রক্তাক্ত মুঘল ইতিহাসেও ভালবাসার ছোঁয়া! 'উড়ন্ত তারাদের ছায়া' দর্শককে মুড়ে রাখে মায়ায়
Theatre Review: কেমন হলো 'সংস্তব'-এর 'উড়ন্ত তারাদের ছায়া'?
কলকাতা শহরে এখন এক মায়ানাটক চলছে। মায়ার নাটক, মায়া ধরানো নাটক। চলতি প্রজন্মের লোকজন একটা শব্দবন্ধ খুব ব্যবহার করে, ‘হ্যাল খাওয়া’। সেই সূত্র ধরেই বলা যায়, এই নাটক দেখে দর্শক ‘হ্যাল’ খেতে বাধ্য। তা এত বিশেষণ কোন প্রযোজনার জন্য? কথা হচ্ছে, 'সংস্তব' নাট্যদলের নবতম প্রযোজনা ‘উড়ন্ত তারাদের ছায়া’ নিয়ে।
যদি নাটকের আখ্যান নিয়ে কথা বলি, তাহলে তা যে খুব মনকে উৎফুল্ল করার মতো, তা বলা যায় না। নাটক শুরু হয় নাদির শাহ্-এর ভারত আক্রমণ দিয়ে এবং শেষ হয় নাদির শাহ্-এর করুণ পরিণতি ও মৃত্যু দিয়ে। কিন্তু এই যাপন যে যাত্রাপথ অতিক্রম করে আসছে, তা যে-কোনও দর্শককে মুগ্ধ করতে বাধ্য।
এই নাটকের নায়ক কে? নাদির শাহ্? অবশ্যই না, বরং নায়ক বলা যায় নাদির শাহ্-এর মনের ওপর আধিপত্য করা মোগল সম্রাট মোহাম্মদ শাহ্-কে। এই মোহাম্মদ শাহ্ মোগল সাম্রাজ্যের তথাকথিত কুলাঙ্গার শাসক, যে সমরযন্ত্র পরিচালনার থেকে সংগীত ও নৃত্যসাধনায় বেশি মনোযোগী এবং যার জীবনটাই দাঁড়িয়ে আছে মানুষের ওপর বিশ্বাস করায় (রবীন্দ্রনাথ বা ঋত্বিক ঘটকের দর্শনের পূর্বসূত্র যেন)।
আরও পড়ুন: হিংসাই শেষ কথা নয়! স্বাধীনতার ইতিহাসকে অন্য চোখে দেখাবে ‘দিল্লি চলো’
এই মোহাম্মদ শাহ্-এর সংস্পর্শে এসে ভারতকে চিনছেন নাদির। বিষ আছে কি না, এই সন্দেহ ছেড়ে এক চুমুকে শেষ করছেন মোগল দরবারের সরবৎ। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যখন মোহাম্মদ প্রশ্ন করছেন,
মোহাম্মদ-আপনি এভাবে সরবৎটা খেলেন? ওতে যদি বিষ মেশানো থাকত?
নাদির- ইচ্ছে হলো, আপনাকে বিশ্বাস করতে।
মোহাম্মদ- তাহলে ভারতবর্ষ আপনাকে কী শেখাল?
নাদির- বিশ্বাস করতে! মানুষকে বিশ্বাস করতে শিখলাম ভারতবর্ষে এসে!
এই বিশ্বাস নাদির শিখছেন মোহাম্মদের কাছে, ভারতের কাছে।
তবে এই শিক্ষালাভের পর নাদিরের কী হলো? এই বিশ্বাসই কি নাদিরের জীবন গুলিয়ে দিল? নাদির শাহ্ অবিশ্বাসের বশে চোখ উপড়ে নিলেন নিজের ছেলে রেজা কোলি-র, আবার নিজের প্রাণ খোয়ালেন নিজেরই বিশ্বস্ত অনুচরের হাতে।
কী, বিশ্বাসের ধারণাটা ঘেঁটে গেল না?
গল্পের বিভিন্ন পরত নিয়ে কোনও তথাকথিত স্পয়লার দেব না, তবে এটাও সত্যি, যদি গোটা নাটকটাও এখানে টুকে দেওয়া হয়, পাঠক তা পড়লেও মাত্র ১ শতাংশ স্বাদ পাবেন, বাকি ৯৯ শতাংশ স্বাদ পেতে আপনাকে এই মায়ানাটক দেখতেই হবে।
বাংলা থিয়েটারের ক্ষেত্রে নাটককার ও নাট্যকার এক ব্যক্তি, এটা প্রায়শই দেখা যায়, তবে একজন ব্যক্তি, যিনি একসঙ্গে মঞ্চ, আলো, আবহ, নাটক ও নির্দেশনা প্রদান করছেন, এটি বিরলতম। দেবাশিস রায় এমনই একজন ব্যক্তি, যিনি এই প্রতিটা দিক কেবল সামলেছেন নয়, কাজটিকে এমন একটি মাত্রায় নিয়ে গেছেন যে, একজন দর্শক নিজের জীবৎকালে চেষ্টা করলেও প্রযোজনাটিকে কোনও দিন ভুলে যেতে পারবেন না।
যদি প্রতিটি বিভাগ ধরে ধরে কথা বলি, সংগীত বিভাগে সরোদ, ব্যাঞ্জ, ডারবোকা, ম্যান্ডোলিন ও কণ্ঠসংগীত সহযোগে যে মায়া রচনা করেছেন নির্দেশক, তা যে না শুনেছে- তাকে বোঝানো অসম্ভব (অনেকটা সেই বারাণসীর গলির বর্ণনার মতো)। যে-ক'টা গান ব্যবহার হয়েছে, প্রতিটাই অনবদ্য, তবে মোহাম্মদ শাহের গলায় ‘আল্লা আল্লা কা মাজা’ গানটি আজ নাটক দেখার এতদিন পরেও কানে বাজছে। মঞ্চ পরিকল্পনায় গোটা স্টেজটিকে বিভিন্ন খোপ বা প্যানেলে ভাগ করা আর নেট ও দড়ির ব্যবহার নজরকাড়া।
এবার আসা যাক আলোর কথায়। আমার মতে, বাংলা নাটকের একটা প্রধান শত্রু এলইডি পার নামক কিম্ভূত পদার্থটি। একটি আলো কী করে বিয়েবাড়ির গেট, ভাসানের গাড়ি থেকে আরম্ভ করে সব বড় দলের নাট্যপ্রযোজনায় ঠাঁই পায়, আমার মাথায় ঢোকে না। কিন্তু বহুদিন পর ‘উড়ন্ত তারাদের ছায়া’-য় ধ্রুপদী পদ্ধতিতে কেবল জেলপেপার ব্যবহার করে মঞ্চ-ক্যানভাসে এরকম রঙের পোঁচ অবাক করেছে, চমকে দিয়েছে। এর সঙ্গে অবশ্যই বলতে হবে, অডিটোরিয়ামের ছাদে লেজারের ব্যবহার করে তারাদের খেলা দেখানোর ঘটনাটিও।
গোটা নাটকে বহু বহু মনে রাখার মতো আবেগপ্রবণ মুহূর্ত সৃষ্টি হয়েছে, তবে দু'টি দৃশ্যের কথা ব্যক্তিগতভাবে বলতে ইচ্ছা করছে।
প্রথমটি নাটকের ওপেনিং সিন, যেখানে কিলা-এ-মুবারকের ছাদে উঠে মোহাম্মদ শাহ্ ও উবাইদুল্লা বিনিদ্র রজনী যাপন করছেন ও তারাদের খেলা দেখছেন। একটি নাটক এতটা নিস্তব্ধতা দিয়ে শুরু হতে পারে, এটা যে নির্দেশক ভেবেছেন, এর জন্যই ওঁকে কুর্নিশ জানাতে হয়।
দ্বিতীয় যে মুহূর্তটির কথা না বললেই নয়, সেটি হলো বিরতির ঠিক আগের দৃশ্যে, যেটিতে মোহাম্মদ শাহ্-কে নাদির শাহ্ জড়িয়ে ধরেন ও চারদিক থেকে সহচরিত্ররা প্রদীপ নিয়ে এগিয়ে আসে। একটু আবেগপ্রবণ দর্শক হলে এই দৃশ্যে কেঁদে ফেলতে বাধ্য।
অভিনয়ের কথা যদি বলি, নাদির শাহ্-এর চরিত্রে সঞ্জীব সরকার... সত্যি বলতে, এরপর কী বিশেষণ দেব ভেবে পাচ্ছি না, একটা কথাই কেবল বলার, নিজেকে মাঝে মাঝে ভাগ্যবান মনে হয় মঞ্চে সঞ্জীব সরকারের মতো অভিনেতাকে দেখতে পাচ্ছি। মোহাম্মদের চরিত্রে তথাগত চৌধুরী নিজের অভিনয়ে ও গানের গলায় দর্শকদের বারবার তাক লাগান। এছাড়াও অভিনেতাদের মধ্যে সুস্নাত, অমৃতা, কঙ্কাবতী, সায়ন্তন প্রত্যেকেই স্ব স্ব চরিত্রে খুব বিশ্বাসযোগ্যভাবে ছাপ রেখে গিয়েছেন।
'সংস্তব'-কে বাংলা নাট্যসমাজ চিনত দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল হিসেবেই। দ্বিজেনবাবুর চলে যাওয়ার প্রায় ৫ বছর পর সংস্তব এরকম একটা নাট্যপ্রযোজনা আমাদের উপহার দিলেন দেখে এই চরম অন্ধকার সমাজের মধ্যে দাঁড়িয়ে একটা কথাই বলতে ইচ্ছা হয়, এই সময়, এই অতিমারী-উত্তর কালেও সব শেষ হয়ে যায়নি! শত প্রতিকূলতার পরও, মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ!
নাটকে অনেক মনে রাখার মতো সংলাপও আছে, তবে যে সংলাপটি আমার ব্যক্তিগতভাবে সবথেকে প্ৰিয়, তা দিয়েই লেখা শেষ করি।
-জীবন, আজকাল জীবন কেমন লাগে আপনার মুহাম্মদ?
-ভালবাসার মতো করুণ।
-আর মৃত্যু আপনার কেমন লাগছে নাদির?
-ঘেন্নার মতো উজ্জ্বল।