১০৮টি মন্দিরে অবস্থান করতেন শিব, এই জমিদারিতে রয়েছে অজস্র কিংবদন্তি

রাজবংশের সেই চাকচিক্য, সেই জাঁকজমক, সেই জৌলুস নেই, কিন্তু পুজোপাঠ এবং মৌলিক্ষা মায়ের সেবা এখনও বংশপরম্পরায় রায়বংশ করে চলেছে।

মুহুলটি। অনেকেই বলেন মুহুটি, অর্থাৎ মহুল গাছের জঙ্গল। কথ্যভাষায় নাম মলুটি। টেরাকোটা গ্রাম নামে বিখ্যাত। মা মৌলিক্ষার মন্দির এখানে অবস্থান করছে। মা মৌলিক্ষাকে বলা হয় তারাপীঠের তারামায়ের বোন। মালুটি গ্রাম বামদেবের সাধনপীঠ। প্রাচীন ময়ূরেশ্বরের অধীনে বীরভূমের এই অঞ্চল আজ ঝাড়খণ্ডে। রামপুরহাট বা মল্লারপুর থেকে দুমকা যাওয়ার রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতে হয়। পথে পড়ে চন্দন নালা নদী, একটু দূরে 'চুমড়ে' নামে আরেকটি ক্ষীণস্রোতা নদী আছে।

আনুমানিক ১৮৫৭ সালে সাধক বামাক্ষ্যাপা এখানে আসেন এবং সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেন।একসময় তারাপীঠ মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণের ভার ছিল নাটোরের রানির তত্ত্বাবধানে। জনশ্রুতি শোনা যায়, সেই সময় ঝাড়খণ্ডের তৎকালীন রাজা দ্বারকা নদী পেরিয়ে তারাপীঠ মায়ের দর্শন এবং পূজো দেওয়ার অভিলাষ নিয়ে মন্দিরে আসেন। কিন্তু মন্দিরের সেবায়েত এবং কর্মচারীরা মহারাজাকে অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখেন, এক সময় মহারাজা দেবীদর্শন না করেই ফিরে যান। শেষ পর্যন্ত মনোবাঞ্ছা পূরণ করার উদ্দেশ্যে মালুটি গ্রামে মৌলিক্ষা দেবীর মন্দিরে দেবীর ঘট প্রতিষ্ঠা করে তিনি পুজো শুরু করেন। এদিকে তারাপীঠে তারা মায়ের পুজোয় নানা বাধা আসতে থাকে। নাটোরের রানি তখন স্বয়ং তারামায়ের কাছ থেকে স্বপ্নাদেশ পান, তিনি জানতে পারেন এখনও তারাপীঠে তারা মায়ের পুজো হয়নি। তৎক্ষণাৎ তিনি কর্মচারীদের কাছে এর কারণ জানতে চান। তখন রানি জানতে পারেন, ঝাড়খণ্ডের মহারাজা দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে পুজো না দিয়েই ফিরে গিয়েছেন। তৎক্ষণাৎ তিনি লোকজন পাঠিয়ে মহারাজাকে আনার ব্যবস্থা করেন এবং তাঁর অনুরোধে ঝাড়খণ্ডের মহারাজা তারাপীঠে তারা মায়ের পুজো করেন।

আজ থেকে প্রায় পাঁচশো বছর আগে বসন্ত রায় ছিলেন বীরভূম জেলার ময়ূরেশ্বরের কাছাকাছি কাটিগ্রামের এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান। শৈশবেই তিনি পিতৃহীন হন। লোকের গরু-বাছুর চরিয়ে তিনি ও তাঁর মা দিনাতিপাত করতেন। জনশ্রুতি শোনা যায়, একদিন মাঠে গরু চরাতে গিয়ে গাছের ছায়ায় বিশ্রাম করছেন। বসে থাকতে থাকতে একসময় তিনি ঘুমিয়ে পড়েন, এবং বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মুখে রোদের আলো এসে পড়ে। সেইসময় কাশীর সুমেরু মঠের মোহান্ত দণ্ডীস্বামী নিগমানন্দ মহারাজ সেই পথে যাচ্ছিলেন। তিনি দেখতে পান, একটি বড় বিষধর সর্প ফণা তুলে ঘুমন্ত একটি কিশোরের মুখে রোদ আড়াল করে রেখেছে। এই অলৌকিক ঘটনা দেখে তিনি অবাক হয়ে যান, কিশোরটির দিকে তিনি এগিয়ে যেতেই সাপটি ফণা নামিয়ে লুকিয়ে পড়ে। তখন তিনি কিশোরটিকে জাগিয়ে তার পরিচয় জানতে চান এবং তাকে সঙ্গে করে নিয়ে তার মায়ের কাছে গিয়ে বলেন, অতি শীঘ্রই বসন্ত রাজ্য লাভ করবে। নিগমানন্দ মহারাজ বসন্তকে সিংহবাহিনী মন্ত্রে দীক্ষা দেন।

আরও পড়ুন: দশটি গ্রাম নিয়ে জমিদারি! হুগলির এই জায়গায় ইতিহাস এখনও কথা বলে

এই ঘটনার কয়েক দিনের মধ্যেই গৌড়ের বাদশা হোসেন শাহ উৎকল দেশ থেকে ফেরার পথে বিশ্রামের জন্য কাটিগ্রাম থেকে কিছু দূরে ময়ূরাক্ষীর ধারে তাঁবু ফেললেন। হঠাৎ একদিন তাঁর বেগম সাহেবার অতি প্রিয় পোষা বাজপাখিটি সোনার শিকল কেটে পালিয়ে যায়। বাজপাখির নাকে হিরে বসানো সোনার নোলক, পায়ে সোনার শিকল। পাখির শোকে মৃতপ্রায় বেগম সাহেবাকে দেখে সম্রাট ঘোষণা করেন, যে ব্যক্তি পাখি ধরে এনে দিতে পারবে, সে যা চাইবে তিনি তাই-ই দেবেন। এদিকে বসন্তর পাতা ফাঁদে বাজপাখি আটক হলো। পাখিকে নিয়ে বসন্ত মহারাজা দরবারে উপস্থিত হলে মহারাজা যারপরনাই প্রীত হলেন। তিনি হুকুম দিলেন পরদিন সূর্যোদয় থেকে শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত কিশোর বসন্ত ঘোড়ায় চেপে যতটা ঘুরতে পারবে, সবটাই সে পাবে 'নানকার' অর্থাৎ করহীন জমিদারি হিসেবে। এইভাবেই বসন্ত হলেন নানকার রাজ্যের রাজা এবং বাজপাখি ধরে দেওয়ার সুবাদে তার নাম হলো 'বাজ বসন্ত'।

এই বসন্ত রায়ের পরিবারের পরবর্তী প্রজন্ম মালুটিতে তাঁদের রাজধানী স্থাপন করেন। এই বংশের প্রত্যেক রাজা ছিলেন শিবের ভক্ত। একশো বছর ধরে প্রত্যেক রাজা রাজবাড়ি তৈরির দিকে নজর না দিয়ে শুধু মন্দির তৈরি করে গিয়েছেন। দীর্ঘ শতাধিক বছর ধরে এখানে একে একে তৈরি হয় বিভিন্ন মন্দির। তার মধ্যে ১০৮টি মন্দির বিখ্যাত। এই ১০৮টি মন্দির কিন্তু বর্ধমান অথবা পূর্ব বর্ধমান জেলার কালনার ১০৮ মন্দিরের আদলে তৈরি নয়। এই মন্দিরগুলি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। ১০৮টি মন্দির রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সবই প্রায় নষ্ট হতে বসেছে। এখন প্রায় সর্বসাকুল্যে ৭২টি মন্দির দাঁড়িয়ে আছে। সবগুলিতেই 'ভোলানাথ' অধিষ্ঠান করছেন। মন্দিরগুলির অত্যন্ত জীর্ণদশা সত্বেও বোঝা যায়, অপরূপ শিল্পসুষমা দিয়ে তৈরি হয়েছিল এই মন্দিরগুলি। টেরাকোটার কাজ এবং পৌরাণিক হস্তশিল্পের অপূর্ব সমাহার দেখা যায়। মন্দিরগুলির প্রবেশদ্বারের মাথায় এবং দরজার খিলানের ওপরের অংশে সংস্কৃত অথবা প্রাকৃত ভাষায় মন্দিরের প্রতিষ্ঠালিপি সুন্দরভাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে। এছাড়া মন্দিরগুলির প্রবেশদ্বারের মাথার ওপর মূল প্যানেলে রাম-রাবণের যুদ্ধের প্রাধান্য দেখা যায়। তবে রাজবাড়ি-সংলগ্ন মন্দিরে কেবলমাত্র মহিষাসুরমর্দিনী চিত্রিত আছে।

মন্দিরের গায়ে টেরাকোটার কাজ অধিকাংশই চুরি হয়ে গেছে। তবু পোড়ামাটির মন্দিরগুলি অধিকাংশই জীবন্ত লাগে। কিছু মন্দির রয়েছে বিগ্রহহীন অবস্থায়। মালুটি গ্রামে কালীপুজো প্রাধান্য পায় বেশি। এখানে প্রায় শতাধিক কালীপুজো হয়। এছাড়া ঘরে ঘরে কালীপুজোর চলও আছে। গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে গ্রামের অধিষ্ঠাত্রী দেবী মৌলিক্ষা মায়ের মন্দির। মৌলিক্ষা কথাটিকে যদি ব্যাখ্যা করা হয়, তাহলে দেখা যাবে, মৌলিক্ষা কথাটির অর্থ: 'মৌলি' অর্থাৎ 'মাথা' এবং 'ঈক্ষা' কথাটির অর্থ 'দেখা' বা দৃশ্যমান। গর্ভগৃহে ত্রিনয়নী মায়ের পাথরের তৈরি শুধু মাথা দেখা যায়। ঠিক যেন তারাপীঠের তারা মা। জনশ্রুতি, বামাক্ষ্যাপা প্রথম জীবনে মালুটির জমিদারের মন্দিরে ফুল তোলা ও ভোগ রান্নার কাজ করতেন। কিন্তু কাজে মন না থাকায় মন্দির কর্তৃপক্ষ তাঁকে কাজ থেকে বরখাস্ত করেছিলেন। পরে তিনি আবারও আসেন মৌলিক্ষা মায়ের টানে। তিনি প্রথমে মৌলিক্ষা মায়ের মন্দিরে সিদ্ধিলাভ করেন এবং পরে তারাপীঠ শ্মশানে গিয়ে সিদ্ধিলাভ করেন। মৌলিক্ষা মাকে তারাপীঠের তারা মায়ের বড় বোন বলে মনে করেন গ্রামের লোক। মৌলিক্ষা মায়ের মন্দিরের কাছাকাছি বামাক্ষ্যাপার একটি মন্দির আছে এবং এই মন্দিরে বামাক্ষ্যাপার একটি পাথরের তৈরি মূর্তি রাখা আছে। মূর্তির পাশে রাখা একটি ত্রিশূল। বামাক্ষ্যাপা ওই ত্রিশূল দিয়েই নাকি ফুল পারতেন। ত্রিশূলের পাশে রাখা আছে কালীমায়ের একটি সুন্দর শিলামূর্তি। মৌলিক্ষা মায়ের মন্দিরের সামনেই আছে একটি যজ্ঞকুণ্ড। সেই যজ্ঞকুণ্ডটি হঠাৎ হঠাৎ জ্বলে ওঠে। বর্তমানে বাজ বসন্ত রায়ের বংশধর অমরনাথ রায়। রাজবংশের সেই চাকচিক্য, সেই জাঁকজমক, সেই জৌলুস নেই, কিন্তু পুজোপাঠ এবং মৌলিক্ষা মায়ের সেবা এখনও বংশপরম্পরায় রায়বংশ করে চলেছে। বামাক্ষ্যাপার সাধনপীঠ মৌলিক্ষা মায়ের মন্দির আজও জাজ্জ্বল্যমান।

 

More Articles