সুইসাইড নোটেও জীবনের কথাই লিখেছিলেন এই কবি

মিলান শহরের অদূরে শিয়ারাভেল অ্যাবি। বরফের উপর শুয়ে থাকা এক মহিলার অবয়ব, সদ্য নামা ডিসেম্বরের সন্ধ্যায় পথচারীদের অস্বস্তিতে ফেলছে বারবার। বারবিচুরেট ড্রাগের প্রভাবে তখন মহিলার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে অনন্ত হিম। অতীতের দখলদারিতে পৌঁছতে পৌঁছতে তবু ৩রা ডিসেম্বর হয়ে গিয়েছিল। তাঁর মৃত্যুর পর কোটের পকেট থেকে পাওয়া, বন্ধু ভিত্তোরিও সেরেনির ‘Diana’ কবিতাটির শেষাংশে লেখা ছিল -“And the song you had in the evening/ returns to ache within here, / breathes on the memory/ to reprove you for dying.”
বিগত দশকে ইতালীয় কবিতার জগতে এক বিস্ময়ের মতো বারবার উঠে এসেছে আন্তোনিয়ার নাম। আন্তোনিয়া পোসসি। যাঁর মৃত্যুদৃশ্যকে ধারণ করে আছে উপরের অনুচ্ছেদটি। মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সে আত্মহত্যাকারী এই কবির বেঁচে থাকার দিনগুলিতে, তাঁর কোনও কবিতাই প্রকাশের মুখ দেখেনি। তাঁর কবিতার পাঠক ছিল মূলত আলপাইন পর্বতমালার, গ্রিগনা পাহাড়ের কোলে অলস শুয়ে থাকা পাস্তুরো গ্রামের ঝোরাগুলি, পাহাড়ি বাঁকের মুখে ফুটে ওঠা নামহীন ফুলেরা, ছেলেবেলার বন্ধু ইয়ুলিও য়াদেন কিংবা বন্ধুত্ব ছাপিয়ে ক্রমে ভাই হয়ে ওঠা ভিত্তোরিও সেরেনি।
আইনজীবি রবার্তো পোসসি চেয়েছিলেন মেয়ের জীবনকে নিজের শর্তে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে। মেয়ের সঙ্গে তার থেকে প্রায় চোদ্দ বছরের বড়ো শিক্ষক তথা বন্ধু আন্তোনিয়ো মারিয়া সার্ভি-র প্রেমের সম্পর্ককে তাই বাবা হিসাবে কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি রবার্তো। মিলান থেকে বারবার দূরে সরিয়ে সুদূর পাস্তুরো গ্রামে থাকতে পাঠিয়েছেন মেয়েকে। কিন্তু সেই পাস্তুরো গ্রাম, আলপাইন পর্বতের উপত্যকা, ছায়াচ্ছন্ন ঝোরা, ফসলের খেতে কাজ করতে আসা মেয়েদের দল আর তার প্রিয়তম আন্তোনেল্লো কীভাবে তার মেয়ের লেখায়, ডায়রিতে ক্রমেই ঢুকে পড়েছে, তার হদিশ পেতে রবার্তোকে অপেক্ষা করতে হয়েছে মেয়ের মৃত্য অবধি। আর তারপর কঠিন হাতে বাবার ভূমিকায় মঞ্চে নেমেছেন রবার্তো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে, কড়া হাতের কলম চালিয়ে মেয়ের লেখা থেকে মুছে দিয়েছেন আন্তোনিয়ো সার্ভি সহ এমন যে কোনও প্রসঙ্গ, যা পোসসি পরিবারের নামের গায়ে সামান্যতম ধুলো ছুঁড়ে দিতে পারে! কাটাছেঁড়া করা সেইসব কবিতা ‘Parole’ নামে প্রকাশ করলেও, তবু শেষরক্ষা হয়নি। পরবর্তীকালে ইয়ুজিনিও মোতেল, ভিত্তোরিও সেনেরি, গ্রাজিয়েলা বার্নাবো সহ অনুবাদক পিটার রবিনসনের তৎপরতায় শেষমেষ প্রকাশ পায় আন্তোনিয়ার মূল কবিতা, ডায়রি ও চিঠিগুলি।
“Oh, make me worthy of you, /Poetry, watching over me.”–তাঁর ‘Prayer to Poetry’ কবিতায় লিখেছিলেন আন্তোনিয়া। আর এই কবিতাকে সঙ্গী করেই আন্তোনিয়া গড়ে তুলেছিলেন তাঁর নিজস্ব পৃথিবী, যেখানে প্রকৃতির প্রাণময়তার সঙ্গে অনায়াস মিশে যেত তাঁর একাকিত্ব। জন্মাতে না পারা শব্দের কান্নাদের, সূর্যের স্বপ্নের দিকে ভেসে যাওয়া দেখতে দেখতে, ঢুকে পড়তেন চিরন্তন এক রাত্রির দরজা ঠেলে। অজাত শব্দেরা তাঁর আত্মার কাছে মুক্তির করুণ আর্তিসহ হাজির হত, যাদের শাসন না করতে পারার যন্ত্রণায় ফেটে পড়তেন আন্তোনিয়া।
একদিকে যেমন শব্দের নিজস্ব সত্তা গড়ে দেবার আনন্দকে ধারণ করত তাঁর কবিতা, তেমনই অন্যদিকে তার কবিতায় ফিরে ফিরে আসত পাহাড়ী গ্রামের কথা, উপত্যকার বুকে ফুটে থাকা অনামা ও বিখ্যাত সব ফুলের কথা, ঝরনা, জল আর ছায়া্র কথা, হাওয়া আর রোদের কাটাকুটি খেলার কথা, ফসলকুড়ানি মায়ের ছেলে কাঁখে হাস্যমুখ দাঁড়িয়ে থাকার কথা, দূর সমুদ্রের অন্ধকারে একলা এক তারার জেগে থাকার কথা, তুষারপাতের শহরে সন্ধ্যায় ফুল বিক্রেতা কিশোরী মেয়েটার কথা, হেমন্তের নক্ষত্রমালার কথা, অন্ধকার ও সীমাহীন রাতের কথা, বিষণ্ণতা ও একাকিত্বের কথা, তাঁর নিজস্ব পৃথিবী এবং ভালোবাসার কথা।
আন্তোনিয়া এক দ্বিধাগ্রস্ত সময়ের নারী এবং সেইসঙ্গে কবি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইতালির প্রায় ভেঙে পড়া সামাজিক পরিকাঠামোয় দাঁড়িয়ে, ব্যক্তিগত জীবনে অভাব কাকে বলে তিনি দেখেননি। অথচ সেই তিনিই, পাস্তুরো গ্রামে গিয়ে দেখছেন এমন এক মাকে, যার কাছে ফুটন্ত গরমজলের পাত্রে পড়ে যাওয়া সন্তানের অন্তিম সংস্কারে যাওয়ার জন্য সময় নেই। কেননা কৃষকরমণীর জীবনে সন্তানশোক তৎকালীন ইতালীতে এক বিলাসিতা। সমাজের উপরতলার শ্রেণির মানুষ হয়ে শুধুমাত্র বিলাস নয়, জীবনের রক্তাক্ত, আহত দিকটিকেও আন্তোনিয়া সমানুভূতির সঙ্গে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। লিখেছিলেন- “Sisters, don’t you mind that/ I follow/ your path again tonight? … The silence against your heart/ like the deepest life/ just by listening to yours, souls to go.”। এক যুদ্ধ থেকে সদ্য উঠে আরেক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়া ইতালির অভাবদীর্ণ অবস্থা, নারীদের চাহিদার উত্তরে পাওয়া উপেক্ষা, অসুখের দিন আর মৃত্যুর পাশাপাশি এক চিরন্তন ভালোবাসার জন্য অপেক্ষার কথা তাই তাঁর কবিতার স্থায়ী অনুষঙ্গ।
ভিত্তোরিও সেনেরির সঙ্গে চিঠির আলাপচারিতায় এক জায়গায় আন্তোনিয়া আক্ষেপ করেন যে, নিজস্ব যে কামনা তাঁকে নিয়ত বিহ্বল করে, তাঁর প্রিয় লেখক ফ্লবেয়ার কিংবা টমাস মানের মতো তিনি তাকে শব্দে প্রকাশের পথ খুঁজে পান না। প্রতি মুহূর্তে ভয় পান, তাঁর লেখা শুধুমাত্র লেখা হিসাবে নয়, সমালোচিত হবে নারীর লেখা হিসাবে। প্রতি মুহূর্তে ‘good Antonia’ হয়ে থাকতে গিয়ে নিজস্ব কবিতার প্রতি তাঁকে কড়া শাসকের ভূমিকা পালন করতে হয়। ডায়রিতে যেন বাধ্যতই লেখেন, “It is terrible to be a woman and to be 17 years old”। তাই দেখা যায়, আন্তোনিয়ো সার্ভি বা ইয়ুলিও য়াদেন বা ভিত্তোরিও সেনেরিকে লেখা চিঠিতে বা তাঁর ডায়রির পাতায় তিনি যতটা সাবলীল, সৎ ও দ্বিধাহীন, তাঁর কবিতা যেন ততটাই উপমা, রূপকের মোড়কে সালঙ্কারা। কবিতায় সেই এক ‘Ultrahuman’ হয়ে উঠতে চেয়ে তিনি বিশ্বাস করতেন “I live from poetry as veins live from blood”।
আন্তোনেল্লোর প্রতি আন্তোনিয়ার প্রেম তাঁকে পৃথিবীর খুঁটিনাটি সম্পর্কে আরও মনোযোগী করে তুলেছিল। শুধুমাত্র দেহজ রূপের মোহে নয়, জ্ঞান, মেধা ও বৌদ্ধিক সূক্ষ্মতায় সার্ভি, আন্তোনিয়ার কাছে ছিলেন “A great flame yearning for ever greater purity, unfortunately destined to dry up alone…”। আন্তোনিয়ার বাবার হস্তক্ষেপে তাঁদের মধ্যে স্থানিক দূরত্ব ঘনালেও, একে অপরের থেকে তাঁদের মানসিক দূরত্ব একচুলও বাড়েনি। ১৯৩০ সালের ১৩ই এপ্রিল এক চিঠিতে আন্তোনিয়া, সার্ভিকে লেখেন যে, আশংকা, দ্বিধা ও যন্ত্রণার মুহূর্তেরা তাঁকে মৃত্যুর কথা বলে, তবু তিনি সার্ভিকে উদ্দেশ্য করেই জোর গলায় বলতে পারেন “With the light, you too have returned, ... Antonello, next to you I build my real life; next to you is the sanctity of my existence.”। আন্তোনিয়ার মৃত্যুর বেশ কিছু বছর পর সার্ভি নিজেও আত্মহত্যা করেন।
এমন এক চূড়ান্ত প্রেমের থেকে অপ্রাপ্তির দূরত্বে থেকেও আন্তোনিয়া যেভাবে পৃথিবীর আলো-জল-হাওয়া সহ সমস্ত উপাদানকে প্রাণ ভরে ভালোবাসতেন, তা হয়তো তাঁর এক অপার সহানুভূতিশীল মননের জন্যই সম্ভব হয়েছিল। জীবনের থেকে বেশি কিছু দাবী নয়, নভেম্বরের তুষারপাতের শহরে তিনি আশা করেছিলেন – “Someone will cry/ who knows where-who knows where-/ someone will search out chrysanthemums / for me/ in the world/ when it happens that without return/ I’ll have to go away.”।
তাঁর মৃত্যুর পর ভিত্তোরিও সেরেনি 3rd December কবিতায় লিখেছিলেন – “You die a little every year/ on this particular day.”। কিন্তু এমন হতাশার বোধ থেকে সরে এসে ভবিষ্যতের পাঠকেরাই তাঁর কবিতাতেই তাঁকে আপন করে নিতে পারেন, যার পাশে বসে আন্তোনিয়া আপনমনে হেসে উঠে বলবেন- “…You whose sweet tears/ ran deep in the eyes/ if they looked up-/ and so I seemed more beautiful to you.”।

More Articles