে-মেয়ে।
তথ্য সূত্র-
৪.https://sobbanglay.com/sob/bhoot-chaturdashi/
ছবি- নিজস্ব