প্রেমের আদর্শ জায়গা প্রিন্সেপ ঘাট, যে ইতিহাস আজও অজানা

প্রেমিক-যুগল এখানে ভিড় করেন ঠিকই, কিন্তু প্রিন্সেপ ঘাটে ক্যামেরা হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো লোকজন প্রচুর চোখে পড়বে আপনার।

গরমে প্রাণ যায় যায় অবস্থা। গরমকালের একটা ছুটির দিনের সন্ধেবেলা। অথবা শেষ ডিসেম্বরের নরম রোদভরা ঠান্ডা ঠান্ডা একটা দুপুর। ঘরে কিছুতেই আর মন থাকতে চাইছে না। নিজের প্রিয় মানুষটির সঙ্গে অথবা একাই যেতে ইচ্ছে করছে এমন কোনও জায়গায়, যেখানে গেলে এই ব্যস্ত শহরের মধ্যেই আপনি পাবেন অনেক গাছ, বাগান, অপরূপ স্থাপত্য, গঙ্গার বুকে সূর্যাস্ত দেখার সুযোগ, নৌকোয় বেড়ানোর ব্যবস্থা, পাশাপাশি সন্ধ্যায় চমৎকার আলোকসজ্জা, বিভিন্ন লোভনীয় খাবারের স্টল। তখন তো আপনি বেরিয়ে পড়বেনই, আর কলকাতার মধ্যেই এরকম একটা জায়গায় বেড়াতে যেতে চাইলে সেই জায়গাটার নাম প্রিন্সেপ ঘাট। যার পরতে পরতে জড়িয়ে আছে ইতিহাসের ধুলোমাখা গন্ধ। কিন্তু কে এই জেমস প্রিন্সেপ? কলকাতার ইতিহাসের সঙ্গে কী তাঁর সম্পর্ক? তা জানতে যেতে হবে পিছনের দিকে।

 

ব্রিটিশ যুগে ঘাটটি তৈরি হয়েছিল ১৮৪১ সালে। প্রথম দিকে ব্রিটিশদের সব যাত্রীবাহী জাহাজ এই ঘাটেই ওঠানামা করত। এই ঘাটটির নাম প্রায় সবার মুখে মুখে ফেরে। সকলেরই জায়গাটি চেনা। তা হলেও ঘাটের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষটি কে, কেনই বা তাঁর নামে এত বড় একটি স্মৃতি সৌধ, সেকথা অনেক কলকাতাবাসী হয়তো জানেন না।

 

জেমস প্রিন্সেপ ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বকে নতুন জীবন দিয়েছিলেন। সম্রাট অশোকের শিলালিপির পাঠোদ্ধার করেছিলেন জেমস প্রিন্সেপ। যখন তিনি ব্রাহ্মীলিপিতে অশোকের দীর্ঘ অনুশাসনের পাঠোদ্ধার করেন, তখন অশোক ও প্রাচীন ভারত সম্পর্কে কেউই বিশেষ কিছু জানতেন না। প্রাচীন মুদ্রাগুলোতে গ্রিক ও ব্রাহ্মীলিপিতে রাজার নাম লেখা থাকত। প্রিন্সেপ গ্রিক হরফ জানতেন, ব্রাহ্মীলিপিতেও দক্ষতা ছিল। তাঁর পরিশ্রমের ফলেই বিশ্বের মানুষ প্রাচীন ভারতের শক্তিশালী শাসক বিহারের অশোক সম্পর্কে জানতে পারে। একই সূত্রে জানা যায় গৌতম বুদ্ধ সম্পর্কেও। তাঁর এই স্মরণীয় অবদান ভারতের প্রাচীনকালের ইতিহাস পুনরাবিষ্কারে ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ভূমিকা রূপে স্বীকৃত।

 

আরও পড়ুন: বিধানচন্দ্র রায় থেকে জ্যোতি বসু, এই মডেলের ফিয়াট পছন্দ ছিল সকলেরই

 

জেমস প্রিন্সেপ মাত্র ২০ বছর বয়সে ইংল্যান্ড থেকে চাঁদপাল ঘাটে নেমেছিলেন। কলকাতার টাঁকশালে সহকারী ধাতু পরীক্ষক (Assey Master) হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। তারপর তাঁকে নতুন টাঁকশাল খোলার জন্য কাশীতে পাঠানো হয়। ফের তিনি ডেপুটি 'এসে মাস্টার' হিসেবে কলকাতার টাঁকশালে ফিরে আসেন। তিনি ‘ভিউজ অ্যান্ড ইলাসস্ট্রেশনস অফ বেনারস’ নামে একটা বই লেখেন। ‘গ্লেনিংস অফ সায়েন্স’ নামে একটা সাময়িক পত্রিকা সম্পাদনা করেন। এই সাময়িক পত্রিকাটিই পরবর্তীকালে কলকাতা এশিয়াটিক সোসাইটির মুখপত্র হয়। ১৮৩২ থেকে ১৮৩৮ সাল পর্যন্ত তিনি এশিয়াটিক সোসাইটির সম্পাদক ছিলেন।

 

প্রিন্সেপ ঘাট খুব বেশি প্রাচীন নয়। কলকাতায় আরও অনেক প্রাচীন ঘাট আছে। ব্রিটিশ যুগে ঘাটটি নির্মিত হয় প্রাচীন ভারতের প্রসিদ্ধ নৃপতি সম্রাট অশোকের শিলালিপির পাঠোদ্ধারকারী প্রাচ্যবিদ জেমস প্রিন্সেপের স্মৃতিতে। ঘাটের নান্দনিক ও অতিকায় প্যালাডিয়ান পোর্চটির নকশা করেন ডব্লিউ ফিজগেরাল্ড। ঘাটটি নির্মিত হয় ১৮৪১ সালে। কলকাতা-হাওড়ার মধ্যে যোগাযোগকারী বিদ্যাসাগর সেতু এই ঘাটের ঠিক পাশেই তৈরি হয়েছে।

 

প্রিন্সেপ ঘাট ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের ওয়াটার গেট ও সেন্ট জর্জেস গেটের মাঝে অবস্থিত। ঔপনিবেশিক আমলের প্রথম দিকে প্রিন্সেপ ঘাটই ব্রিটিশদের সব যাত্রীবাহী জাহাজের যাত্রী ওঠানামার কাজে ব্যবহার করা হত।

 

প্রিন্সেপ ঘাট কলকাতার অন্যতম দর্শনীয় স্থানগুলোর একটি। সপ্তাহান্তে অনেক মানুষ এখানে বেড়াতে আসেন। অনেক প্রেমের না-বলা কথা লেখা আছে এই ঘাটের ইতিহাসের পাতায়।

 

ভোজনরসিকদের জন্যও আয়োজন আছে। নদীর গা ঘেঁষে রাস্তায় খাবারের দোকান রয়েছে। ঘাটের কাছে চল্লিশ বছরের পুরনো আইসক্রিম ও ফাস্ট ফুড বিক্রির একটি কেন্দ্র আছে। তরুণদের মধ্যে এই কেন্দ্রটি বেশ জনপ্রিয়। এখান থেকে অনেকে নদীতে নৌকায় প্রমোদভ্রমণে যান। তাঁদের হাত ধরাধরি করে যুগলপ্রেমের কাহিনি লেখা হয়েছে এই ঘাটের বুকে।

 

প্রিন্সেপ ঘাট থেকে বাজে কদমতলা ঘাট পর্যন্ত দুই কিলোমিটার পথ নদীতীর ধরে সুরম্যভাবে আলোকমালা, বাগান, প্রমোদপথ, ফোয়ারা দিয়ে সাজানো এবং এই অংশের ঘাটগুলোরও সংস্কার করা হয়েছে। বলিউডের 'পরিণীতা' ছবির একটি গানের দৃশ্য প্রিন্সেপ ঘাটে চিত্রায়িত হয়েছে। অনেক বাংলা ছবির রোমান্টিক দৃশ্যও এখানে গৃহীত হয়েছে।

 

১৭৭৩ সাল। ব্রিটিশ-শাসিত ভারতের রাজধানী তখন কলকাতা। এই শহরে স্থাপিত হল ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ‘গভর্নর জেনারেল সুপ্রিম কাউন্সিল’ ও ‘সুপ্রিম কোর্ট’। পরের বছর অক্টোবর মাসের ১৯ তারিখ বেলা ১২টা নাগাদ একটি ‘সাহেবি তরী’ এসে থামল গঙ্গার প্রিন্সেপ ঘাট ছাড়িয়ে একটু দক্ষিণের এক ঘাটে।

 

মনে করা যাক, ২৩৯ বছর আগের সেই দিনটি— একে একে নেমে আসছেন স্যর ফিলিপ ফ্রান্সিস, লেফটেন্যান্ট জেনারেল স্যর জন ক্লেভারিং ও কর্নেল মনসন এবং সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি স্যর এলিজা ইম্পে ও তিন সহকারী বিচারপতি জন হাইড, রবার্ট চেম্বার্স ও স্টিফেন সিজার লিমেস্টার। কলকাতার এই নদী ষঘাট স্থান পেল ইতিহাসের পাতায়। এরপর থেকে ভারতে যত বড়লাট, সেনাপতি, বিশপ, বিচারপতিরা এসেছেন, তাঁরা নেমেছেন এই ঘাটেই। আবার এখান থেকেই ফিরে গিয়েছেন জাহাজে করে নির্দিষ্ট গন্তব্যে।

 

সেই ‘সাহেবি তরী’ আজ আর নেই। হাল-টানা পাল তোলা নৌকাও আর আসে না এই ঘাটে। সাহেবি তরীর পাশাপাশি সার দিয়ে আসত মালবোঝাই নৌকোও। মাঝিরা হুঁকো টানতে টানতে খানিক জিরিয়ে নিতেন গাছের ছায়ায়— সে বট হোক বা পাকুড়। খিদের মুখে ঘাটের দোকান থেকে খাবার কিনে খেতেন। এমনই এক মুদির দোকানের মালিক ছিলেন চন্দ্রনাথ পাল। সেই নাম লোকমুখে চাঁদপাল হয়ে যায়। কথিত, তার নামেই হয় ঘাটের নামকরণ।

 

এক সময়ে এই ঘাট ছিল শহরের প্রধানতম জাহাজঘাটা। ইংরেজ আমলে রেলপথ চালু হওয়ার আগে অবধি যত প্রশাসনিক প্রধান বা ‘রাজপুরুষ’ কলকাতায় আসা-যাওয়া করতেন, তাঁরা এই ঘাটেই জাহাজ ভেড়াতেন। হাওড়া রেলস্টেশন চালু হওয়ার পর এই জাহাজঘাটার গুরুত্ব কমে যায়। এখন জাহাজ না এলেও, এই ঘাট থেকে নিয়মিত ফেরি সার্ভিস চলাচল করে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় যে, ১৭৭৪ সালের মানচিত্রে ‘চাঁদপাল ঘাট’-এর নামের উল্লেখ থাকলেও ১৭৫৬ সালে তা ছিল না।

 

প্রেমিক-যুগল এখানে ভিড় করেন ঠিকই, কিন্তু প্রিন্সেপ ঘাটে ক্যামেরা হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো লোকজন প্রচুর চোখে পড়বে আপনার। ইতিহাস এবং সৌন্দর্য প্রেমবন্দি করতে চান অনেকেই।

More Articles