বারবার হত্যার পরিকল্পনা || কারা ছিল গান্ধী-নিধনের নেপথ্যে?

সালটা ১৯৪৮। দীর্ঘ সময় ব্রিটিশদের পদানত থাকার পর ভারতের স্বাধীনতার সূর্য তার নিজস্ব দীপ্তিতে বিরাজমান। সেদিন দিল্লির বিড়লা হাউজে বয়ে গেছে জনস্রোত। বক্তব্য রাখছেন স্বয়ং গান্ধীজি। ভারতের স্বাধীনতা তাঁকে তৃপ্তি দিলেও রক্তক্ষয়ী দেশভাগ তাঁর আত্মাকেও দ্বিখণ্ডিত করেছে। জাতির জনকের সেই বক্তৃতা শুনতে জনতার ঢল নামবে, সে তো স্বাভাবিক!

হঠাৎ একটা গুলির শব্দ, মঞ্চের ওপর শীর্ণকায় মানুষটি লুটিয়ে পড়লেন, সমবেত জনতা হতচকিত। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন স্বয়ং গান্ধীজি।

তার কিছুক্ষণের মধ্যে জওহরলাল নেহরুর ঘোষণা–  "আমাদের জীবন থেকে আলো চলে গেছে।" গান্ধীজির মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সমাপ্তি ঘোষণা হল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি অধ্যায়ের। তবে ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারির আগেও বহুবার গান্ধীজিকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছে। প্রায় সব ক্ষেত্রেই এই পরিকল্পনার মূলে ছিল হিন্দু মহাসভা ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ। ক্ষেত্রবিশেষে ব্রিটিশ সরকারের হস্তক্ষেপও ছিল তাতে।

আরও পড়ুন: রামনবমী ঘিরে দাঙ্গা পরিস্থিতি, ভারতের ইতিহাসে সাম্প্রদায়িক সংঘাত ফিরে ফিরে এসেছে

১৯১৭ সালের ১৫ এপ্রিল। বিহারের মতিহার রেলস্টেশনেও সেদিন ছিল দিল্লির বিড়লা হাউজের মতোই জনসমুদ্র। পরের ট্রেনেই আসছেন এক অবিসংবাদিত স্বাধীনতা সংগ্রামী– মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। বিহারে তখন জমিদারদের অত্যাচার ঊর্ধ্বমুখী। স্থানীয় চাষিদের নীল চাষে বাধ্য করাচ্ছে জমিদাররা।

খবর পৌঁছল গান্ধীজির কানে। রাজেন্দ্র প্রসাদকে সঙ্গে নিয়ে মহাত্মা পৌঁছলেন বিহারের মতিহার স্টেশনে। সারাদিন চাষিদের অভাব–অভিযোগের বিস্তারিত বর্ণনা শুনে ক্লান্ত গান্ধীজি রাত্রিবাসের জন্য গেলেন স্থানীয় ইংরেজ অধিকর্তা আরউইনের বাড়ি। সেখানেই গান্ধীজির জন্য নিঃশব্দে অপেক্ষা করছিল মৃত্যুফাঁদ। ভারত-বিদ্বেষী আরউইন রাঁধুনি বটুক মিঞাকে নির্দেশ দেন গান্ধীজির দুধে বিষ মেশানোর জন্য, যাতে তা খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু হয় গান্ধীজির। কিন্তু দেশপ্রেমী বটুক মিঞা তা পারেননি। দুধে বিষ মেশালেও গোপনে আগেভাগে মহত্মাকে সমগ্র পরিকল্পনাটি জানিয়ে দেন তিনি। তবে এর পরিণাম ভাল হয়নি, বটুক মিঞাকে হাজতে পাঠান আরউইন, ভেঙে দেওয়া হয় তাঁর বাড়িও।

এরপর ১৯৩৪ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত বারবার আক্রমণ নেমে এসেছে গান্ধীজির ওপর। শেষ কয়েকটি আক্রমণের নেপথ্যে ছিল নাথুরাম গডসের মাথা। ১৯৪৮ সালে অবশেষে সফল হল এই দীর্ঘ চক্রান্ত, দেশ হারাল প্রিয় 'বাপু'-কে।

তবে গান্ধীজির মতো দেশ নায়কের ব্যক্তিগত জীবন বা যৌনজীবন নিয়েও কিন্তু কম কাটাছেঁড়া হয়নি। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু গান্ধীজির যৌনজীবনকে ‘অস্বাভাবিক ও অপ্রাকৃতিক’ বলে উল্লেখ করেন, যা নিয়ে পরবর্তীকালে বিতর্ক দানা বাঁধে। তবে জনশ্রুতি অনুযায়ী, কস্তুরবার সঙ্গে বিবাহের পর গান্ধীজি যখন তাঁর সঙ্গে মিলনে ব্যস্ত, সেই সময় তার বাবার মৃত্যু হয়। এবং তার পরই গান্ধীজি সিদ্ধান্ত নেন তিনি সম্পূর্ণ কৌমার্যব্রত পালনের মধ্যে দিয়ে তার জীবন অতিবাহিত করবেন।

একসময় গান্ধীজির স্ত্রী কস্তুরবার মৃত্যু হয়, এই সময় থেকেই মৃদুলা নামক এক মহিলা থেকে যান গান্ধীজির সঙ্গে। তবে মৃদুলা নিজেই তার দিনপঞ্জিতে লিখেছেন– গান্ধীজির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল অনেকটা মা–মেয়ের মতো। গান্ধীজি তাঁর পড়াশোনা, খাওয়াদাওয়া- সমস্ত ব্যাপারে একজন সার্থক মায়ের মতোই খোঁজ রাখতেন। এমনকী, মায়ের সঙ্গে মেয়ে যেমন ঘুমোয়, গান্ধীজির সঙ্গে তিনিও সেভাবেই ঘুমোতেন। এমনকী, কোনওরকম লজ্জা ছাড়া গান্ধীজিকে ম্যাসাজ করে দিতেন মৃদুলা। এতটাই সহজ ছিল তাঁদের সম্পর্ক।

তবে গান্ধীজির কৌমার্য ব্রত পালনের সঙ্গী হওয়ার জন্য একসময় তীব্র প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয় মহিলামহল। ১৯৪৭ সালের ২৪ ফ্রেব্রুয়ারি মৃদুলা তাঁর ডায়েরিতে লেখেন– “আজ বাপু আমাতুসসালামকে খুব শক্ত ভাষায় এক চিঠি লিখে জানিয়েছেন, কৌমার্যচর্চার অংশ হতে না পেরে আমাতুসসালামের যে অনুতাপ হচ্ছে, তা তার চিঠি থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।”

তবে গান্ধীজির এই জীবনযাপন নিয়ে দলের মধ্যেও মতবিরোধ তুঙ্গে ওঠে। কিশোরীলাল এক চিঠিতে মৃদুলাকে ‘মায়াবী নারী’ বলে উল্লেখ করেন, গান্ধীজির জীবন স্বয়ং বল্লভভাই প্যাটেলেরও প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। প্যাটেল জানান, এই জীবনযাপনের খবর দলের কর্মী বা অন্যদের সামনে উন্মোচিত হয়ে পড়লে ‘কেলেঙ্কারি’ হয়ে যাবে। তবে সমস্ত বিতর্কের পরেও গান্ধীজি অবিচল ছিলেন।

দেশের জন্য ‘জাতির পিতা’-র চরম আত্মত্যাগের পরেও ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু গান্ধীজির ব্যক্তিগত জীবন বা যৌনজীবনকে যেভাবে নিশানা করেছেন তা চরম দুর্ভাগ্যজনক বলে মনে করেছিলেন অনেকে। এমনকী, একইভাবে অভিযোগের আঙুল উঠেছিল বল্লভভাই প্যাটেলের দিকে। তবে, গান্ধী-হত্যা পীড়া দিয়েছিল নেহরু-প্যাটেল উভয়কেই। 

More Articles